ঢাকার মিরপুরের কালশীর বিহারি ক্যাম্পের ৯ জন মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? ওই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলো না, তখন এ ধরনের প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে কালশীর ঘটনা কি সত্যিই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তো এমন একটি আভাসই দিয়েছিলেন যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা! আগুনে পুড়ে নারী-শিশুসহ ৯ জন মানুষ মারা গেল। আর পুলিশের গুলিতে মারা গেল একজন। কোনো সভ্য সমাজে একসঙ্গে এতগুলো মানুষ মারা গেলে কি তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়! যাঁরা রাজনীতি করেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে যাঁদের কাজ করার কথা, তাঁরা যখন 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' হিসেবে হত্যাকাণ্ডকে চালিয়ে দিতে চান, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
কালশী কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের অপহরণোত্তর সাত খুনের ঘটনা কিংবা ২০ মে ফেনী শহরে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এগুলো সবই মূলত একসূত্রে গাঁথা। আমাদের নষ্ট রাজনীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। আর এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুশাসনের অভাব প্রচণ্ডভাবে অনুভূত হচ্ছে দেশে। যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা সুশাসনের এই অভাবটি অনুভব করেন কি না জানি না, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়ভাবে সরকারদলীয় কর্তাব্যক্তিরা। আর প্রশাসন পালন করছে নির্লিপ্ত ভূমিকা। দেশে সুস্থ গণতন্ত্রচর্চা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আমাদের কোনো আশার বাণী শোনায় না।
কালশীর ঘটনা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি
আমাদের সংবিধানে দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার স্বীকৃত। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।' এখন যে ঘটনা কালশীতে ঘটল, যেখানে শিশু ও নারীকে পুড়িয়ে মারা হলো, সেখানে সংবিধান বর্ণিত মানবসত্তার মর্যাদা থাকল কোথায়! বিহারিরা উর্দুভাষী। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠনের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তাতে করে উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতেই পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছর পরও উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মূলধারায় আসেনি। এখানে ব্যর্থতা কার, সে প্রশ্ন খুব সহজেই উঠতে পারে। বিহারিরা নিজেদের এখনো পাকিস্তানি মনে করে এবং পাকিস্তানে যেতে চায়। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে পুনর্বাসন। অতীতে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হলেও অগ্রগতি হয়েছে কম। মাত্র একটি ব্যাচ পাকিস্তানে ফিরে গেছে। গত ১০ বছরে এ নিয়ে তেমন আলোচনার খবর আমাদের জানা নেই। একসময় নওয়াজ শরিফ তাদের পাকিস্তানে নিয়ে যেতে রাজি হলেও প্রচণ্ড আপত্তি ছিল বেনজির ভুট্টোর। বেনজির তাদের পাকিস্তানি না বলে বিহারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন তারা বাংলাদেশের নাগরিক! আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে প্রায় পাঁচ-ছয় লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে (সরকারিভাবে এ সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার) আমরা পাকিস্তানে যেতে অথবা পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে 'বাধ্য' করতে পারিনি। এসব পাকিস্তানি নাগরিক বিভিন্ন ক্যাম্পে (ঢাকা ও সৈয়দপুর) মানবেতর জীবন যাপন করে। শিক্ষা-দীক্ষাহীন এসব নাগরিকের কেউ কেউ সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। এখন কালশীর যে এলাকায় তারা থাকে ও যেটা তাদের স্থায়ী ঠিকানা, এটা তাদের অপরাধ হতে পারে না। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এদের অনেকেই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। নিজস্ব জমি থেকে তাদের উচ্ছেদের একটা ষড়যন্ত্রের কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিহারিরা প্রকাশ্যেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। যে তদন্ত হচ্ছে, তাতে প্রকৃত সত্য আদৌ বেরিয়ে আসবে কি না, আমার মতো অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে তাতে। তবে এই সংসদ সদস্য সম্পর্কে কালের কণ্ঠ আমাদের যে তথ্য দিয়েছে (১৮ জুন), তাতে করে তাঁর বিহারিদের ওই জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি থাকা অমূলক নয়। এই ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তাঁর এসব অপকর্ম ঢাকতে। আমাদের দুঃখ এখানেই যে এসব 'ভূমিখোরকে' আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছি। দলের ছত্রচ্ছায়ায় ও প্রভাবে তাঁরা নিজেদের পরিণত করেছেন এক-একজন 'ফ্রাংকেনস্টাইন দানবে'। একজন ব্যক্তি কী করে মিরপুরের গৃহায়ণের দুয়ারীপাড়ার ৪৭৪টি প্লট, চিড়িয়াখানার ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি, এমডিসি মডেল স্কুল, তুরাগ নদ কিংবা দুয়ারীপাড়ার জলাশয়ের জমি দখল করেন (কালের কণ্ঠ, ওই), ভাবতেই অবাক হতে হয়। তাঁর ক্ষমতার উৎস কোথায়? এই নষ্ট রাজনীতিই তাঁকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। একজন ইলিয়াস মোল্লা, নিজাম হাজারীর উত্থান তাই একই সূত্রে গাঁথা। তাঁরা রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তাঁদের সব অপকর্মের একটা সিঁড়ি হিসেবে। আর রাজনীতির কারণেই হয়তো দেখা যাবে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও সবাই পার পেয়ে যাবেন!
এই নষ্ট রাজনীতি আমাদের দেশে ত্যাগী রাজনীতিবিদদের জন্ম দিতে পারেনি। একুশ শতক-উপযোগী যে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ আমাদের দরকার, সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আমাদের তা উপহার দিতে পারছে না। রাজনীতি বেশি মাত্রায় পেশি ও সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে যাচ্ছে! নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। যাঁরা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্বে' বিশ্বাস করেন, তাঁরা নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তিনি জেনেশুনেই কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। যাতে করে তাঁকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো সহজ না হয়। এটা সত্য, তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া জটিল। এর সঙ্গে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া জড়িত। ভারতীয় আইনে তাঁর বিচার হবে। শাস্তি হবে। তিনি সেখানে শাস্তি ভোগ করবেন। তারপর ফেরত পাঠানোর প্রশ্ন। তাই সাত খুনের বিচার হবে, খুনিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে- এটা আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন! আমার দুঃখবোধ ফেনীর ফুলগাজীর প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের জন্য। তাঁর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নিজাম হাজারী এখন সৌদি আরবে। আর কালশী হত্যাকাণ্ডে যাঁর দিকে আঙুল নির্দেশ করা হয়েছে, সেই ইলিয়াস মোল্লাও যদি এখন ধর্মীয় অথবা ব্যবসায়িক কারণে বিদেশ যান, আমি অবাক হব না।
কালশী হত্যাকাণ্ড আমাদের আস্থার জায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিরা নানা বিতর্কে নিজেদের জড়িত করে একটা বড় ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছেন। এর বিচার যদি না হয়, তাহলে 'আরেকটা কালশী'র জন্ম হবে। আরো একটা হত্যাযজ্ঞ হবে, যা আমরা রোধ করতে পারব না! কালশী হত্যাকাণ্ড আমাদের বেশ কিছু আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। এক. বিহারিরা বাংলাদেশে থাকলেও এরা পাকিস্তানি নাগরিক। ফলে পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারে! এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী একটি প্রপাগান্ডায় নামতে পারে। তাতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। দুই. বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক দিন থেকেই সোচ্চার। এখন কালশীর হত্যাকাণ্ডকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসে বিষয়টি যদি বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো উত্থাপনের চেষ্টা করে, আমি তাতে অবাক হব না। তিন. যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের যে সাহায্য পাওয়ার কথা, তাতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। চার. কালশী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংসদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, সংসদ তা পালন করেনি। ফলে নয়া নির্বাচনের পক্ষে জনমত আরো শক্তিশালী হবে। পাঁচ. সরকারি দলে একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি থাকায় সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এখন ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। দলটির জনপ্রিয়তা ইতিমধ্যে অনেক হ্রাস পেয়েছে। দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা যত দ্রুত এ বিষয়টি উপলব্ধি করবেন, ততই দলের জন্য মঙ্গল। কালশী হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। অন্তত একটি ক্ষেত্রে হলেও যেন আমরা বলতে পারি 'আমরা পেরেছি'। শুধু বিহারি বলে, ভিন্ন ভাষায় কথা বলে বিধায়, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার যদি না হয়, তাহলে তা হবে চরম মানবতা লঙ্ঘনের শামিল। আর একজন ব্যক্তি যখন দলকে তাঁর স্বার্থে ব্যবহার করেন, তখন দল এ ক্ষেত্রে উপকৃত হয় না। দলের জন্য তিনি হয়ে যান বোঝা- দলের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত যদি এটা বোঝেন, তাতে সবার মঙ্গলই নিহিত।
Daily Kaler Kontho
25.06.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment