বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে ন’টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় (১৯৮৬), চতুর্থ (১৯৮৮) ও ষষ্ঠ (১৯৯৬) সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি শুধুমাত্র একটি কারণেÑ আর তা হচ্ছে বিএনপি (তৃতীয় ও চতুর্থ) ও আওয়ামী লীগ (ষষ্ঠ) ওইসব নির্বাচনে অংশ নেয়নি। পরিসংখ্যান বলে আওয়ামী লীগ ৭৩.২০ ভাগ (১৯৭৩), ২৭.৩৪ (মালেক-মিজান গ্রুপ ১৯৭৯), ৩০.০৮ ভাগ (১৯৯১), ৩৭.৪৪ (১৯৯৬), ৪০.১৩ ভাগ ও ৪৮.০৬ ভাগ ভোট পেয়েছিল। অন্য দিকে বিএনপি পেয়েছে ৪১.১৭ ভাগ (১৯৭৯), ৩০.৮১ ভাগ (১৯৯১), ৩৩.৬১ ভাগ (১৯৯৬), ৪০.৯৭ ভাগ (২০০১) ও ৩২.৩৫ ভাগ ভোট (২০০৮)। প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় এই দুটো দলের বাইরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অন্য কোনো দলের কোনো সুযোগই নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ একটি ধারা থাকবে, তারা কখনই মূল ধারায় আসতে পারবে না। তবে মূল ধারার সহযোগী মিত্র হিসেবে কাজ করবে। আজ তাই নয়াদিল্লি থেকে ফিরে এসে এরশাদ যখন বলেন, তিনি একটি তৃতীয় ধারার নেতৃত্ব দিতে চান, তখন বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে থাকেন তিনি। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে বটে, কিন্তু দলটি জাতীয় পর্যায়ের একটি দলে এখনও পরিণত হতে পারেনি। দলটি মূলত একটি আঞ্চলিক দল। দলটির ক্ষমতা ওই উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুরেই সীমাবদ্ধ। তার আর্থিক ভিত্তির কারণেই, এরশাদ এখনও দলটিকে ধরে রাখতে পেরেছেন। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে, নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিনি হেলিকপ্টার ক্রয় করবেন। গত ২৫ আগস্ট (সকালের খবর) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটির পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, আমি জানি না। কিন্তু দল হিসেবে জাতীয় পার্টি তেমন বড় একটি দল নয়। দলটির আর্থিক ভিত্তিও তেমন নেই। তাহলে হেলিকপ্টার কেনার পয়সা যোগাবে কে?
ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। ভারতের সাথে আমাদের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, যা অমীমাংসিত। তিস্তার পানি বণ্টন, ছিটমহল বিনিময় ও বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ব্যাপারে ভারত আন্তরিক না হলেও ভারত বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের কাছ থেকে ট্রানজিট সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের বিষয়টিও সময়ের ব্যাপারমাত্র। এখন আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে নয়াদিল্লি যদি জাতীয় পার্টিকে চিন্তা করে থাকে, তাহলে নয়াদিল্লি ভুল করবে। এরশাদ সাহেব নয়াদিল্লিতে যাদের সাথে কথা বলেছেন, তাদের মাঝে একজন হচ্ছে শিবশঙ্কর মেনন, যিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। শিবশঙ্কর মেননের সাথে এরশাদের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নই। তবে ওই বৈঠকটি যে তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
নয়াদিল্লির নীতি নির্ধারকদের বুঝতে হবে বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বই সমাধান করবেন। এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এর সমাধান বাইরে থেকে আসবে না এবং তারা কোনো সমাধানও দিতে পারবেন না। আমরা আমাদের রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থাশীল। তারা নিশ্চয়ই একটা সমাধান বের করতে পারবেন এবং সকলের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়েই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হবে। বিএনপি তথা ১৮ দল মূলত একটি দাবিকেই সুস্পষ্ট করেছেÑ আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করা। বিদেশী দাতাগোষ্ঠীও প্রত্যাশা করছেন আগামী নির্বাচন সম্পন্ন হবে সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি আসে, তা হচ্ছে বিএনপিকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনের আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে কি না? আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখবো এরশাদের শাসনামলেই ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ তৃতীয়, চতুর্থ এবং ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সব নির্বাচনের একটিও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টি উপলব্ধি করেন, তাহলেই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। এরশাদ ফিরে এসে অনেক কথাই বলছেন বটে (‘একক নির্বাচনে ভারতের সমর্থন রয়েছে’) কিন্তু এর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। তার এই বক্তব্য তার দলের দৈন্য প্রকাশ করে মাত্র। নির্বাচন করবেন তিনি বাংলাদেশে। আর প্রত্যাশা করবেন জনগণের সমর্থন। এটা নিশ্চিত করতে তিনি দিল্লি যাবেন কেন? তার এই দিল্লি সফর তাঁকে বিতর্কিত করেছে মাত্র। তিনি যদি মনে করে থাকেন, দিল্লির পরামর্শ নিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন, তাহলে তিনি ভুল করেছেন। উত্তরবঙ্গের মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবার।
এরশাদের হাইপ্রোফাইল দিল্লি সফর ভারতীয় সংবাদপত্র মাধ্যমে গুরুত্বসহকারে দেখা গেলেও বাংলাদেশের জনগণের কাছে এর কোনো আবেদন নেই। শুধু এরশাদ একাই নয়, সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনই প্রত্যাশিত। ভারতের নীতিনির্ধারকরা যদি এই মতটি অনুসরণ করেন, তাহলে তারা ভালো করবেন।
0 comments:
Post a Comment