‘খাদের কিনারে প্রশাসন’Ñ এভাবেই যুগান্তরের শিরোনাম ছিল ২৯ জুলাই। যারা প্রশাসন নিয়ে কাজ করেন এবং প্রশাসনের অন্দরমহলের কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে প্রশাসনে অস্থিরতার খবর নতুন কোন বিষয় নয়। সরকারি পদে পদায়নের যেমনই কোন পরিকল্পনা নেই, ঠিক তেমনি নেই পদের হিসাবও। যেখানে মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি হওয়ার কথা, সেখানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে বিশেষ দল ও মতের প্রতি আনুগত্য। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রশাসনের শীর্ষপর্যায়ে বিরোধ এখন চরমে (যুগান্তর, ৫ আগস্ট)। সবচেয়ে যা বেশি ভয়ের তা হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের জন্য সুবিধা ও প্রমোশন বাগিয়ে নেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন। এর ফলে যারা সৎ ও ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন পদে পদে। কোথাও কোথাও তাদের প্রমোশন বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। এমনই এক প্রমোশনবঞ্চিত যুগ্ম সচিব মনোয়ার হোসেনের আÍহত্যার খবরও ছেপেছিল যুগান্তর ১৩ জুলাই। ’৮৩ ব্যাচের ওই কর্মকর্তা ওএসডি অবস্থায় ছিলেন দু’বছর, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। অথচ তার ব্যাচমেটরা অনেকেই সচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। প্রশাসনে এই যে অনিয়ম, এই অনিয়ম জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের এক ধরনের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। এ নিয়ে বেশকিছু লেখালেখি হলেও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে একটি নিয়মনীতির ভেতরে নিয়ে আসার কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক, অযোগ্য ব্যক্তি পদোন্নতি পাচ্ছেন এবং যোগ্যদের বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সরকারের উচ্চপর্যায়ের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের অভাবের ফলে জনপ্রশাসনে কাজের গতি আসছে না এবং ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ছে (যুগান্তর, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১)। ঢালাও পদোন্নতির ফলে জনপ্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা (আমার দেশ, ২৭ ফেব্র“য়ারি ২০১২)। ৮ ফেব্র“য়ারি জনপ্রশাসনে কেন্দ্রীয়র স্তরে বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদে ১২৭, যুগ্ম সচিব পদে ২৬৪ এবং উপসচিব পদে ২৫৮ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। মোট পদোন্নতি পেয়েছেন ৬৮১ জন। এ বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে বিদ্যমান বিধি-বিধানের অপব্যবহার করে এক অশুভ নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে (নয়া দিগন্ত, ১৫ ফেব্র“য়ারি ২০১২)। দুঃখজনক হচ্ছে, এটা করতে গিয়ে ৭০০-এর অধিক জ্যেষ্ঠ ও পদোন্নতির সব শর্ত পূরণকারী কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই ৮ ফেব্র“য়ারিকে অনেকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যে অভিযোগটি গুরুতর তা হচ্ছে, পিএসসি কর্তৃক নির্ধারিত জাতীয় মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী। পদোন্নতির জন্য আবশ্যক সিনিয়র স্টাফ কোর্স এবং উচ্চতর প্রশাসনিক ও উন্নয়নবিষয়ক কোর্স সম্পন্ন না করেই পদোন্নতি পেয়েছেন কয়েকজন। মজার ব্যাপার, শীর্ষপর্যায়ে পদোন্নতির জন্য ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন এমন অনেকে এই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডিগ্রি ‘ক্রয়’ করে তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন। অথচ ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। শুধু টাকার বিনিময়ে একখানা সার্টিফিকেট তারা সংগ্রহ করেছেন। নিয়মিত ক্লাস বা কোর্স ওয়ার্ক তারা করেননি। কেউ কেউ অনলাইনে একখানা পিএইচডি ডিগ্রি জোগাড় করে, তা ব্যবহারও করছেন। উচ্চতর ডিগ্রি পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি ভুয়া ডিগ্রি যখন জনপ্রশাসনের কেউ ব্যবহার করেন, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। যারা জনপ্রশাসনের শীর্ষে রয়েছেন, তারা আশা করছি, বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।
জনপ্রশাসনে এভাবে ঢালাও পদোন্নতি, যা কিনা ‘সুনামি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা আমাদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের কোন কারণ ছাড়াই বাদ দেয়া, পদের চেয়ে দ্বিগুণ কর্মকর্তা কিংবা যোগ্য কর্মকর্তাদের ওএসডি করা জনপ্রশাসনের জন্য কোন সুস্থ লক্ষণ নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ফেব্র“য়ারি (২০১২) পর্যন্ত ওএসডি হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৮৩৫ জন, আর তিন বছর ধরে আছেন ১২৩ জন। দুঃখজনক হলেও সত্য, গেল আড়াই বছরে ওএসডি অবস্থায় পিআরএলএ গেছেন ২২৭ জন কর্মকর্তা। কর্মহীন অবস্থায় পিআরএলে যাওয়ায় সহকর্মীদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেয়ারও সুযোগ তারা পাননি। সারাজীবন যিনি জাতির জন্য, রাষ্ট্রের জন্য শ্রম দিলেন, মেধা দিলেন, তাকে বাধ্য করা হল পিআরএলে যেতে ওএসডি থাকা অবস্থায়ই। সুষ্ঠু জনপ্রশাসনের জন্য এ ধরনের প্রবণতা কোন মঙ্গল ডেকে আনবে না। ইতিমধ্যে সচিবদের মধ্যে ৮টি সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে এক তুঘলকি কাণ্ড ঘটানো হয়েছে জনপ্রশাসনে।
