সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হলেও তাতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়েছিল মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। ক্লিনটনের সফরের সময় একটি 'অংশীদারি সংলাপ' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার বিস্তারিত আমরা কিছুই জানি না। অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্র 'চীনকে ঘিরে ফেলার' যে স্ট্রাটেজি রচনা করছে, তাতে এই চুক্তি একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত 'আকসা' চুক্তি নিয়েও কথা আছে। 'আকসা' চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধার জন্য 'পোর্ট অব কল' সুবিধা পাবে। এ চুক্তি নিয়েও কথা আছে। প্রস্তাবিত এ চুক্তি বাংলাদেশে মার্কিন ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও বাংলাদেশ এখনো চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়নি। এখন এতে যোগ হল বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রী গত ২৬ জুলাইও লন্ডনে এক মিডিয়াকর্মীদের সমাবেশে বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করেছেন। এতে করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর উপদেষ্টারা সঠিক তথ্যগুলো সরবরাহ করেন কিনা, আমার সন্দেহ রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরপরই সাহায্য প্রবাহে ভাটা পড়েছে। দাতারা বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গেল জুন পর্যন্ত (২০১২) আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু মে পর্যন্ত গেল ১১ মাসে আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৪২৮ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার কম। আর এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় আগামী দিনগুলোতে এই সাহায্যের প্রবাহ আরো কমবে। আবুল হোসেনের পদত্যাগ ও ওই সময়ে সেতু বিভাগের সচিবকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠানোর পরও দাতাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা, সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানও পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ রেখেছে। বিশ্বব্যাংক একবার কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করলে আবার ওই প্রকল্পে আর অর্থায়ন করে না। এটা তাদের নীতির পরিপন্থী। শুধু পদ্মা সেতুই নয়, এখন বিশ্বব্যাংক যে ৩০টি প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে, তাও একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থাকল। এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়েও এখন বিশ্বব্যাংক প্রশ্ন তুলতে পারে। আর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত না হলে, এডিবি কিংবা জাপানের মতো দাতা দেশও পিছিয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়, আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখানে জেদ বা গোঁয়ার্তুমির কোনো প্রশ্ন ছিল না। প্রধানমন্ত্রীকে সমস্যার গভীরতা বোঝানো হয়নি। অথচ চাটুকাররা প্রধানমন্ত্রীর নেকনজর পাওয়ার জন্য এখনো দিব্যি ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমনি একজনের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ২০ জুলাই এর সংখ্যায়। এক সময়ের মস্কোপন্থী, বর্তমানে 'নও আওয়ামী লীগার' একটি তত্ত্ব দিয়েছেন_ একটি নয়, নিজস্ব অর্থায়নে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব (?) বিভ্রান্তিরও একটি সীমা থাকে। তিনি বলেছেন, মোট ১২টি উৎস থেকে ৪ বছরে ৯৮ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব, আর ওই টাকা দিয়ে ৪টি সেতু নির্মাণ করা যায়। হায় রে অর্থনীতিবিদ! এসব তথাকথিত বামমনা ও মস্কোপন্থীদের কারণেই সরকারের এই দুরবস্থা। সরকারপ্রধান এদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হয়। লন্ডনেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'দেশের টাকায় পদ্মা সেতু হবে_ সেটা হবেই।' নিজস্ব অর্থায়নে অনেক কিছু করাই সম্ভব। কিন্তু পদ্মা সেতু? যার দৈর্ঘ্যু ৬ কিলোমিটার সেটা করা সম্ভব? না সম্ভব নয়। এর হিসাব ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংকের দেওয়ার কথা ১২০ কোটি, এডিবি ৬১ কোটি ও জাইকা ১৪ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় খরচ ২৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এখন নিজ উদ্যোগে, ঘরে ঘরে চাঁদা তুলে, এক দিনের বেতন বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিয়ে আমরা কী পদ্মা সেতু করতে পারব? এটা করতে গিয়ে সমস্যা হবে একাধিক। প্রথমত, খরচের পরিমাণ ২৪ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটা সম্পন্ন করতে গিয়ে অন্য প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্য অঞ্চলের জনগণ। দ্বিতীয়ত, সরকার উদ্যোগ নিলে, সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠী (এমনকি আবুল হোসেনের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান) এ থেকে সুযোগ নেবে। ফলে বাড়বে দুর্নীতি। বাড়বে খরচ। আমরা রেন্টাল বিদ্যুতের অভিজ্ঞতা থেকে কি কিছুই শিখিনি? তৃতীয়ত, এটা করতে হলে আমাদের যে প্রযুক্তিগত মেধা ও জ্ঞান, তা আমাদের নেই। নিজ উদ্যোগে করা মানে একটা বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে থাকা। চতুর্থত, সেতুটির স্থায়িত্ব নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যাবে। একটি সেতুর নূ্যনতম বয়স একশ বছর হয়ে থাকে। বিদেশি দাতারা যখন কোনো প্রজেক্টে অর্থায়ন করে, তখন কঠিন মনিটরিংয়ের মধ্যে তা শেষ হয়। ফলে দুর্নীতির সুযোগ তেমন একটা থাকে না। এখন নিজ উদ্যাগে সেতুটি তৈরি হলে, সেতুটির দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। পঞ্চমত, নিজ উদ্যোগে সেতুটি তৈরি হলেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে নানা কারণে। প্রযুক্তি হস্তান্তর, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ_ ইত্যাদিতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে। সরকার যদি বিশ্বব্যাংকের পরিবর্তে মালয়েশিয়াকে বেছে নিয়ে থাকে, সরকার বড় ভুল করবে। কেননা মালয়েশিয়ার সুদের হার অনেক বেশি। উপরন্তু মালয়েশিয়া মূলত ঠিকাদারি করতে চায়। ষষ্ঠত, সামনে নির্বাচন। সরকারকে বুঝেশুনেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পদ্মা সেতু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি ইস্যু হবে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্বব্যাংক আবার পদ্মা সেতুকে অর্থ বিনিয়োগ কতে রাজি হবে কিনা, আমরা তা জানি না। কিন্তু এই পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটে গেল, তা কাম্য ছিল না। এতে করে দেশে ও বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে।
Daily DESTINY
01.08.12
0 comments:
Post a Comment