প্রধানমন্ত্রী
অতি সম্প্রতি লন্ডন সফরকালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য
বিরোধী দল বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দল
নেত্রী বেগম জিয়া আবারো বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়, বরং একটি
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এ
ক্ষেত্রে একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতি যে অসহনীয় হয়ে উঠবে, তা
বলার আর অপেক্ষা রাখে না। একটি সমঝোতা এখন কীভাবে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী তথা
বর্তমান মন্ত্রিপরিষদকে ক্ষমতায় রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই
সরকার বিরোধী দল কেন, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে যদি
ষষ্ঠ সংসদের মতো একটি ঝুঁকি নেয়, তাহলে সরকার ভুল করবে। আমরা আর ইয়াজউদ্দিন
মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাব না_ এটা ঠিক আছে। কিন্তু সবার
অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক না হোক, অন্য কোনো নামে একটি
নির্দলীয় সরকার গঠন করতে হবে। বিএনপি যদি নিজেরাই একটা 'ফর্মুলা' দেয়,
তাতেও আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। আর সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোনো
মানে নেই। বিএনপি আগামী সংসদে যোগ দিয়ে এই 'ফর্মুলা' উপস্থাপন করতে পারে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এ দেশের দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। দুটো শক্তিই প্রায়
সমানসংখক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল এ কথাই
প্রমাণ করে। এ ক্ষেত্রে কখনো আওয়ামী লীগ জনসমর্থনে এগিয়ে থাকে। কখনো থাকে
বিএনপি। সুতরাং এটা উপলব্ধি করেই একটা সমঝোতা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ যদি ভালো
কাজ করে থাকে, তাহলে জনগণ আবার দলটিকে ক্ষমতায় পাঠাবে। আর জনসমর্থন
নিশ্চিত করা না গেলে, ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। গণতন্ত্রে এ কথাটাই শেখায়।
সংবিধানের যুক্তি তুলে ধরা হয় বটে, কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস বলে সংবিধানের
বাইরে গিয়েও সমঝোতা হয়েছে। যেমন কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালে। সরকার ও
বিরোধী দল মিলেই সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে আসছে। আসলে যা
প্রয়োজন, তা হচ্ছে আন্তরিকতা। বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ যদি আন্তরিক হয়,
তাহলে সমাধান সম্ভব। হার্ডলাইন কখনো মঙ্গল ডেকে আনে না। দেয়ালের লিখন তাই
বলে। সরকার যেহেতু ক্ষমতায়, তাই উদ্যোগটি তাকেই নিতে হবে। সৈয়দ আশরাফ একটি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে কথা বলেছিলেন। তিনি এখন এর কাঠামো তুলে
ধরতে পারেন, যা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তাদের
থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল', সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন
বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে একটি সরকার, সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে
সরকার, কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের সমসংখক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সরকার,
ইত্যাদি নানা ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর আলোচনার মধ্যে দিয়েই একটি
পথ বের হয়ে আসবে। কিন্তু সরকারের হার্ডলাইনে যাওয়ার কারণে আমরা নিশ্চিত হতে
পারছি না একটি সমঝোতা আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কি না? আর যদি সমঝোতা
প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে দেশ যে এক গভীর সংকটে পড়বে, তা আর কাউকে বলে দিতে
হবে না। বেগম জিয়া ঈদের পরে কর্মসূচি দেবেন। হরতাল, অবরোধ দিয়ে সরকারের পতন
হয় না। অতীতেও হয়নি। ১৮ দলের ১১ জুনের গণসমাবেশে সরকার তো নিজেরাই এক রকম
'হরতাল' ডেকে বসেছিল। ঢাকা অভিমুখে কোনো গাড়ি, লঞ্চ আসতে দেওয়া হয়নি।
কিন্তু তাতে গণসমাবেশ 'বাতিল' হয়নি। লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে গণসমাবেশ
সমাপ্ত হয়েছে। এখন সরকার গণসমাবেশের 'ভাষা' যদি বিবেচনায় নেয়, তাহলে একটা
সমাধান সম্ভব। দেশ গভীর সংকটে পড়ুক, আমরা তা চাই না। জাতির বৃহত্তম
স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটা সমাধান কাম্য। এ প্রশ্নে
'বিভক্তি' যদি থেকেই যায়, তাহলে তা আমাদের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
ইতিমধ্যে সুশীল সমাজের বক্তব্যও পাওয়া গেছে। সুশীল সমাজের প্রায় সবাই
বলছেন_ একটি সংলাপ হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো দাঁড় করানো
হোক, যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। হিলারি ক্লিনটন বলে
গিয়েছিলেন সে কথা। তার কথার প্রতিধ্বনি করেছিলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের
রাষ্ট্রদূত। আর সর্বশেষ গত ৩০ মে তাদের সুরে সুর মেলালেন অ্যালিষ্টার
বার্ট, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মন্ত্রী। বললেন,
'বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করে যুক্তরাজ্য। তিনি
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বললেন না বটে, কিন্তু সবার অংশগ্রহণমূলক
নির্বাচনের কথা বললেন। একটি সংলাপ হবে, এমনটাও আশা করলেন তিনি। কিন্তু ঘুরে
ফিরে সেই প্রশ্নই তো ফিরে আসছে_ সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা নিশ্চিত
করব কীভাবে?
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে যখন আমন্ত্রণ
জানান, ঠিক তখনই গত ৩১ জুলাই মির্জা ফখরুলসহ ৪৬ জন বিএনপির নেতা ও কর্মীর
বিরুদ্ধে ঢাকার দ্রুত বিচার আদালতে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সম্মুখে গাড়ি
পোড়ানোর মামলায় চার্জ গঠন করা হয়েছে। ৭ আগস্ট মামলার বিচার শুরু হবে।
অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা ৫ জন এমপিসহ বিরোধী দলের ৩৩ জন নেতাকর্মীকে জেলে
পাঠানো হয়েছিল। তারা পরে অবশ্য উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন। এখন চার্জ
গঠন করার ফলে মামলা চলবে। তাতে করে কী বিএনপিকে আস্থায় নেওয়া যাবে? এতে
করে দূরত্ব আরো বাড়বে। ঝুলে যাবে সংলাপ প্রক্রিয়া। এখন সংলাপ হবে, এ
বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে।
পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রণবিহীন। কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিক পেটানো থেকে শুরু করে
আদালতপাড়ায় তরুণীর শ্লীলতাহানি, বিচারক পেটানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ।
হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ ঘটনায় তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে
নির্দেশও দিয়েছিলেন। অতীতেও একাধিকবার আদালত পুলিশ কর্মকর্তাদের
চাকরিচ্যুতের নির্দেশও দিয়েছেন। ভর্ৎসনা করেছেন। তাতে কিছু একটা হয়েছে বলে
মনে হয় না। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে 'সার্টিফিকেট' দেন, যেখানে
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী 'সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার' উপদেশ
দেন, যেখানে অত্যন্ত ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব 'ষড়যন্ত্র'
আবিষ্কার করেন, সেখানে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা কী
ভুলে গেছি বহির্বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকলাপ মনিটর করা
হচ্ছে? অ্যালিস্টার বার্ট বলে গিয়েছিলেন তারা র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার
লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ করেছেন। লন্ডনের
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও
হেফাজতে নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকারবিষয়ক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির
তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আর সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের যে রিপোর্ট তা তো
আমাদের জন্য কোন আশার কথা বলে না। রাজনীতির বাইরেও অর্থনীতির যে সূচক,
তাতেও তো কোনো ভালো খবর নেই। গড়ভিত্তিক মূল্যস্ফীতি এখন ১০.৮৬ শতাংশ।
রফতানি আয় বৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪১.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে
মাত্র ৮.৪১ শতাংশ। অথচ আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১.২২ শতাংশ। টাকার মান কমেছে।
বাজেট পাস ও রমজানের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কোনো জিনিসের দাম
আবার বেড়ে গেছে। কুইক রেন্টাল নিয়ে 'নানা' কাহিনী। এ 'কাহিনী' সাধারণ মানুষ
জানে না। বোঝে না। কিন্তু মানুষ ইতিমধ্যে জেনে গেছে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে বিশ্বব্যাংক। মন্ত্রী পদত্যাগ
করেছেন। সচিব দীর্ঘ ছুটিতে গেছেন। কিন্তু তাতে করে কী কুল রক্ষা হবে? আদৌ
কী বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে পুনরায় এগিয়ে আসবে? মনে হয় না।
বিশ্বব্যাংকের নীতিতে এমনটি নেই। আর পদ্মা সেতু যদি নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে
না ওঠে, তাহলে দক্ষিণাঞ্চলে মহাজোটের জন্য খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। এখানে
সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান এক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এখন লন্ডনে
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্য ও বেগম জিয়ার ড্যাবের অনুষ্ঠানে দেওয়া
বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। অর্থাৎ 'টানেলের শেষে কোনো আলোর রেখা' দেখা যাচ্ছে
না। দুটি বড় দল তথা জোট পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। সমঝোতার কোনো
সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে এই যে একগুঁয়েমি, এই একগুঁয়েমি দেশটির
জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। আমরা একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য
নির্বাচন চাই। আর এই নির্বাচন আয়োজন ও সম্পন্ন করার ব্যাপারে সরকারের যেমনি
দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি দায়িত্ব রয়েছে। বিরোধী দলেরও।
Daily DESTINY
08.08.12
0 comments:
Post a Comment