এমনকি পুলিশের মহাপরিদর্শককে সিনিয়র সচিব পদ দিয়ে পুলিশ বিভাগে একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ‘সিনিয়র সচিব’ পদ সৃষ্টি কিংবা পুলিশ বিভাগের জন্য একাধিক সচিব পদ সৃষ্টি জনপ্রশাসনে শৃংখলা ও কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য আদৌ করা হয়নি। বরং বিশেষ ব্যক্তিকে খুশি করা, একই সঙ্গে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে দিয়ে সুবিধা আদায় করার নিমিত্তেই করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনে এই যে পদোন্নতি, তার কোন সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধু বিধিমালা দিয়েই চলছে গত ৪১ বছর। শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতির স্বার্থেই কোন আইন করা হয়নি। এখানে অভিযোগ উঠেছে, আইন প্রণয়ন না হওয়ায় শুধু ১৩৩ অনুচ্ছেদ নয়, সংবিধানের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদের নির্দেশনাও যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১০ সালে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট ২০১০ নামে একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পরে সরকারের উদ্যোগে গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িস অ্যাক্ট ২০১২ প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে আদৌ কোন অগ্রগতির খবর আমরা জানি না। অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি এক চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন এখন থেকে সচিবালয়ের সব নিয়োগ হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়। তিনি ‘আউট সোর্সিং’-এর মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন। এটা যদি কার্যকর করা হয়, তাহলে সচিবালয়ের শীর্ষপর্যায় থেকে নিুপর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হবে। এটা সুস্থ প্রশাসনের জন্য আদৌ কোন ভালো লক্ষণ নয়। পাক-ভারত উপমহাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশে সচিবালয়ে ‘আউট সোর্সিং’-এর মাধ্যমে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় না।
একটি দেশ ও সরকারের মস্তিষ্ক হল জনপ্রশাসন। এ জন্যই জনপ্রশাসনে যোগ্য লোকের দরকার। অযোগ্য, অদক্ষ ও মেধাহীন কর্মকর্তারা যদি দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি পান, তারা দরকষাকষিতে কোন যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারবেন না। ফলে বিদেশে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করতে তারা ব্যর্থ হবেন। এজন্য দরকার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ। এর ফলে প্রশাসনে এহেন বিড়ম্বনা অনেকটাই প্রশমিত হবে এবং প্রশাসনে অধিকতর গতিশীলতা আনা সম্ভব হবে। এছাড়া আন্তঃক্যাডার কলহ, বদলি আতংক, পদায়নবৈষম্য ইত্যাদি উপসর্গ দূর করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যদি দূর করা না যায়, তাহলে সেই প্রশাসন দিয়ে জাতির কোন মঙ্গল প্রত্যাশা করা যায় না।
আমরা সত্যিকার অর্থেই দক্ষ জনপ্রশাসন চাই। বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আইন, নিয়ম ও নেগোসিয়েশনের টেকনিক। এক্ষেত্রে আমাদের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের যোগ্যতা দেখাতে হবে। তারা যদি দক্ষ না হন, উচ্চশিক্ষিত না হন, তাহলে তারা নেগোসিয়েশনে তাদের যোগ্যতা দেখাতে পারবেন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ কিংবা পদোন্নতি বহিঃবিশ্বে আমাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে। পদোন্নতির জন্য প্রতিটি পদে লিখিত পরীক্ষা থাকতে হবে। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন, তারাই কেবল পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। রাজনৈতিক বিবেচনা বা বয়স কোন অবস্থায়ই পদোন্নতির মাপকাঠি হতে পারে না। একটি দেশ যদি দক্ষ জনপ্রশাসন কর্মী গড়ে তুলতে না পারে, সে দেশ কখনই উন্নতির শিখরে উঠতে পারবে না। আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার।
এমনকি ভারতের দৃষ্টান্তও আমরা দিতে পারি, যাদের কেউ কেউ আজ আন্তর্জাতিক আসরেও তাদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। আমরা ব্যর্থ হতে চাই না। আমাদের মাঝে অনেক তরুণ জনপ্রশাসন কর্মকর্তা রয়েছেন। সরকার তাদের বিদেশে ট্রেনিং ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এদের অনেকেরই কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু এরা যদি পদোন্নতি কিংবা পদায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন, তাহলে এদের মাঝে হতাশা কাজ করবে।
এরা তখন তাদের দক্ষতা দেখাতে পারবেন না। ‘খাদের কিনারে প্রশাসন’ প্রতিবেদনটি আমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এ থেকে যদি কিছুটা ‘শেখেন’, জনপ্রশাসনের জন্য তা হবে মঙ্গল।
Daily JUGANTOR
13.08.12
0 comments:
Post a Comment