রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তিউনিসিয়া : নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সন্ধানে

আরব বিশ্বের রাজনীতিতে তিউনিসিয়ায় নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ ২৩ বছর যে দেশটি শাসিত হয়েছে একনায়কতান্ত্রিকভাবে, যেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো লেশমাত্র ছিল না, সেখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আরব বিশ্বে গত এক বছর ধরে যে আন্দোলন চলছে, যা পশ্চিমা বিশ্বে 'আরব বসন্ত' নামে অভিহিত করা হচ্ছে, তিউনিসিয়ার নির্বাচন সেই 'আরব বসন্ত'কে নতুন একটি মাত্রা দিল। তবে তিউনিসিয়ার মতো অন্যান্য আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে কি না, সে ব্যাপারে এখনই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তিউনিসিয়ার গণ-অভ্যুত্থান সেখানে ২৩ বছরের শাসক জয়নুল আবেদিন বেন আলীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এর রেশ গিয়ে লেগেছিল মিসর ও লিবিয়াতেও। মিসরেও গণ-অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক অনেক আগেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। আর বিদেশি শক্তির প্ররোচনায় পরিচালিত একটি যুদ্ধ লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তাকে হত্যা করা হয়। এখানে পার্থক্যটা হচ্ছে তিউনিসিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে একটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু মিসরে নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একটি বড় অনিশ্চয়তা। যে বিপ্লবীরা দীর্ঘ ১৮ দিন তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করে হোসনি মোবারককে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল, সেই বিপ্লবীরা আবার ফিরে এসেছে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে। বিপ্লবীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেছে। কিন্তু সামরিক জান্তার ব্যাপারে বিপ্লবীরা অনড়। যে সামরিক জান্তা মোবারকের পতনের পর ক্ষমতা নিয়েছিল, তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফিল্ড মার্শাল তানতাবি। তার পদত্যাগ এখন বিপ্লবীদের দাবি। লিবিয়ায় নতুন একটি সরকার গঠিত হলেও কবে নাগাদ সেখানে নির্বাচন হবে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিউনিসিয়ায় নির্বাচন আরব বিশ্বের রাজনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য একটি অগ্রগতি। আরো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এ কারণে যে সেখানে ইসলামিক আদর্শে বিশ্বাসী একটি দলের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ একটি দলের সহাবস্থান হয়েছে এবং তারা একত্রে সরকার গঠনে সম্মত হয়েছে। নির্বাচনে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত এন্নাহদা ২১৭টি আসনের সংসদে ৮৯টি আসন পেয়েছে। অন্যদিকে কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক দল পেয়েছে ২৯টি, আর এত্তাকাতুল দল পেয়েছে ২১টি আসন। এই তিন দলের সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার সেখানে গঠিত হয়েছে। এন্নাহদার নেতা হামাদি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেস ফর দি রিপাবলিকের মুনসেফ মারজুকি প্রেসিডেন্ট আর এত্তাকাতুল দলের মুস্তাফা বিন জাফর স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদ দেশটির জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে। এখানে বলা ভালো, এই নির্বাচনের আগে সেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এক সমাজব্যবস্থা চালু ছিল। সেখানে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল, সেখানে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। তিউনিসিয়ায় ব্যক্তি বেন আলী ও তার পরিবার ক্ষমতা পরিচালনা করতেন। ডেমোক্রেটিক কনসটিটিউশনাল র‌্যালি নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে বেন আলী ২৩ বছর ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। মিসরেও একই ধারা আমরা প্রত্যক্ষ করি।
