রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ত্রিশ হাজার কোটি রুপির গণতন্ত্র!

ভারতে সদ্যসমাপ্ত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অতীতেও বিজেপি দুই-দুইবার ক্ষমতায় ছিল। একবার ১৯৯৬ সালে, মাত্র ১৩ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। দ্বিতীয়বার ১৯৯৮ সালে। অটল বিহারি বাজপেয়ি এবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৫ বছর ৬৪ দিন। তারপর পরপর দুই টার্ম কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার দিলি্লর ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। ২০১৪ সালে এসে বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলো। কিন্তু এবারকার বিজয় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ১৯৮৪ সালে মাত্র দুটি আসন পেয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে যাত্রা শুরু করেছিল বিজেপি। আর আজ বিজেপির আসন ২৮৩টি, জোটগতভাবে এনডিএর আসন ৩৩৭টি। কংগ্রেসের আসন নেমে এসেছে মাত্র ৪৩টিতে, আর জোটগতভাবে ইউপিএর আসন মাত্র ৫৮টি। কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কেননা, আঞ্চলিক দলগুলোর মোট আসন ১৪৪টি, যার মধ্যে এআইএডিএমকে (জয়ললিতা, তামিলনাড়ু) এবং তৃণমূল কংগ্রেসও (৩৪টি, পশ্চিমবঙ্গ) রয়েছে। এখন আঞ্চলিক দলগুলোর একটি তৃতীয় জোট আবদ্ধ হলে কংগ্রেস আর বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে না। দ্বিতীয় যে রেকর্ডটি সবাইকে আকৃষ্ট করেছে, তা হচ্ছে, বিপুল সংখ্যক সিনেমা অভিনেতা লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী। তারা এবার রেকর্ড করেছেন। তাদের কাউকে কাউকে যদি মন্ত্রিসভায় দেখা যায়, আমি অবাক হবো না। হেমা মালিনী কিংবা শত্রুঘ্ন সিনহার মতো অভিনেত্রী-অভিনেতার বিজয় দলের মর্যাদা কতটুকু বাড়াবে, বলতে পারব না। নিঃসন্দেহে তারা লোকসভার সৌন্দর্য বাড়াবেন। মি. সিনহা এর আগে বিজেপি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এবারো তিনি মন্ত্রী হতে পারেন। তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি এবার রেকর্ড করেছে, তা হচ্ছে, নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়। একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার মতে, দলগুলো এবার নির্বাচনে (প্রচারণা, ভ্রমণ ইত্যাদি) ব্যয় করেছে ৩০ হাজার কোটি রুপির মতো। বিজেপি ব্যয় করেছে সবচেয়ে বেশি_ ১০ হাজার কোটি রুপি; কংগ্রেসের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আর প্রার্থীদের নিজস্ব ব্যয়ের হিসাব যদি ধরা হয়, তাহলে এই অর্থের পরিমাণ লক্ষ কোটি রুপির অঙ্ককেও ছাড়িয়ে যাবে। এর ওপর রয়েছে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ব্যয়। প্রধান সমস্যা, সেখানে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা শুধু নির্বাচনের মতো অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়, তখন সঙ্গত কারণেই ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। কেননা, নির্বাচনে খরচ করা এই টাকার কোনো 'রিটার্ন' নেই। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা যেত। কয়েকটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। তবে বোম্বে চলচ্চিত্রের চাকচিক্যময় জীবন থেকে ভারতের দারিদ্র্য বোঝা যাবে না। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪ সালে যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২৭ দশমিক ৫ ভাগ (৪১ কোটি), ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ০২ ভাগে (প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ২৫ ডলার হিসাবে)। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের দুই ভাগ বাস করে ভারতে। প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায়। ১৮ লাখ শিশু ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। এই দারিদ্র্যের হার বেশি মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে। যেখানে শিশু মৃত্যুর হার কেরালায় প্রতি ১ হাজারে মাত্র ১৪টি, সেখানে মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৯২ ও ৯১। অনেকে স্মরণ করতে পারেন, এই দুটি রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়েই রাজনীতি করেন মায়াবতী (বহেনজি) আর মুলায়ম সিং যাদব। মায়াবতী নিজে দলিত। আর দলিতদের রানী তিনি। এই দলিত শ্রেণিই তার ক্ষমতার উৎস। বিশাল এক আর্থিক সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছেন এই দলিত শ্রেণিকে সামনে রেখেই এবং তাদের ব্যবহার করে। ভারতের বর্তমান লোকসংখ্যা ১২০ কোটি। কিন্তু ২০৩০ সালে এই জনসংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো টয়লেট নেই। ২০১১ সালে একটি পরিসংখ্যান ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ভারতের ৫৩ ভাগ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ৪৭ ভাগ মানুষের টিভি আছে, আর ৯ ভাগ মানুষের রয়েছে কম্পিউটার। কিন্তু ৫৩ ভাগ মানুষের কোনো টয়লেট নেই। ৩৯ ভাগ মানুষের নেই কোনো 'কিচেন'। আর ৫৭ ভাগ মানুষের অভ্যন্তরীণ কোনো সূত্র থেকে সুপেয় পানি পাওয়ার সুবন্দোবস্ত নেই। অথচ সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ না বাড়িয়ে ভারত সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে। আবারো একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। সিপরির গবেষণামতে, ভারত এখন বড় অস্ত্র ক্রেতা দেশ। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভারতে অস্ত্র সরবরাহ বেড়েছে ৯ ভাগ হারে। ২০১৫ সাল নাগাদ ভারত সামরিক খাতে খরচ করবে ৮০ মিলিয়ন ডলার। অস্ত্র খাতে ভারত এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, কিন্তু প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি ভারত। কন্যাশিশুরা এখনো পরিবারের বোঝা। কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার কাহিনী একাধিকবার বিদেশের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ভারতে ৮০ কোটি মানুষের দৈনিক আয় এখনো আড়াই ডলারের নিচে। ৭০ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে থাকে। জেন্ডার সমতার দিক থেকে বিশ্বের ১৮৬টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৩৬ (বাংলাদেশের ১৪৬)। ভারতে নারীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। গোহাটির রাস্তায় অসহায় নারীর বস্ত্র হরণের কাহিনী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল কিছুদিন আগে। রুমি নাথ নামের এক সাংসদের কাহিনী কিংবা বোম্বের এক তরুণীর বাসে গণধর্ষণের কাহিনী প্রমাণ করেছিল, নারীরা সেখানে কতটা অসহায়। নারীদের এই অসহায়ত্ব নিয়েই উত্তর প্রদেশে জন্ম হয়েছিল গুলাব গ্যাংয়ের। ২০০৬ সালে সম্পাত পাল দেবী বুন্দেলখ- গ্রামে মহিলাদের সংগঠিত করে জন্ম দিয়েছিলেন গুলাব গ্যাংয়ের। তারা সবাই গোলাপি শাড়ি পরে নিজেরাই বিচারকার্য করতেন। তাই তাদের নাম হয়েছিল গুলাব গ্যাং। স্থানীয় পুলিশ আর পুরুষশাসিত সমাজে মহিলারা ছিল অসহায়। তাই তারা নিজেরাই গড়ে তুলেছিল একটি 'মহিলারক্ষী বাহিনী'। যারা সিনেমার দর্শক, তারা জানেন, বুন্দেলখ- গ্রামের সম্পাত পাল দেবীর কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমা গুলাবি গ্যাং। মাধুরী দীক্ষিত অভিনয় করেছেন সম্পাত পাল দেবীর চরিত্রে। রাজস্থানের মরুভূমিপ্রধান এলাকায় মহিলারা এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন। রাষ্ট্র তাদের নূ্যনতম চাহিদা নিশ্চিত করতে পারেনি দীর্ঘ ৬৭ বছরেও। তাই অমর্ত্য সেন স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন, সামাজিক খাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। ভারতের এই যে সামাজিক অবস্থান, সেখানে কিনা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই খরচ করছে প্রায় ১০ হাজার কোটি রুপি কিংবা তার চেয়েও বেশি। অথচ একজন অর্থনীতিবিদ হিসাব করে বলতে পারেন, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে কত শত কন্যাশিশুকে স্কুলে পাঠান যেত, কত হাজার মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেত। কিংবা গ্রামীণ দারিদ্র্য কমানো যেত। ভারতের নির্বাচনের একটি ভালো দিক হচ্ছে, সেখানে জনগণই সরকারের পরিবর্তন ঘটায়। আমাদের দেশের মতো 'ভোট ডাকাতি' সেখানে হয় না। কিংবা বড় দলকে বাদ দিয়েও সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। মাত্র তিনজন নির্বাচন কমিশনার এই নির্বাচনী কর্মকা- পরিচালনা করেন। সাম্প্রতিককালে এই নির্বাচনে টাকাওয়ালাদের ভিড় বেড়েছে। শত কোটি রুপির মালিক, এমন লোকও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, যার সংখ্যা শতের ওপরে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে আম আদমি পার্টি এবং কেজরিওয়াল আলোচনার ঝড় তুললেও তার নিজ দলের প্রার্থী তালিকায় কোটিপতির সংখ্যা অনেক। ভারতে এই নির্বাচন আজ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কোটিপতি ব্যবসায়ীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়েছে। ফলে ষোড়শ লোকসভায় কর্পোরেট হাউসগুলোর প্রতিনিধিদের সংখ্যা বাড়বে। সত্যিকার অর্থে, জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এর ফলে দুর্নীতির মাত্রা আরো বাড়বে। এবার শোবিজের জড়িতদের সংখ্যাও বেড়েছে। তারা লোকসভার সদস্য পদকে ব্যবহার করবে তাদের স্বার্থে। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন এতে পিছিয়ে পড়বে। এবার আঞ্চলিক দলগুলোর গুরুত্ব বাড়বে। সরকার গঠনে তাদের প্রয়োজন পড়বে না, কিন্তু স্থিতিশীলতার স্বার্থে তাদের সহযোগিতা দরকার। দীর্ঘদিন পর হিন্দুত্ববাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নির্বাচনের পর এর একটা প্রভাব থাকবে। রাহুল গান্ধীর জন্য এই নির্বাচন ছিল তার নেতৃত্বের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত সোনিয়া গান্ধীকে এখন মনমোহন সিংয়ের মতো বিকল্প একজন 'নেতা' খুঁজে বের করতে হবে। প্রিয়াংকা গান্ধী এই মুহূর্তে কংগ্রেসের শীর্ষ কোনো পদে নেই। এখন সম্ভবত প্রিয়াংকাকেই কংগ্রেসের হাল ধরতে হবে। প্রিয়াংকাই হতে পারেন তার দাদীর (ইন্দিরা গান্ধী) উত্তরসূরি। পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পারিবারিক রাজনীতির ধারা আরো শক্তিশালী হলো। বিজেপি 'হিন্দুত্ববাদ'কে পুঁজি করলেও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভারতীয় গণতন্ত্র সারা বিশ্বের স্বীকৃতি পেলেও এই গণতন্ত্র বেশি মাত্রায় পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়েছে। কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত হতে যাচ্ছে ভারতের লোকসভা। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, ভারতের মানুষ একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই পরিবর্তন সাধিত হলো। নরেন্দ্র মোদি নিজেকে বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তার যোগ্য নেতৃত্ব এবং তার অর্থনৈতিক মডেলে সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে। এক ধরনের 'পপুলিজম'-এর তিনি জন্ম দিয়েছেন। এ কারণে দেখা যায়, রাহুল গান্ধীও তার কাছে মস্নান হয়ে গেছেন। তবে তার সামনের পথগুলো খুব মসৃণ হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন হবে বলেও মনে হয় না। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি বিষয় যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থেকে যাবে। মোদির অগ্রাধিকার তালিকায় বাংলাদেশ থাকবে না। বরং চীন ও যুক্তরাষ্ট্র হবে তার অগ্রাধিকার তালিকায় প্রধান পছন্দ। বিনিয়োগ বাড়িয়ে তিনি তার উন্নয়ন মডেলকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইবেন। তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরি ও দারিদ্র্য বিমোচন তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। তবে কাজটি তার জন্য সহজ নয়। বহির্বিশ্বে তার ইমেজ ভালো নয়। মোদি বিজয়ী হয়েছেন সত্য, কিন্তু এই আস্থা তিনি কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। Daily JAI JAI DIN 19.05.14

0 comments:

Post a Comment