আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব এখন আলোচনার অন্যতম বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব এবং খালেদা জিয়ার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর এখন নানা মহল থেকে নয়া প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জট খুলছে না। ধারণা করছি ঈদের পরের যে রাজনীতি, সেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দুটি প্রস্তাব এখন রাজনীতির মাঠে আছে। একটি প্রধানমন্ত্রীর, যেখানে তিনি বলেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যোগ দিতে পারে। আর দ্বিতীয়টি খালেদা জিয়ার, যেখানে তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। কোনো পক্ষই এ প্রস্তাব দুটির পক্ষে নমনীয় হচ্ছে না। ফলে একটি বড় ধরনের আশঙ্কা দানা বাঁধছে।
প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। বিএনপি কীভাবে যোগ দেবে, কতজন সদস্য থাকবে ওই সরকারে কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব কে দেবেন, তার বিষয়ে ব্যাখ্যা নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি এটা স্পষ্ট করতেন, তাহলে ওই সরকার নিয়ে বিশদ আলোচনা করা যেত। কিন্তু তার কোনো সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে এটা প্রধানমন্ত্রীর \'কথার কথা\'। তবে প্রধানমন্ত্রী এক জায়গায় ঠিক আছেন, আর তা হচ্ছে সংবিধান। সংবিধান সংশোধনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর ব্যাখ্যাও আছে সংবিধানে_ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে যে সরকার থাকবে, সেটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই সরকারের বয়স। ২০১৩ সালের অক্টোবরের পর মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থাকবে এবং তারাই সংবিধান অনুযায়ী চিহ্নিত হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে। শেখ হাসিনাই এ সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এমপিরা থাকবেন। মন্ত্রীরা থাকবেন বহাল তবিয়তে। বিএনপি তাতে যোগ দেবে, এটা মনে করার আদৌ কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে, তা তো সংবিধানে নেই। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এটা মানবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর জটটা লেগেছে এই জায়গাতেই। কেউ আধা ইঞ্চি ছাড় দিতেও রাজি নয়। দাতারা বারবার বলছে একটি সংলাপের কথা। বলছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। কিন্তু সরকার এদিকটায় যে খুব আন্তরিক তা মনে হয় না। এতে করে তো সমাধান হবে না। এখানে সম্ভাব্য কয়েকটি \'বিকল্প\' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এক. শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সমন্বয়েই গঠিত হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যেখানে মোট সদস্য থাকবেন দশজন। খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপি তথা তার নেতৃত্বাধীন জোটের ৫ জন, অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের ৫ জন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো সমানভাবে দুই জোটের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে এক জোট স্বরাষ্ট্র পেলে অন্য জোট পাবে পররাষ্ট্র। নির্বাচন কমিশন তাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে এবং রাষ্ট্রপতির কোনো ভূমিকা থাকবে না। এখানে বলা ভালো, সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের সমন্বয়ে যে সরকার গঠন সম্ভব, তার ইতিহাস আমাদের সম্মুখে আছে। বিগত আশির দশকে ইসরায়েলে এমনটি হয়েছিল। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা যদি রাখা যায়, তাহলে এই ফর্মুলা কাজ করবে। দুই. রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যেখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমানসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এই সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তাদের দায়িত্ব হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। তিন. স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সরকার, যে সরকারে দুই জোটের সমসংখ্যক প্রতিনিধি থাকবেন এবং স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। স্পিকার দীর্ঘদিন ধরে সংসদে আছেন। এখন অবসরে যেতে পারেন। তিনি হতে পারেন জাতির অভিভাবক। সংকটকালীন সময়ে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি আবার নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। চার. প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে শুধু সাংবিধানিক পদে যারা অধিষ্ঠিত, তাদের নিয়েও একটি সরকার হতে পারে। তবে বিগত প্রধান বিচারপতির কর্মকাণ্ড এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে নিরুৎসাহিত করার কারণে সঙ্গত কারণেই বর্তমান প্রধান বিচারপতি এ দায়িত্ব নেবেন না। পাঁচ. তিন বা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি \'এলডার্স কাউন্সিল\'-এর বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। মূল কথা আন্তরিকতা ও বিশ্বাস। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যা নেই এবং একটি সংলাপের সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে।
সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সংবিধানই চূড়ান্ত নয়। মানুষের জন্যই সংবিধান। মানুষের কল্যাণে সংবিধানে পরিবর্তন আনা যায়। অতীতেও আনা হয়েছে। সমঝোতা ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এককভাবে করা নির্বাচনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নেবে না। ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ সালে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (এরশাদের জমানায়) আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে সদ্য গঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়েছিল (শতকরা হার ৪২ দশমিক ৩৪ ভাগ), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬ দশমিক ১৫ ভাগ)। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু ৭ মের (১৯৮৬) ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদ তার মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। মজার ব্যাপার, ওই নির্বাচনে জামায়াত ১০টি, সিপিবি ৫টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ২টি, ন্যাপ (ভাসানী) ৫টি, বাকশাল ৩টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি ও স্বতন্ত্ররা ৩২টি আসন পেয়েছিলেন। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৩ মাসের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিও দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বয়কটের কারণে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তবে এই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা যদি মনে করে থাকেন, তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন, তাহলে সম্ভবত তারা ভুল করবেন। নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বরং সংকটকে আরও গভীরতর করবে। একটা সমঝোতায় পেঁৗছতেই হবে। যে সম্ভাবনা বা বিকল্প নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম, তার একটি নিয়ে সংলাপ হতে পারে। আরও ভালো হয় যদি বিএনপি নিজে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। সমঝোতা ছাড়া যে কোনো নির্বাচন হবে অর্থহীন।
Daily SAMAKAL
14.08.12
0 comments:
Post a Comment