রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। বিজয়ের এই চল্লিশ বছরে এসেও পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের যে রাজনীতি, তা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য এটা একটা প্রধান অন্তরায়। আমাদের মাঝে বিভক্তি এত বেশি যে তা উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির ডাকে হরতাল পালিত হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তির প্রতিবাদে এই হরতাল আহ্বান করেছিল বিএনপি। কিন্তু হরতাল পালনকালে যা ঘটল এবং যার সাক্ষী সংবাদপত্রগুলো, তা আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের মাঝে বিভক্তি এবং অসহিষ্ণুতা কত বেশি। অভিযোগ উঠেছে পুলিশ বেষ্টনীতে ডিসিসির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। খোকা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পায়ে পাঁচটি সেলাই দেওয়া হয়েছে, এ ভাষ্য ডাক্তারের। রক্তাক্ত তার পায়ের ছবিও প্রকাশ করেছে একটি অনলাইন সংবাদপত্র। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তারা খোকাকে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে তাকে ছুরিকাঘাত করল কারা? পুলিশের ভাষ্যে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো সাক্ষী, হরতাল চলাকালীন সরকার সমর্থকরা কী ধরনের আচরণ করেছিল। সকালের খবর-এও আছে তেমন একটি ছবি। পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ছবিও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। একটি সমাজের উন্নয়নের জন্য এ ধরনের ছবি আমাদের কোনো আশার কথা শোনায় না। ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করা হয়েছে-উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটি সিটি করপোরেশন হয়েছে। এ নিয়ে সরকার আর বিরোধী দলের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। সরকারের যুক্তি, এতে করে জনগণের সেবার মান আরও বাড়বে। আর বিরোধী দলের যুক্তি এতে জটিলতা সৃষ্টি হবে। সুশীল সমাজের মনোভাবও অনেকটা তেমনই। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করেছিল। হরতাল পালন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সরকার সমর্থকরা যখন লাঠি হাতে হরতাল প্রতিহত করার উদ্যোগ নেয়, যখন খোকার মতো ‘সাবেক একজন নগর পিতা’ ছুরিকাঘাতে আহত হন, তখন আমাদের জন্য তা কোনো ভালো সংবাদ নয়। ঠিক তেমনি পুলিশের ভ্যান জ্বলবে, এটাও প্রত্যাশিত নয়। এটা অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ। এই প্রবণতা আমরা যদি রোধ করতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশ কোনো দিনই একটি মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে না।
রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই। এই বিরোধিতা হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সহনীয়। এই বিরোধিতা পশ্চিমা সমাজেও আছে। আমেরিকার মতো সমাজেও ‘শাটডাউন’ বা বন্ধের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু তা কখনই সহিংস পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয় না। এমনকি এটাও দেখা গেছে, প্রতিবাদ হয় একটা সীমিত জায়গায়। প্রতিবাদকারীরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন হতে পারে কোনো কল-কারখানার সামনে) জমায়েত হয়ে হাতে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে ঘুরে ঘুরে স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ করছেন। জনজীবনকে এরা বাধাগ্রস্ত করছেন না। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতের খবরও আমরা দেখি। কিন্তু খুব কম পর্যায়েই তা সহিংসতায় পরিণত হয়। পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া একটি গুরুতর অপরাধ পশ্চিমা বিশ্বে। পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিবাদকারীদের ওপর সরকার সমর্থকরা আক্রমণ করেছেন এ ধরনের কোনো খবর আমরা কোনো দিন পড়িনি। আমি নিজে দেখিওনি। আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে প্রতিবাদের ভাষা আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা শুধু বারবার আমাদের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। প্রতিবাদের এই সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। আর উদ্যোগটা নিতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। আমাদের সমস্যা অনেক। এই সমস্যা একা সরকারের পক্ষে সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়। অবশ্যই বিরোধী দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার তিন বছর পার করার আগে অনেক সমস্যা মোকাবেলা করছে। এক, সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে (সরকারি ও বেসরকারি) প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বছর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। হ্রাস পাবে প্রবৃদ্ধির হার। এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার একটি ত্রুটি। সরকার অবশ্যই ঋণ নেবে। কিন্তু তা যেন একটা সীমার মধ্যে থাকে। কৃচ্ছ্র সাধন জরুরি। কিন্তু কৃচ্ছ্র সাধন হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় পিপিপি মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। স্পেনের মতো দেশে অতিসম্প্রতি অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলগুলোতে যে টয়লেট পেপার সরবরাহ করা হতো তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ছোট্ট উদাহরণ। বাংলাদেশে বিশ্বমন্দার প্রভাব এই মুহূর্তে আমরা অনুভব করতে পারছি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃচ্ছ্র সাধন জরুরি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী রফতানি আয় কমেছে শতকরা ৩৯ ভাগ, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ১১ দশমিক ৭৩ ভাগ। তিন হাজার তৈরি পোশাক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতায় নেওয়া প্রয়োজন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্য গত চল্লিশ বছরে আমরা এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। আজ সময় এসেছে এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার। বাংলাদেশে এক ধরনের অসমতা তৈরি হয়েছে। এখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বিজয়ের চল্লিশ বছরে দাঁড়িয়েও আমরা দেখি বাংলাদেশে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই অসমতা আর বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে ‘অকুপাই আন্দোলনের’ জন্ম দিয়েছে। আরব বিশ্বে সৃষ্টি করেছে ‘আরব বসন্ত’। আমরা এ থেকে যেন শিক্ষা নেই। দারিদ্র্য দূরীকরণ, কিংবা অসমতা দূরীকরণে আজ প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। বিরোধী দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখবে না। ‘আরব বসন্ত’ সৃষ্টি করেছিল তরুণ সমাজ। আরব বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগের ওপরে হচ্ছে এই তরুণ প্রজন্ম, যারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ‘বিপ্লব’কে সংগঠিত করেছিল। বাংলাদেশে তরুণ সমাজের অংশও একেবারে কম নয়। এদের মাঝে অনেকেই বেকার। এই তরুণ সমাজ একটি শক্তি হতে পারে, যদি এদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। প্রথাগত শিক্ষা বাদ দিয়ে এদেরকে যদি কর্মমুখী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, সমাজ পরিবর্তনে পালন করতে পারে এরা একটি বড় ভূমিকা। প্রায় একশ’টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বের হচ্ছে। অথচ এদের জন্য চাকরি নেই। পৃথিবীর কোনো দেশেই এককভাবে সরকার কর্মসংস্থান করে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বেসরকারি সেক্টরের ভূমিকা বেড়েছে। কিন্তু সেখানে মেধার পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না। আগামী ২০ বছরকে সামনে রেখে আমাদের কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনশক্তি দরকার, তা আমরা জানি না। ফলে উদ্ভ্রান্তের মতো তরুণ সমাজ এমন সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, যাতে সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে চাকরির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। অথচ এই জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং ভাষা শিক্ষা দিয়ে বিদেশের জব মার্কেটে তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। এজন্য দরকার পরিকল্পনার ও দৃষ্টিভঙ্গির। বিরোধী দলের ভূমিকাও এখানে থাকা উচিত। বিরোধী দল শুধু সরকার পতনে তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখবে, তা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তাদের একটা ‘ভিশন’ থাকা উচিত, পরিকল্পনা থাকা উচিত। বিরোধী দল একটি ‘শ্যাডো ক্যাবিনেট’ বা ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন করবে, যেখানে সরকারের মন্ত্রীর বিকল্প থাকবে বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, যিনি সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিকল্প নীতি উপস্থাপন করবেন। প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই আমরা এই ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ (যেমন ব্রিটেনে) কাজ করতে দেখি। বাংলাদেশে বিরোধী দল একটি ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন করতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে জাতীয় ঐকমত্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, গত চল্লিশ বছরে জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনও বিভক্ত। অতীত অভিজ্ঞতা বলে একমাত্র সংসদীয় সরকারের ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে (পঞ্চম সংসদ, দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী) সরকার ও বিরোধী দল এক হয়েছিল। এরপর থেকে (১৯৯১) কোনো একটি ইস্যুতেও সরকার ও বিরোধী দল এক হতে পারেনি। অতিসম্প্রতি টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের শঙ্কা যখন বাড়ছে, সেখানেও ভবিষ্যত্ কর্মপন্থা নির্ধারণে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে কোনো সহাবস্থান হয়নি। অথচ টিপাইমুখের বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। এর সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কয়েক কোটি জনগণের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত।
