রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পদ্মার ইলিশ আর ‘জামদানি কূটনীতি’র কাহিনি

পশ্চিমবঙ্গে পদ্মার ইলিশের একটা বড় চাহিদা রয়েছে, এটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি। এই পদ্মার ইলিশ একাধিকবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যখনই দিল্লি গেছেন, সঙ্গে গেছে পদ্মার ইলিশ। সেই সঙ্গে মিষ্টি, দইও গেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়। আবার চালু হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজে পদ্মার ইলিশের ভক্ত। তিনি তো একাধিকবার দাবি করেছেন, ইলিশ রপ্তানি বাড়ানো হোক। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে ঢাকা শহরে পদ্মার ইলিশ পাওয়াই এখন দায়। ইলিশ চলে যায় চোরাইপথে। সেই ইলিশ আবার আলোচনায় এল ভারতের নয়াপররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের প্রাক্কালে। ঢাকায় আসার আগে সুষমা ফোন করেছিলেন ‘তার মমতাদি’কে। পরিচয়টা অনেক পুরনো। বয়সে মমতা ছোট হলেও এক সময় দুজনই এনডিএ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এখন দুজনার পথ দুদিকে। তাতে কী? মোদি সরকারের এখন প্রয়োজন মমতাকে। বাংলাদেশ বলে কথা। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হলে মমতা একটা ফ্যাক্টর। তিস্তার পানি বণ্টন, বাংলাদেশের যা এক নম্বর এজেন্ডা, তাতে আবার মমতা ব্যানার্জির আপত্তি। সুষমার ফোনটা তাই জরুরি ছিল। সুষমা মমতার মনোভাব জানেন। উদ্দেশ্য হয়তো ছিল তিস্তা নিয়ে কথা বলবেন। মমতা সেই সুযোগ দিলেন না। বললেন, ঢাকায় যেন সুষমা পদ্মার ইলিশ চেখে আসেন! সংবাদটা আমাদের দিয়েছিল আনন্দবাজারই। এরপর সুষমা স্বরাজ ঢাকা এলেন। ৪০ ঘণ্টা থাকলেন। সরকারি দাওয়াতে ইলিশ অবশ্যই ছিল। কিন্তু মমতার মতো মাছে-ভাতে বাঙালি নন সুষমা স্বরাজ। হরিয়ানায় তার জন্ম। মাছভক্ত নন খুব স্বাভাবিক কারণেই। সেই ইলিশ মাছ তিনি চেখে দেখেছেন কি না বলতে পারব না। কোনও সংবাদপত্র অবশ্য আমাদের এ তথ্যটি দেয়নি। কিন্তু সব সময়ে শাড়িপরুয়া সুষমা স্বরাজের ভাগ্যে জুটেছে ৭টি জামদানি। এর পাঁচটি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং, আর দুটি দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। আমাদের নারী নেতৃত্ব তো তিনজন। ভাগ্য খারাপ এরশাদের। তিনি এখন সাইডলাইনে। নেতৃত্ব ‘হাইজ্যাক’ হয়ে গেছে। মূল নেতা এখন রওশন। তিনি এখন সংসদে বিরোধী দলনেত্রী! সংবাদপত্রগুলো অবশ্য আমাদের জানায়নি, রওশন কী দিয়েছেন সুষমাকে। কিছু একটা তো দিয়েছেনই! ভারতের এক সংবাদপত্র আবার লিখল ‘জামদানি কূটনীতি’। এখন প্রশ্ন একটাই- এই জামদানি কূটনীতিতে আমরা কী পেলাম? বাংলাদেশিরা অতিথিকে সম্মান দিতে জানে। যখনই কোনও অতিথি এসেছেন, তাকে উপহার সামগ্রী দিতে আমরা কার্পণ্য করিনি। আর ভারত বলে কথা! সুষমা স্বরাজ তো ক্যাবিনেটের দুই অথবা তিন নম্বর ব্যক্তি। তাকে বাংলাদেশ অস্বীকার করে কীভাবে? কিন্তু সুষমা স্বরাজের সফরে ফলটা কী? আমরা কী পেলাম? ভারতই বা কী পেল? অনেকগুলো সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি এই সফরের পর। এক. ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ যে তাদের বৈদেশিক নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে, তা কার্যত ভারত স্বীকার করে নিল। দুই. ভারত ‘জি টু জি’ সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। অর্থাৎ ‘সরকার টু সরকার’ সম্পর্ক। কোনও বিশেষ দলকে তারা সমর্থন করবে না। তবে ভারতের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন করেছিল ভারতীয় কংগ্রেস। এ ক্ষেত্রে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অতীতে কংগ্রেস-আওয়ামী লীগ সম্পর্ক থেকে কোনও পার্থক্য থাকবে না। তিন. বিজেপি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে তাদের বৈদেশিক নীতিতে অন্যতম এজেন্ডাভুক্ত করেছে। ভুটান সফরের পর প্রকাশিত যৌথ ইশতেহার পর্যালোচনা করলে এই নিরাপত্তার বিষয়টি বোঝা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্কের প্রশ্নে এই নিরাপত্তা ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে। বিশেষ করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অংশগ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় চীনের ভূমিকা ভারতের নিরাপত্তাকে বিঘœ করবে কি না, এটা ভারত নিশ্চিত হতে চায়। চার. এক মাস যে সরকারের বয়স, সেই সরকার হুট করে কোনও চুক্তি করতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারকে বোঝার প্রয়োজন রয়েছে তাদের। সুষমা স্বরাজ সে কাজটিই করেছেন। পাঁচ. তার সফরে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোনও কমিটমেন্ট পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে আশ্বাস। এ ধরনের আশ্বাস আমরা অতীতেও পেয়েছি। ছয়. ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস চালুর সিদ্ধান্ত, মৈত্রী এক্সপ্রেসের ট্রেন সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন ৪টি বর্ডার হাট চালু কিংবা ৬৫ বছরের বেশি ও ১৩ বছরের কম বয়সীদের ৫ বছরের মাল্টিপল ভিসা ইস্যুর যে নীতিগত সিদ্ধান্ত, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ খুব বেশি রক্ষিত হয়নি। সাত. তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে কোনও ‘কমিটমেন্ট’ নেই। সীমান্তহত্যা বন্ধে কোনও পদক্ষেপ নেই। অন অ্যারাইভাল ভিসা প্যাকেজ ঘোষিত হয়নি। অশুল্ক বাণিজ্য বাধা অপসারণে কিছু হয়নি। ভারতে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল প্রচারে কোনও উদ্যোগের কথা বলে যাননি সুষমা। এগুলো সবই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল। আট. খালেদা-সুষমা বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল মোদি সরকার খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর বলে মনে করে। এমনকী খালেদা জিয়া স্বপ্রণোদিত হয়ে যে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করার মধ্য দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর তা বিএনপি স্বীকার করে নিয়েছে। নয়. যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, প্রতিটি দেশ বাংলাদেশে ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা বলেছে, সেখানে সুষমা স্বরাজ এ ধরনের কোনও কথা বলেননি। বরং বলা হয়েছে, ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান জনগণকেই করতে হবে।’ এতে করে সরকারের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থনই প্রকাশ পায়। দশ. ‘দেশে কোনও গণতন্ত্র নেই’- বেগম খালেদা জিয়ার এ ধরনের উক্তির একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এ রকম- বিএনপি চায় ভারত বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুক! সরকারি দলের পক্ষ থেকে এ রকম একটি অভিযোগই উঠেছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি দৈন্য। আমরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারি না। আমাদের দারস্থ হতে হয় বিদেশিদের কাছে। এবারই যে এ রকমটি হল তা নয়। এর আগেও হয়েছে। এগারো. সুষমার এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনার নয়াদিল্লি সফর নিশ্চিত হল। এটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বার. সুষমার এই সফর বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য কোনও মেসেজ নেই। বেগম জিয়া ইতোমধ্যে কোরবানির পর-পরই আন্দোলনের কথা বলেছেন। ফলে বছর না ঘুরতেই হয়তো আমরা আবারও ‘হরতালের রাজনীতি’ প্রত্যক্ষ করব।এক কথায় সুষমা স্বরাজের এই সফরের মধ্য দিয়ে বড় কিছু অর্জিত হয়নি। আগামী ৫ বছর বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে। অর্থাৎ ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই সময়সীমায় তিস্তা চুক্তি হবে কিংবা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধন হবে, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। তিস্তার পানি-বণ্টন পশ্চিমবঙ্গে একটি রাজনৈতিক ইস্যু। মমতা ব্যানার্জি এটা হাতছাড়া করতে চাইবেন না। কেননা ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। নির্বাচনে পানি বিষয়টি তিনি দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবেন। আর সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আসাম বিজেপি। সুতরাং বিজেপির পক্ষে এটি রাজ্যসভায় পাস করিয়ে আইনে পরিণত করা সহজ হবে না। একই সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো কিংবা সীমান্তহত্যা বন্ধের বিষয়টি একান্তই মানসিকতার ব্যাপার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। ফলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ (সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং) সীমান্তে হত্যাকা- হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও হত্যাকা- হচ্ছে। কাজ হচ্ছে না। তবে একটা কথা এখানে বলা দরকার। সুষমা স্বরাজকে যে সম্মান বাংলাদেশ দিয়েছে, তাতে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আরও ইতিবাচক হওয়া। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলা যাবে এই খাদ্যশস্য। এর জন্য রাস্তাঘাট ও ব্রিজও বাংলাদেশ তৈরি করে দেবে। বাংলাদেশের এই ‘উদ্যোগ’-এর প্রতিদান হিসেবে ভারত আমাদের কী দেবে, সেটাই দেখার বিষয় এখন। বাংলাদেশ শুধু দেবে, আর ভারত তার স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে, এই মানসিকতায় ভারতের নেতৃবৃন্দ যদি পরিবর্তন না আনেন, তাহলে দুদেশের সম্পর্ক উন্নত হবে না। সুষমা স্বরাজ চলে গেছেন। কিন্তু জয় করে যেতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। Daily Amader Somoy 01.07.14

0 comments:

Post a Comment