অতি সম্প্রতি তিউনিসিয়ার নির্বাচনে নতুন এক রাজনৈতিক ধারার জন্ম হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা নির্বাচনে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত দল এন্নাহদার বিজয় নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিতে যাচ্ছে তিউনিসিয়ায়। ১৯৫৬ সালে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৭ সাল থেকে বেন আলী ছিলেন ক্ষমতায়। মধ্য ষাটের দশকে এন্নাহদা নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর চলতি বছরের মার্চ মাসে দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দলটির শীর্ষ নেতা রশিদ আল ঘানুচি দীর্ঘদিন ছিলেন লন্ডনে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরই তিনি তিউনিসিয়ায় ফিরে আসেন। এন্নাহদা কট্টরপন্থী কোন ইসলামিক দল নয়। একসময় দলটি মিসরের নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক ব্রাদারহুড়ের রাজনীতি অনুসরণ করত। ১৯৮১ সালে দলটির জন্ম হয়েছিল। তখন দলটির নাম ছিল 'ইসলামিক টেনডেনসি মুভমেন্ট'। পরে ১৯৮৯ সালে এন্নাহদা বা 'গণজাগরণ আন্দোলন' নাম ধারণ করে। দলটি ইসলাম আর গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। দলটির সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন 'জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি'র অনেক মিল রয়েছে। এন্নাহদার নেতারা এটা স্বীকারও করেন। তারা তিউনিসিয়ায় একটি 'তুরস্ক মডেল' অনুসরণ করতে চান। ঘানুচি নিজেই বলেছেন, ্তুওহ ঞঁৎশু ধহফ ঞঁহরংরধ ঃযবৎব ধিং ঃযব ংধসব সড়াবসবহঃ ড়ভ ৎবপড়হপরষরধঃরড়হ নবঃবিবহ ওংষধস ড়ভ সড়ফবৎহরঃু ধহফ বি ধৎব ঃযব ফবংপবহফধহঃং ড়ভ ঃযরং সড়াবসবহঃ্থ। ঘানুচির বক্তব্যের মধ্যে থেকে এটা বোঝা যায়, এন্নাহদা আধুনিকতার বিরোধী নয়। এমনকি এবার নির্বাচনে এমন অনেক মহিলা এই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, যারা হিজাব পরেন না এবং পর্দাও করেন না। এন্নাহদা বহুদলীয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনে বিশ্বাসী। তিউনিসিয়ায় ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল ব্যক্তির অধিকারসংক্রান্ত বিধি-বিধান। যেখানে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সমতা আনা হয়েছিল। সেখানে পুরুষদের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সমঅধিকার ভোগ করেন। এন্নাহদা এই বিধি-বিধানের বিরোধী নয়। ঘানুচির মতে, এই বিধি-বিধান (নারীর অধিকার সংক্রান্ত) হচ্ছে 'ইসলামের আইন অনুসারে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান'। ঘানুচির এই অভিমত যে কোনো ইসলামী মৌলবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে তাকে পার্থক্য করবে। মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে পারসীয় অঞ্চলে নারীদের অধিকার সীমিত। বহুবিবাহ সেখানে স্বীকৃত, আর নারীরা পুরুষের মতো সমঅধিকার ভোগ করেন না। তিউনিসিয়া এ থেকে পার্থক্য ছিল। এখন ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত এন্নাহদাও সমঅধিকারের পক্ষে। তিউনিসিয়ায় নারীদের চাকরি করার ব্যাপারে কোন বাধা নিষেধ নেই। তারা স্বামীর অনুমতি না নিয়েই নিজেরাই ব্যবসা করতে পারেন, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। হিজাব পরার ব্যাপারেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যা যে কোনো আরব বিশ্বে অকল্পনীয়। তিউনিসিয়ায় রাজনীতি ও স্থানীয় সরকারের নারীদের প্রতিনিধিত্বের হার শতকরা ২৭ দশমিক ৬ ভাগ, যার সঙ্গে নরডিকভুক্ত দেশগুলোর একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজে নারীদের এ অবস্থান অন্য কোনো আরব বিশ্বে দেখা যায় না। এমনি একটি দেশে ইসলামপন্থী একটি দলের নির্বাচনে বিজয় সংগত কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ঘানুচি হবেন তিউনিসিয়ার পরবর্তী নেতা, অনেকটা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট গুলের মতো, সংকটময় সময় যিনি তুরস্কের হাল