রাজনীতিতে এই যে অসহিষ্ণুতা, এই অসহিষ্ণুতা যদি আমরা পরিত্যাগ করতে না পারি, যদি জাতীয় ইস্যুতে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে প্রায় ১৬ কোটির এই দেশটির জন্য আরও অনেক দুঃখ কষ্ট অপেক্ষা করছে। দেশটি ৫০ বছরে পা দেবে ২০২১ সালে। ওই পঞ্চাশ বছরের একটি দেশের জন্য আমাদের পরিকল্পনা কী, কী পরিমাণ জনশক্তি আমাদের দরকার, আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাইবা কী হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। আমরা এখনও বিভক্ত সমাজ। বিভক্ত জাতি। সরকারের সব কিছুর বিরোধিতা যেমন আমাদের মজ্জাগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে, ঠিক তেমনি বিরোধী দলের যে কোনো কর্মপরিকল্পনায় আমরা ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে ফিরি। নির্বাচন হয়। জনগণ ভোট দেয়। একটি দল ক্ষমতায় যায়। কিন্তু রাজনীতির যে ‘চরিত্র’ তা বদলে যায় না। অসহিষ্ণুতা, অপরকে সহ্য না করার যে মানসিকতা, সেই মানসিকতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। আমাদের অনেক প্রাপ্তি আছে ওই চল্লিশ বছরে। কিন্তু একটি বড় অপ্রাপ্তি আমাদের মাঝে বিভক্তি, অসহিষ্ণুতা এবং সেই সঙ্গে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব।
দৈনিক সকালের খবর। ১৩ ডিসেম্বর ২০১১।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tsrahmanbd@yahoo.com
রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই। এই বিরোধিতা হতে হবে শান্তিপূর্ণ ও সহনীয়। এই বিরোধিতা পশ্চিমা সমাজেও আছে। আমেরিকার মতো সমাজেও ‘শাটডাউন’ বা বন্ধের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু তা কখনই সহিংস পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয় না। এমনকি এটাও দেখা গেছে, প্রতিবাদ হয় একটা সীমিত জায়গায়। প্রতিবাদকারীরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন হতে পারে কোনো কল-কারখানার সামনে) জমায়েত হয়ে হাতে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে ঘুরে ঘুরে স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ করছেন। জনজীবনকে এরা বাধাগ্রস্ত করছেন না। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতের খবরও আমরা দেখি। কিন্তু খুব কম পর্যায়েই তা সহিংসতায় পরিণত হয়। পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া একটি গুরুতর অপরাধ পশ্চিমা বিশ্বে। পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিবাদকারীদের ওপর সরকার সমর্থকরা আক্রমণ করেছেন এ ধরনের কোনো খবর আমরা কোনো দিন পড়িনি। আমি নিজে দেখিওনি। আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে প্রতিবাদের ভাষা আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা শুধু বারবার আমাদের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। প্রতিবাদের এই সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। আর উদ্যোগটা নিতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। আমাদের সমস্যা অনেক। এই সমস্যা একা সরকারের পক্ষে সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়। অবশ্যই বিরোধী দলের সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার তিন বছর পার করার আগে অনেক সমস্যা মোকাবেলা করছে। এক, সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে (সরকারি ও বেসরকারি) প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বছর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। হ্রাস পাবে প্রবৃদ্ধির হার। এটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার একটি ত্রুটি। সরকার অবশ্যই ঋণ নেবে। কিন্তু তা যেন একটা সীমার মধ্যে থাকে। কৃচ্ছ্র সাধন জরুরি। কিন্তু কৃচ্ছ্র সাধন হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় পিপিপি মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। স্পেনের মতো দেশে অতিসম্প্রতি অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলগুলোতে যে টয়লেট পেপার সরবরাহ করা হতো তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ছোট্ট উদাহরণ। বাংলাদেশে বিশ্বমন্দার প্রভাব এই মুহূর্তে আমরা অনুভব করতে পারছি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃচ্ছ্র সাধন জরুরি। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী রফতানি আয় কমেছে শতকরা ৩৯ ভাগ, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ১১ দশমিক ৭৩ ভাগ। তিন হাজার তৈরি পোশাক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতায় নেওয়া প্রয়োজন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। দুঃখজনক হলেও সত্য গত চল্লিশ বছরে আমরা এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি। আজ সময় এসেছে এই সংস্কৃতি গড়ে তোলার। বাংলাদেশে এক ধরনের অসমতা তৈরি হয়েছে। এখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বিজয়ের চল্লিশ বছরে দাঁড়িয়েও আমরা দেখি বাংলাদেশে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই অসমতা আর বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রে ‘অকুপাই আন্দোলনের’ জন্ম দিয়েছে। আরব বিশ্বে সৃষ্টি করেছে ‘আরব বসন্ত’। আমরা এ থেকে যেন শিক্ষা নেই। দারিদ্র্য দূরীকরণ, কিংবা অসমতা দূরীকরণে আজ প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। বিরোধী দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো উদ্যোগই সাফল্যের মুখ দেখবে না। ‘আরব বসন্ত’ সৃষ্টি করেছিল তরুণ সমাজ। আরব বিশ্বের জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগের ওপরে হচ্ছে এই তরুণ প্রজন্ম, যারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ‘বিপ্লব’কে সংগঠিত করেছিল। বাংলাদেশে তরুণ সমাজের অংশও একেবারে কম নয়। এদের মাঝে অনেকেই বেকার। এই তরুণ সমাজ একটি শক্তি হতে পারে, যদি এদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। প্রথাগত শিক্ষা বাদ দিয়ে এদেরকে যদি কর্মমুখী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, সমাজ পরিবর্তনে পালন করতে পারে এরা একটি বড় ভূমিকা। প্রায় একশ’টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বের হচ্ছে। অথচ এদের জন্য চাকরি নেই। পৃথিবীর কোনো দেশেই এককভাবে সরকার কর্মসংস্থান করে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বেসরকারি সেক্টরের ভূমিকা বেড়েছে। কিন্তু সেখানে মেধার পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না। আগামী ২০ বছরকে সামনে রেখে আমাদের কোন সেক্টরে কী পরিমাণ জনশক্তি দরকার, তা আমরা জানি না। ফলে উদ্ভ্রান্তের মতো তরুণ সমাজ এমন সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, যাতে সমাজ বা রাষ্ট্র তাকে চাকরির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। অথচ এই জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং ভাষা শিক্ষা দিয়ে বিদেশের জব মার্কেটে তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা আমরা করতে পারি। এজন্য দরকার পরিকল্পনার ও দৃষ্টিভঙ্গির। বিরোধী দলের ভূমিকাও এখানে থাকা উচিত। বিরোধী দল শুধু সরকার পতনে তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখবে, তা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তাদের একটা ‘ভিশন’ থাকা উচিত, পরিকল্পনা থাকা উচিত। বিরোধী দল একটি ‘শ্যাডো ক্যাবিনেট’ বা ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন করবে, যেখানে সরকারের মন্ত্রীর বিকল্প থাকবে বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, যিনি সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিকল্প নীতি উপস্থাপন করবেন। প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই আমরা এই ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ (যেমন ব্রিটেনে) কাজ করতে দেখি। বাংলাদেশে বিরোধী দল একটি ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন করতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে জাতীয় ঐকমত্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, গত চল্লিশ বছরে জাতীয় ইস্যুতে আমরা এখনও বিভক্ত। অতীত অভিজ্ঞতা বলে একমাত্র সংসদীয় সরকারের ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে (পঞ্চম সংসদ, দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী) সরকার ও বিরোধী দল এক হয়েছিল। এরপর থেকে (১৯৯১) কোনো একটি ইস্যুতেও সরকার ও বিরোধী দল এক হতে পারেনি। অতিসম্প্রতি টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের শঙ্কা যখন বাড়ছে, সেখানেও ভবিষ্যত্ কর্মপন্থা নির্ধারণে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে কোনো সহাবস্থান হয়নি। অথচ টিপাইমুখের বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু। এর সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কয়েক কোটি জনগণের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত।
রাজনীতিতে এই যে অসহিষ্ণুতা, এই অসহিষ্ণুতা যদি আমরা পরিত্যাগ করতে না পারি, যদি জাতীয় ইস্যুতে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে প্রায় ১৬ কোটির এই দেশটির জন্য আরও অনেক দুঃখ কষ্ট অপেক্ষা করছে। দেশটি ৫০ বছরে পা দেবে ২০২১ সালে। ওই পঞ্চাশ বছরের একটি দেশের জন্য আমাদের পরিকল্পনা কী, কী পরিমাণ জনশক্তি আমাদের দরকার, আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাইবা কী হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। আমরা এখনও বিভক্ত সমাজ। বিভক্ত জাতি। সরকারের সব কিছুর বিরোধিতা যেমন আমাদের মজ্জাগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে, ঠিক তেমনি বিরোধী দলের যে কোনো কর্মপরিকল্পনায় আমরা ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে ফিরি। নির্বাচন হয়। জনগণ ভোট দেয়। একটি দল ক্ষমতায় যায়। কিন্তু রাজনীতির যে ‘চরিত্র’ তা বদলে যায় না। অসহিষ্ণুতা, অপরকে সহ্য না করার যে মানসিকতা, সেই মানসিকতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। আমাদের অনেক প্রাপ্তি আছে ওই চল্লিশ বছরে। কিন্তু একটি বড় অপ্রাপ্তি আমাদের মাঝে বিভক্তি, অসহিষ্ণুতা এবং সেই সঙ্গে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব।
দৈনিক সকালের খবর। ১৩ ডিসেম্বর ২০১১।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment