সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ কি আসন্ন? ওআইসি থেকে সিরিয়ার বহিষ্কার এবং ওবামার হুমকির পর ঘুরেফিরে এখন এ প্রশ্নটিই পশ্চিমা বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে বেশি করে। লিবিয়ায় যেভাবে জাতিসংঘের কোনো অনুমতি ছাড়াই পশ্চিমা বিশ্ব সামরিক হস্তক্ষেপ করে গাদ্দাফিকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করেছিল, সিরিয়ায় এখন সে রকমই হতে যাচ্ছে। লিবিয়ার ক্ষেত্রে তথাকথিত মানবিক নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে লিবিয়ার জনগণের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন সিরিয়ার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, R2P or Responsibility to protect, অর্থাৎ \'নিরাপত্তার প্রশ্নে দায়িত্বশীলতার\' মডেল। যুক্তিটা হচ্ছে এই_ সিরিয়ার জনগণ আজ সরকারি বাহিনী কর্তৃক অত্যাচারিত (?)। তাদের রক্ষায় এ হস্তক্ষেপ অনিবার্য। লিবিয়ার ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছিল, ভাড়াটে সৈন্য ও প্রশিক্ষকদের দিয়ে একটি বিদ্রোহী সেনাবাহিনী গঠন করা এবং তাদের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সামরিক হস্তক্ষেপ_ সিরিয়ায়ও ঠিক তেমনটি ঘটেছে। একটি বিদ্রোহী \'সিরিয়ান ফ্রি আর্মি\' গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে লিবিয়ার ইসলামী বিদ্রোহীরা, উত্তর আফ্রিকার ভাড়াটে সৈন্যরা। এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে যে, মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ব্ল্যাক ওয়াটার বিদ্রোহী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাদের হাতে বিমান বিধ্বংসী MANPAD রকেটও ((Man Portable air defense system) পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে। এই MANPAD রকেট দিয়ে অতিসম্প্রতি বিদ্রোহীরা একটি বিমান ধ্বংসও করেছে।
স্পষ্টতই সিরিয়ার সংকট দেশটির অভ্যন্তরীণ ঘটনা। দেশটিতে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। গণতন্ত্র সূচকে দেশটির অবস্থান ১৫৩ (১৬৭টি দেশের মধ্যে)। আর দুর্নীতিতে দেশটির অবস্থান ১৭৮টি দেশের মধ্যে ১২৭। পিতার মৃত্যুর পর বাশার আল আসাদ ক্ষমতা নেন, আছেন ২০০০ সাল থেকেই। ধর্মনিরপেক্ষ বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। আর সেনাবাহিনী মূলত বাথ পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাশার আল আসাদের পিতা জেনারেল হাফিজ আল আসাদ ১৯৭১ সাল থেকে দেশটি শাসন করে আসছিলেন। সিরিয়ায় সুনি্ন মুসলমানরা (জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ) সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শাসন ক্ষমতায় এদের যেমন নেই কোনো প্রতিনিধিত্ব, ঠিক তেমনি নেই অংশগ্রহণও। আলওবি, যারা জনসংখ্যার মাত্র ৭ ভাগ, তারাই মূলত দেশটি শাসন করে আসছে কয়েক দশক ধরে। প্রেসিডেন্ট হাফিজ এই আলওবি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। এরা সুনি্ন মুসলমান নয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুনি্নদের একটা ক্ষোভ বরাবরই ছিল। কিন্তু অত্যধিক ক্ষমতাসম্পন্ন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে এই আলওবি গোষ্ঠী। সিরিয়ায় এ গৃহযুদ্ধের পেছনে কাজ করছে সুনি্নদের অসন্তোষ। এ অসন্তোষকেই কাজে লাগিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে স্পষ্টতই এর পেছনে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা। মধ্যপ্রাচ্যে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে উত্তর আফ্রিকায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে এ লক্ষ্য কিছুটা অর্জিত হয়েছে। অন্যদিকে বৃহত্তর \'ইউরো এশিয়া\' অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। এ অঞ্চলের বিপুল জ্বালানি সম্পদের রিজার্ভই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় আশঙ্কা_ চীন ও রাশিয়ার সমন্বয়ে ওই অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা \'সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)\' তার স্বার্থে আঘাত হানতে পারে। কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান এসসিওর সদস্য। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান ও মঙ্গোলিয়াকে এসসিওর অবজারভার স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। বেলারুশ আর শ্রীলংকা হচ্ছে ডায়ালগ পার্টনার। ন্যাটোর অব্যাহত সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে এসসিও আগামী দিনে একটি বড় ভূমিকা নিতে পারে, অনেকটা অধুনালুপ্ত ওয়ারশ সামরিক জোটের মতো। স্ট্র্যাটেজিক্যালি সিরিয়ার অবস্থান তাই মার্কিন সমরনায়কদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মিখাইল চসসুডোভস্কির (Michel chossudovsky) একটি মন্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি লিখেছেন, The war on Syria is part of an integrated worldwide military agenda. The road to Tehran goes through Damascuss, Iran, Russia, China & North Korea also being threatened. এটাই হচ্ছে আসল কথা। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ইরানে ইসলামপন্থিদেরও পতন ডেকে আনতে পারে। ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি স্ট্র্যাটেজি তো অনেক দিনের। বলা হচ্ছে, এই গ্রীষ্মে ইরান আক্রমণ করতে পারে মার্কিন ও ইসরায়েলি বিমান। ধ্বংস করে দিতে পারে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। আর তাই ইরান সিরিয়া সংকটে আসাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ যদি সিরিয়া ও ইরানে ইসলামপন্থিদের পতন ঘটে (?) তাহলে বৈরী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত উত্তর কোরিয়া ও চীনের ওপর যে \'চাপ\' আসবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে একটি অক্ষ গড়ে তুলেছে। ভারত মহাসাগরে চীনা কর্তৃত্ব খর্ব করতে যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে নানা উদ্যোগ।
