রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সফরে চীন গিয়েছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করার পরও তিনি চীনে গিয়েছিলেন। তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর তিনি আবারও চীনে গেলেন। ধারণা করা হচ্ছে, ছয়টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হতে পারে। এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তি। এর বাইরে পদ্মা বহুমুখী সেতু, যমুনা নদীর ওপর দিয়ে বঙ্গবন্ধু রেল ব্রিজ, কর্ণফুলী টানেল ও একই নদীর ওপর কালুরঘাট রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় নয়া অর্থনৈতিক জোট বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) নিয়েও আলোচনা হবে। যেকোনো বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। কেননা জাপান থেকে অতিসম্প্রতি তিনি ৪৬ হাজার কোটি টাকার সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছেন। এর পরই ১০ দিনের মাথায় তিনি চীন সফরে গেলেন। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ১৪টি প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছিল। এ ক্ষেত্রে ছয়টি মেগা প্রকল্পে চীন যদি অর্থায়ন করে, তাহলে তা বাংলাদেশের উন্নয়নে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। গেল পাঁচ বছরে বাংলাদেশ এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক 'জায়ান্ট' চীন ও ভারতের সঙ্গে এক ধরনের ব্যালেন্স করে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী আগেরবার চীন সফর করেই ভারত গিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লিতে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। মোদি সরকারের আমন্ত্রণ এখনো বাংলাদেশ পায়নি। তবে বৈদেশিক নীতির বিশ্লেষকদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ এশিয়ার এই 'জায়ান্ট'-এর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের চেয়ে ভারতকে গুরুত্ব দিয়েছিল বেশি। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়া থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় কিছুটা হলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। কেননা আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অনেকটা চীননির্ভর। আমাদের সেনাবাহিনী চীনা অস্ত্র ব্যবহার করে। বিমানবাহিনী ব্যবহার করে চীনা বিমান। এখন প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর প্রমাণ করল, বাংলাদেশ তার উন্নয়নে চীনকে অস্বীকার করতে পারে না। এখানে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট জি জিং পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো। বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জি জিং পিং ভালো ধারণা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও খালেদা জিয়ার চীন সফরের পর পরই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেননি। ভারতের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যে চীনা প্রেসিডেন্টকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং ধারণা করছি, চলতি বছরের যেকোনো একসময় এই সফর হতে পারে। এই সুযোগটি বাংলাদেশ নিতে পারে এবং ওই সময় প্রেসিডেন্ট জি জিং পিং যাতে ঢাকা সফর করতে পারেন, সে ব্যাপারেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। মোদির ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেও চীন তথা 'ব্রিকস'ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্ব দেবে বেশি। বাংলাদেশ এই পরিবর্তনের বাইরে থাকতে পারে না। তাই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের বেশ কটি বড় প্রজেক্টে চীন অর্থায়ন করেছে। বেশ কটি ব্রিজও চীন তৈরি করে দিয়েছে, যা চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের সময় চীনের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো ও বিশেষ ছাড়ের দাবি বাংলাদেশ উত্থাপন করবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে চীনের ঋণের ক্ষেত্রে পরিশোধের মেয়াদ ১০ থেকে ১৩ বছর, এ ছাড়া আরো তিন বছর 'গ্রেস পিরিয়ড' দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী এই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছরের পাশাপাশি 'গ্রেস পিরিয়ড' পাঁচ বছর বৃদ্ধি করার দাবি জানাবেন। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য চীনে রপ্তানি করে, তার চেয়ে প্রায় ১৩ দশমিক ৮ গুণ পণ্য বেশি আমদানি করে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৪৮.৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছিল ৫৯২.৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০০১-০২ সময়সীমায় প্রায় ৬১ গুণ বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল (১১.৬৭ মিলিয়নের বিপরীতে ৭০৮.৯৪ মিলিয়ন)। ২০১২-১৩ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮.১২ মিলিয়ন (রপ্তানি) ও ছয় হাজার ৩২৪ মিলিয়ন (আমদানি)। অন্যদিকে চীনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চীন ঋণ দিয়েছিল ১৮১ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল সুদমুক্ত। একই সঙ্গে ৭৫ মিলিয়ন কম সুদে, ৭৬৪ মিলিয়ন সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট ও ৩২.৯৪ মিলিয়ন অনুদান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে চীন তার নিজ দেশে পাঁচ হাজার আইটেমের বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ মূলত ফ্রোজেন ফুড, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক চীনে রপ্তানি করে। চীনা বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায় ২০০৯ সালে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৩ সালে এসে ১৮৬ জন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন ৩২০ মিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা সেক্টরের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর জন্য ব্যবহৃত সমরাস্ত্রের ৭৫ শতাংশের উৎস হচ্ছে চীন। চীন থেকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, আর বিমানবাহিনীর জন্য ফাইটার প্লেন ক্রয় করা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবদ্দশায় জিয়া একাধিকবার চীন সফর করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনের ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের বাংলাদেশ সফর ছিল নিয়মিত। এখন এই প্রবণতা কিছুটা কম। ২০০২ সালে খালেদা জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চীনের বৈদেশিকনীতির একটা অন্যতম দিক হলো চীন রাজনৈতিকভাবে কোথাও সেভাবে জড়িত হয় না। চীনের বৈদেশিক সম্পর্কের অন্যতম দর্শন হচ্ছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। আফ্রিকাতে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের প্রচণ্ড 'জ্বালানি ক্ষুধা'। এই জ্বালানি চাহিদা তাকে মেটাতে হয় সুদানের মতো আফ্রিকার অন্যান্য দেশ থেকে, যাদের তেল রয়েছে। ইরানের তেল ও গ্যাস শিল্পেও চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশে এই সেক্টরে চীনের বিনিয়োগ নেই। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় চীন হস্তক্ষেপ না করলেও, এক তথ্যে জানা যায়, এরশাদের শাসনামলের শেষের দিকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন তৎকালীন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মোয়াজ্জেম হোসেনকে এরশাদ চীনে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রতি চীনের সমর্থন নিশ্চিত করতে। কিন্তু চীন কোনো 'কমিটমেন্ট' করেনি। সাম্প্রতিককালে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান প্রদেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমার) নামে যে অর্থনৈতিক জোটের জন্ম হয়েছে, তার উদ্যোক্তা কিন্তু চীন। ২০০৩ সালে চীন এ ধরনের একটি অর্থনৈতিক জোটের প্রস্তাব করে। চীনের উদ্দেশ্য ছিল, চীনের ইউনান প্রদেশকে সামনে রেখে মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি জোট গঠন করা। চীনের ওই প্রস্তাবকে তখন চিহ্নিত করা হয়েছিল 'কুনমিং ইনিশিয়েটিভ' বা 'কুনমিং উদ্যোগ' হিসেবে। কুনমিং হচ্ছে ইউনান প্রদেশের রাজধানী। কুনমিংয়ের সঙ্গে চট্টগ্রামের আকাশ দূরত্ব ব্যাংককের চেয়েও কম, মাত্র এক ঘণ্টা। আর কুনমিংয়ের আবহাওয়া আমাদের দেশের মতোই। কিন্তু দীর্ঘদিন ভারত চীনের এই প্রস্তাবে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। 'কুনমিং উদ্যোগ'-এর একটা উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলের সঙ্গে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর একটা যোগসূত্র স্থাপন করা, চীনের 'উদ্দেশ্য' নিয়ে ভারত তখন সন্দিহান ছিল। কেননা ভারত নিজে আসিয়ানের সদস্য হতে চায় এবং ইতিমধ্যে (২০০৭) আসিয়ানের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ এখন আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য। আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতে হলে প্রথমে আঞ্চলিক ফোরাম ও পরে 'ডায়লগ পার্টনার'-এর (দ্বিতীয় ধাপ) সদস্য হতে হয়। ভারত 'ডায়লগ পার্টনার'-এর সদস্য। বাংলাদেশ এই পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। ভারতের অনাগ্রহের কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ'-এর জট খোলেনি। পরবর্তী সময়ে বিসিআইএমের ধারণার বিকাশ ঘটে এবং এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়। ধারণা করছি, বর্তমান মোদি জামানায় বিসিআইএম ধারণা আরো শক্তিশালী হবে। কেননা মোদি নিজে চীনের উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী। তিনি ২০০৬, ২০০৭ ও ২০১১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে চীন সফর করেছেন। একই সঙ্গে মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারেও মোদির আগ্রহ থাকবে। ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে মিয়ানমারে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, বিক্রমপুরের বৌদ্ধ মনীষী শ্রীমান অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য অষ্টম শতকে তিব্বতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তিনি দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর দেহ ভস্ম তিব্বতে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত ছিল। শহীদ জিয়াউর রহমানের সময় ওই দেহভস্ম বাংলাদেশে আনা হয় এবং কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরে তা সংরক্ষিত রয়েছে। অন্যদিকে ইতিহাস থেকেও জানা যায়, এ অঞ্চলের ব্যাপারে চীনেরও আগ্রহ ছিল। একজন চীনা নাবিক, যিনি এডমিরাল ঝেং হে নামে পরিচিত, তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইউনান প্রদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম মা হে। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সালের মধ্যে দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত ৩৩টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দেশ সফর করেন। ১৪২১ থেকে ১৪৩১ সাল পর্যন্ত তিনি দুবার আজকের অধুনালুপ্ত বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও ভ্রমণ করেন। এবং এই অঞ্চলের সঙ্গে ইউনান রাজ্যের সম্পর্ক স্থাপন করেন। সুতরাং ঐতিহাসিক সম্পর্কের সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রী চীন গেলেন। তাঁর এই সফরের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে আরো চীনের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। Daily KALER KONTHO 08.06.14

0 comments:

Post a Comment