রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ও সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর

বহুল আলোচিত প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সফল হলো, নাকি ব্যর্থ হলো? চীন সফরের ওপর ১৪ জুন ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা তার নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরের সময় ৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু বহুল আলোচিত সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। অথচ বাংলাদেশের জন্য এই চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, এ অঞ্চলের উন্নয়নে প্রস্তাবিত এই সমুদ্রবন্দরটি একটি বড় অবদান রাখতে পারত। বিশেষ করে নয়া অর্থনৈতিক করিডোর বিসিআইএমের যে ধারণার জন্ম হয়েছে, তাতে করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে এই গভীর সমুদ্রবন্দর বড় অবদান রাখতে পারত। এখন এ সম্পর্কে কোনো চুক্তি না হওয়ায় বিশাল এক সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা এলো। আমার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টি অগ্রাধিকার তালিকায় এক নম্বরে ছিল। বাকি যেসব বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। বিশেষ করে একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, চীনের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, জাতীয় আইসিটি নেটওয়ার্কের আওতায় ইউনিয়ন পর্যন্ত সরকারি দফতরকে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, রাজশাহী পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর ওপর দ্বিতীয় রেল ও সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি চুক্তির গুরুত্ব থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। তবে আশার কথা, চীন ও বাংলাদেশ এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। যতটুকু জানা যায়, চীন সরকার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে নমনীয় ঋণ বা প্রিফারেন্সিয়াল বার্য়াস ক্রেডিট না দিয়ে বাণিজ্যিক ঋণ দিতে আগ্রহী। এ কারণে সমঝোতা চুক্তিতে ঋণের ধরন উল্লেখ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে চীন সরকার। বলা ভালো, প্রিফারেন্সিয়াল বার্য়াস ক্রেডিট সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয় ডলারে। অন্যদিকে, নমনীয় ঋণ বা জিসিএলের ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হয় দৈনিক মুদ্রা আরএমপিতে। উভয় ক্ষেত্রে সুদের হার ২ শতাংশ, সেই সঙ্গে দশমিক ০২ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা ফি দিতে হয়। তুলনামূলক বিচারে বাণিজ্যিক ঋণের সুদের হার বেশি, ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ডিজাইন, নির্মাণ ও বন্দর পরিচালনার ব্যাপারেও দু'পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশ বন্দর পরিচালনার ভার অন্য কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চীন সরকার এটি পেতে চায়। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী, তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এই নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো তখন এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইউইউএস (কনটেইনার টার্মিনাল) কনটেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেকগুলো বিষয় দেখার রয়েছে। এক. বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। কেননা চীনারা এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। একটি হামবানতোতায়, অপরটি কলম্বোতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হামবানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একট শহর, সেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জম্মস্থান এখানে। চীন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হামবানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হামবানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। আগামী ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই এখানে 'মেগা শিপ' অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। দুই. বন্দর পরিচালনা কার হতে থাকবে_ এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব, শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা ১০০ ভাগ মালিকানাই চীনাদের হাতে। এক সময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চীনাদের হাতে রয়েছে পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘি্নত না হয়, তাহলে চীনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চীনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চীনারা। সুতরাং তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা একটা সমঝোতায় পেঁৗছব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের কর্মকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই বন্দর দিয়েই তাদের আমদানি-রফতানি পরিচালনা করতে পারবে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় যে ৫০ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে এই বন্দর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। এমনকি চীনেরও স্বার্থ রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ইউনান প্রদেশ তাদের অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য এই বন্দরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে রফতানি করতে পারবে। এতে তাদের অর্থ ও সময় বেঁচে যাবে। কেননা এখন ইউনান সাংহাই বন্দর ব্যবহার করে, কুনমিং থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৮৮০ কিলোমিটার। অথচ কুনমিং থেকে সোনাদিয়ার দূরত্ব বাড়বে মাত্র ৪৮০ কিলোমিটার। কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি মহাসড়ক নির্মাণের ব্যাপারে চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নীতিগতভাবে রাজি। এ প্রকল্পে কাজও কিছুটা এগিয়েছে। প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হলে তা কুনমিংয়ের সঙ্গে এই সড়ককে সংযুক্ত করবে। এই সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩০ কিলোমিটার ও এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৩৩ কোটি টাকা। ২০০৪ সালের ৫ এপ্রিল মিয়ানমারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থিন নিয়ন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় কক্সবাজারের রামুতে এই মৈত্রী সড়কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এই ১৩০ কিলোমিটার সড়ক তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে ১৪টি ছোট-বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে। এসব সেতু নির্মাণ করা হলে ইয়াঙ্গুন, থাইল্যান্ডসহ চীনের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ হবে। তবে মিয়ানমারের আগ্রহ এ ক্ষেত্রে কম। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই মৈত্রী সড়ক নিয়ে দু'পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের পাশাপাশি চীনাদেরও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে এই সমুদ্রবন্দরটির ব্যাপারে। সাধারণত এ ধরনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনাদের স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট কাজ করে। গাওদারে চীন গভীর সমুদ্রবন্দরটি আরও উন্নত করেছে। বিনিয়োগ করেছে। কারণ এই পোর্টের মাধ্যমে চীন গালফের তেল তার পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যেতে চায় (দুবাই-গাওদার-উরমকি)। আর এ জন্য পাকিস্তানের কারাকোরাম পার্বত্যাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চীন তেলের পাইপলাইন নির্মাণ করছে। উরমকি পর্যন্ত এই পাইপলাইনের দূরত্ব হবে মাত্র ৩৬০০ কিলোমিটার। আগে চীনকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে (দুবাই-সাংহাই-উরমকি) পশ্চিমাঞ্চলে তেল নিতে হতো। তখন তারা সময় বাঁচাবে। ঠিক একই ধরনের স্বার্থ রয়েছে সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে। ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত তেলের পাইপলাইন তারা নিয়ে যাবে সোনাদিয়া দিয়ে। সুতরাং চীনের স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত চীনের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন। এ বছরই চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসছেন। তখন যাতে চুক্তিটি হয়, সে লক্ষ্যে এখন এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের আপত্তি এতে থাকবে না। ভারতও চাইবে এই বন্দরের ব্যবহার। Daily SAMAKAL 18.06.14

0 comments:

Post a Comment