সিরিয়া সংকটের সমাধান যদি পাওয়া না যায়, তাহলে R2P মডেলে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান অনিবার্য। সম্ভাব্য এ অভিযানকে অনেক বিশ্লেষক Soft invasion’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের একটি সামরিক অভিযানে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষের জন্ম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে সমর্থন করছে। তুরস্কে একটি ইসলামপন্থি সরকার থাকলেও দেশটি ন্যাটোর সদস্য। অভিযোগ আছে, MANPAD মিসাইল তুরস্ক বিদ্রোহীদের সরবরাহ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, সিরিয়া সীমান্ত থেকে ৬০ মাইল দূরে তুরস্কের আদানা শহর। সেখানে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করছে তুরস্ক। এমনকি আল কায়দার ঘাঁটি রয়েছে বলেও পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে। আল কায়দার যোদ্ধারা সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিশেষ করে আলেপ্পো শহর দখলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক সিরিয়ার সংকটকে Cold war style confrontation হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ ইউরোপে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘদিন যে \'যুদ্ধাবস্থা\' বিরাজ করছিল, সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে। ভুলে গেলে চলবে না, সিরিয়া ও ইরানে রাশিয়া এবং চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এ অঞ্চলের গ্যাস ও তেল উত্তোলনের সঙ্গে দেশ দুটি জড়িত। সিরিয়ার আস সুকনাহ (As-Suknah) দায়ার আজ জাওয়ার ((gazprom)) তেল ও গ্যাস উত্তোলন প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার সংস্থা গ্যাজপ্রম (মধুঢ়ৎড়স) জড়িত। হিম্স ও বানিয়াস শহরে রয়েছে রিফাইনারি। রাশিয়ার বড় বিনিয়োগ রয়েছে এ খাতে। সিরিয়ায় যে গ্যাস ও তেল উৎপাদিত হয় তার তিন ভাগের এক ভাগ উত্তোলিত হয় রাশিয়ার সাহায্যে। এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিন ভাগের এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাশিয়া। অন্যদিকে ইরানের বুশহের পারমাণবিক চুলি্ল রাশিয়ার সাহায্যে নির্মিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে আরও তিনটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে রাশিয়া। চীনের বিনিয়োগও প্রচুর। চীন ১২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ইরানের গ্যাস ও তেল উত্তোলন প্রক্রিয়ায়। বিশ্বের গ্যাসের মোট রিজার্ভের ১৫ ভাগ ও তেলের ১০ ভাগ রিজার্ভ রয়েছে ইরানে। সিরিয়ায় \'সরকার পরিবর্তন\'-এর স্ট্র্যাটেজিতে এই জ্বালানি স্বার্থর্ও কিছুটা ভূমিকা রাখছে। যারা Primakov Doctrine সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন এ অঞ্চলে সম্ভাব্য এক \'স্নায়ুযুদ্ধের\' ধারণা দেওয়া হয়েছিল অনেক আগেই। সুতরাং সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। কী হতে যাচ্ছে সিরিয়ায়, তা বলাটা অত সহজ নয়। অনেক কিছু ঘটতে পারে সিরিয়ায়। এক. আসাদের পতনের পর সৌদি আরব কিংবা কাতারের মডেলে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রটি ইসরায়েলের জন্য অত হুমকির হবে না এবং ইসরায়েলের সমর্থন থাকবে তাতে। দুই. লেবাননের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সিরিয়ায়, যেখানে হিজবুল্লাহর মতো যোদ্ধারা বিশেষ বিশেষ এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। তিন. সিরিয়া কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে। চার. ১৯২১ সালের চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক সিরিয়ায় সৈন্য পাঠাতে পারে। সুলাইমান শাহ জাদুঘর (অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান-১-এর দাদার মাজারে নির্মিত) রক্ষায় তুরস্ক এটা করতে পারে। Treaty of Ankara (তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যে) অনুযায়ী তুরস্কের এই অধিকার রয়েছে। সিরিয়া সংকটে তুরস্কের ভূমিকাকে কেউ কেউ New Ottoman সাম্রাজ্যের একটি প্রয়াস হিসেবে দেখছেন। কারও কারও মতে, ১৯১৬ সালের Sykes-Picot (অ্যাংলো-ফ্রান্স) চুক্তি আবার নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসছে। ইরান, ইরাক আর সিরিয়া দখলের বা নিয়ন্ত্রণের একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই সিরিয়া সংকট শুধু আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যাবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Daily SAMAKAL
0 comments:
Post a Comment