ধরেছিলেন। তাকে একজন সমাজবিজ্ঞানী চিহ্নিত করেছেন এ ভাবে_ 'একজন আধুনিক মনস্ক মানুষ, যিনি ইসলাম ও আরবীয় ঐতিহ্য ধারণ করেন।' এটাই হচ্ছে আসল কথা। ঘানুচি কট্টর নন, আধুনিকমনস্ক এক মানুষ, যিনি অ্যারাবিয়ান ও ইসলামিক ঐতিহ্য ধারণ করেন। তিনি আদুনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে 'বিপ্লব' পরবর্তী তিউনিসিয়ায় নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দিতে চান। সম্ভবত তিনি হবেন আগামী দিনের তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট। তুরস্কের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট গুল ও প্রধানমন্ত্রী এরদোগান তার আদর্শ। তুরস্কের মডেল তিনি অনুসরণ করতে চান তিউনিসিয়ায়। তবে তিউনিসিয়ায় পটপরিবর্তন মিসরের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, সেটা একটা ভিন্ন প্রশ্ন। মিসরের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্নতর। সেখানে 'ইসলামিক ব্রাদারহুড' একটি শক্তিশালী ও ঐতিহ্যগত সংগঠন। সমাজে সর্বত্র এদের সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। দলটি অতীতে নিষিদ্ধ থাকলেও ভিন্ন সংগঠনের নামে সংগঠনের কর্মীরা সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এরা একটি শক্তি। মোবারকবিরোধী আন্দোলনেও এরা অংশ নিয়েছিল। ২৮ নভেম্বর সেখানে সংসদ নির্বাচন শুরু হয়েছে। ওই নির্বাচনে এন্নাহদার মতো 'ইসলামিক ব্রাদারহুড'ও যে ভালো ফলাফল করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তবে মিসরের সমস্যাটা অন্যত্র। ১১ ফেব্রুয়ারি (১১) হোসনি মোবারকের পদত্যাগের পর ফিল্ড মার্শাল হোসেন তানতাবির নেতৃত্বে ২৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি সামরিক জান্তা সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। এখন শোনা যাচ্ছে, তানতাবি নিজেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আগামী বছরের জুলাইয়ের আগে জান্তা প্রধান তানতাবি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। সামরিক জান্তা চাচ্ছে নয়া সংবিধানে তাদের একটা সাংবিধানিক স্বীকৃতি। এখন তানতাবির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মিসরের বিপ্লবকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতে পারে। আরব বিশ্বে একটা পরিবর্তন আসছে। গত ৬০ বছরের আরব বিশ্বের রাজনীতিতে তিনটি ধারা লক্ষণীয়। ১৯৫২ সালে জামাল আবদুন নাসেরের মিসরে ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রথম ধারা। তিনি আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়ে আরব বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, যখন আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে আরব বিশ্বে ইসরায়েলি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর। ইরানি বিপ্লব ইরানকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এই বিপ্লব ওই সময় আরব বিশ্বে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। এখন 'আরব বসন্ত' চতুর্থ একটি ধারার সূচনা করল। তিউনিসিয়ায় 'জেসমিন বিপ্লব' একটি পরিবর্তনের সূচনা করল। ইসলামপন্থী কিন্তু আধুনিকমনস্ক একটা নয়া নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে আরব বিশ্বে। এন্নাহদার বিজয় এ কথাটাই প্রমাণ করল। তবে গণতন্ত্র বিনির্মাণের পথটি এত সহজ নয়। বলতেই হবে এন্নাদহার নেতৃত্বে অনেক নমনীয় হয়েছেন। এককভাবে নির্বাচনে বিজয়ী না হওয়ায়, তারা একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু কট্টরপন্থী কোন ইসলামিক নীতি গ্রহণ করতে চাইলে, তা বির্তকের মাত্রা বাড়াবে। তাতে করে বিপ্লবের লক্ষ্যে পেঁৗছানো সম্ভব নাও হতে পারে। এখন এই তিন দলের মাঝে বিশ্বাস ও আস্থা বিপ্লব-পরবর্তী তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে একটি শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেবে। সেখানকার সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এটাই। 
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment