উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং ইল মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর তার ছোট সন্তান কিম জং উন তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। চীন এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের প্রশ্নটি কোন পথে! বিষয়টি এখন আলোচিত। যদিও চীন সরাসরি দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে এটা সত্য, চীন যদি তার অবস্থান পরিবর্তন করে, তাহলে আগামীতে আমরা দুই কোরিয়াকে এক দেখতে পাব। এ ক্ষেত্রে একত্রীকরণের পথে নানা সমস্যা রয়েছে। দুই জার্মানি একত্রিত হয়েছিল আজ থেকে ২০ বছর আগে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ছিল দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের দিকে। এখানে সমস্যা হচ্ছে একত্রীকরণের পর কোরিয়ার সমাজব্যবস্থা কী হবে? পুঁজিবাদী সমাজ, নাকি সমাজতান্ত্রিক সমাজ? জার্মানিতে এখন আর সমাজতান্ত্রিক সমাজ নেই। পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে মিশে গিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চীনেও আজ ধ্রুপদী মার্কসবাদ নেই। চীনের সঙ্গে হংকং একীভূত হয়েছে হংকংয়ের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বজায় রেখেই। যে ব্যবস্থাকে চীন বলছে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’। তেং জিয়াও পিং ছিলেন এই ধারণার প্রবক্তা। চীন তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও একই নীতি আবলম্বন করছে। তাইওয়ান হংকং মডেল অনুসরণ করে চীনের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। কোরিয়ার ক্ষেত্রে এই হংকং মডেল একটি সমাধান হতে পারে। ভবিষ্যত্ই বলে দেবে দুই কোরিয়া এক হবে কি না।
এই মুহূর্তে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা নেই বটে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইয়ংপিং দ্বীপে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ (২০১০-এর ২৩ নভেম্বর) ও তাতে দুই সৈনিকের মৃত্যু, দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীপ্রধানের পদত্যাগের পর দীর্ঘদিন উত্তেজনা সেখানে বজায় ছিল। ওই সময় একটি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছিল। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে ছয় জাতি আলোচনাও কার্যত ব্যর্থ। উত্তর কোরিয়াকে কোনোভাবেই আলোচনার টেবিলে আনা যাচ্ছে না। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনায় উত্সাহী। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন ছুটে গিয়েছিলেন জাপানে। তিনি সেখানে তিন জাতিভিত্তিক একটি ‘প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার কথাও বলেছিলেন। চীনের একজন সিনিয়র কূটনীতিকও পিয়ং ইয়ং সফর করেছিলেন। এতে উত্তেজনা সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল সত্য। কিন্তু স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে এ ধরনের উত্তেজনা বড় বাধা, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে ৮ম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর পর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা যায়। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইঅনস্থ (ণড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ছয় থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান ও সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ান রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ান নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার’ জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দু’ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও, দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সীমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেটি কার্যকর হয় দু’বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও, উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৬৪ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও, উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে একবার, ১৯৯৪ সালে কিম ইল সুং-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। এখন তার ছোট সন্তানকে সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেওয়া হল। তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, সেটা হবে একুশ শতকের শুরুতে একটি বড় ধরনের ঘটনা। তবে যে কোনো মুহূর্তে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া তাদের প্রধান পরমাণু স্থাপনা ছাড়াও গোপনে আরও কয়েকটি স্থাপনায় ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়া আরও পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনাও করছে। এজন্য তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। এ হারে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে আগামী মার্চ বা মে মাস নাগাদ প্রয়োজনীয় এক হাজার মিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এতে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। যুদ্ধ হবে কি না বলা মুশকিল। কেননা উত্তর কোরিয়া যেখানে বড় ধরনের খাদ্য সঙ্কটের মুখে সেখানে তারা এত বড় ঝুঁকি নেবে না। উত্তেজনা জিইয়ে রেখে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়।
এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু চীন। চীন যদি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া ‘একা’ হয়ে পড়বে। তখন আলোচনায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না। উত্তর কোরিয়া বারবার বলে আসছে তার পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুত্ উত্পাদন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এবং দক্ষিণ কোরিয়া এই কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি সঙ্কটের সমাধানের সাময়িক উদ্যোগ নিলেও এই সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হয়নি। উত্তর কোরিয়া তার জ্বালানি সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস পেলে, দেশটি তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে পারে। তবে একটা মূল প্রশ্নের সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর তা হচ্ছে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ। আগামীতে সব আলোচনাই কেন্দ্রীভূত হবে একত্রীকরণের লক্ষ্যে। ওবামা প্রশাসনকে এ লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে হবে। কোরীয় উপদ্বীপে এই মুহূর্তে উত্তেজনা নেই সত্য, তবে লক্ষ রাখতে হবে নয়া নেতা কিম জং উন কী সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। তিনি যদি উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে মাত্র। ইরানের মতো উত্তর কোরিয়ায়ও ২০১২ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটি ইস্যু হতে পারে। তাই উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতার পালাবদল যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত হতে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দৈনিক সকালের খবর, ২৮ ডিসেম্বর ২০১১।
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tareque.rahman(a)aol.com
এই মুহূর্তে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা নেই বটে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইয়ংপিং দ্বীপে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ (২০১০-এর ২৩ নভেম্বর) ও তাতে দুই সৈনিকের মৃত্যু, দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীপ্রধানের পদত্যাগের পর দীর্ঘদিন উত্তেজনা সেখানে বজায় ছিল। ওই সময় একটি যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছিল। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে ছয় জাতি আলোচনাও কার্যত ব্যর্থ। উত্তর কোরিয়াকে কোনোভাবেই আলোচনার টেবিলে আনা যাচ্ছে না। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনায় উত্সাহী। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন ছুটে গিয়েছিলেন জাপানে। তিনি সেখানে তিন জাতিভিত্তিক একটি ‘প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার কথাও বলেছিলেন। চীনের একজন সিনিয়র কূটনীতিকও পিয়ং ইয়ং সফর করেছিলেন। এতে উত্তেজনা সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছিল সত্য। কিন্তু স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে এ ধরনের উত্তেজনা বড় বাধা, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে ৮ম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর পর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা যায়। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইঅনস্থ (ণড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ছয় থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান ও সেখানে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ান রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ান নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার’ জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দু’ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও, দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সীমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেটি কার্যকর হয় দু’বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও, উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৬৪ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও, উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে একবার, ১৯৯৪ সালে কিম ইল সুং-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। এখন তার ছোট সন্তানকে সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেওয়া হল। তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, সেটা হবে একুশ শতকের শুরুতে একটি বড় ধরনের ঘটনা। তবে যে কোনো মুহূর্তে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া তাদের প্রধান পরমাণু স্থাপনা ছাড়াও গোপনে আরও কয়েকটি স্থাপনায় ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়া আরও পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনাও করছে। এজন্য তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। এ হারে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে আগামী মার্চ বা মে মাস নাগাদ প্রয়োজনীয় এক হাজার মিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া আরেকটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এতে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। যুদ্ধ হবে কি না বলা মুশকিল। কেননা উত্তর কোরিয়া যেখানে বড় ধরনের খাদ্য সঙ্কটের মুখে সেখানে তারা এত বড় ঝুঁকি নেবে না। উত্তেজনা জিইয়ে রেখে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়।
এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু চীন। চীন যদি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া ‘একা’ হয়ে পড়বে। তখন আলোচনায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না। উত্তর কোরিয়া বারবার বলে আসছে তার পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুত্ উত্পাদন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এবং দক্ষিণ কোরিয়া এই কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার জ্বালানি সঙ্কটের সমাধানের সাময়িক উদ্যোগ নিলেও এই সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হয়নি। উত্তর কোরিয়া তার জ্বালানি সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস পেলে, দেশটি তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে পারে। তবে একটা মূল প্রশ্নের সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর তা হচ্ছে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণ। আগামীতে সব আলোচনাই কেন্দ্রীভূত হবে একত্রীকরণের লক্ষ্যে। ওবামা প্রশাসনকে এ লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে হবে। কোরীয় উপদ্বীপে এই মুহূর্তে উত্তেজনা নেই সত্য, তবে লক্ষ রাখতে হবে নয়া নেতা কিম জং উন কী সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। তিনি যদি উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে মাত্র। ইরানের মতো উত্তর কোরিয়ায়ও ২০১২ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটি ইস্যু হতে পারে। তাই উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতার পালাবদল যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত হতে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দৈনিক সকালের খবর, ২৮ ডিসেম্বর ২০১১।
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
tareque.rahman(a)aol.com
0 comments:
Post a Comment