মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) হাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানের মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক এখন কোন পথে? সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ওই ঘটনার পর মিয়ানমার বঙ্গোপসগারে ৩টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করলেও গত সোমবারের খবর অনুযায়ী ওই জাহাজগুলো সরিয়ে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের নৌবাহিনী। সম্প্রতি দেখা গেছে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। মিয়ানমারের নয়া রাজধানী নেইপিডোয় তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ওই আলোচনায় দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি, এমনকী আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য-বিনিয়োগে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের সহযোগী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল মিয়ানমার। এখন মাত্র দুমাসের ব্যবধানে এমন কী ঘটনা ঘটল- যার কারণে সীমান্তে রক্ত ঝরল। এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে এই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আসলেই কী এটি কোনও ভুল বোঝাবুঝি ছিল, নাকি মিয়ানমার সরকারের ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্য আছে? সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত যে পুরোপুরিভাবে শান্ত, তা বলা যাবে না। মিয়ানমারের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের জোর করে বাংলাদেশ পাঠানো, নাফ নদী থেকে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া, নাইক্ষ্যংছড়িতে কাঠুরিয়াদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা, ব্যাপক হারে বাংলাদেশে ইয়াবা ট্যাবলেটের চালান ইত্যাদি ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় একধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এমনকী অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করা হচ্ছিল। নৌকায় সাগর পাড়ি দেওয়া বেশ কয়েকটি ট্রিপ আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশের নৌবাহিনী। ফলে অনেক দিন থেকেই মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে দৃষ্টি ছিল অনেকের। তবে মিজানুর রহমান হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটল এমন একসময়- যখন মিয়ানমারের নাগরিকদের শুমারি চলছে। অর্থাৎ মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রকৃত একটি তালিকা তৈরি করছে মিয়ানমার সরকার। অনেকের স্মরণে থাকার কথা, আরাকানের বাসিন্দা রোহিঙ্গা- যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, তাদের নাগরিক হিসেবে মনে করে না মিয়ানমার সরকার। তারা মনে করে, রোহিঙ্গারা বৃহত্তম চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দা। কিন্তু ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা শত বছর ধরেই আরাকানে বসবাস করছেন।
যারা মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন- মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটিকে একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তারা অত্যন্ত কৌশলে মুসলমানদের উৎখাত করে সেখানে একধরনের ‘বৌদ্ধরাজ’ কায়েম করতে চায়। ইতিহাস বলে, জেনারেল নে উইনের আমলে আরাকানে জাতিগত আন্দোলন দমনের জন্য ১৯৭৮ সালে ‘নাগামিন ড্রাগন’ অপারেশন চালানো হয়েছিল। আরাকান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পৃক্ততার অভিযোগে নির্বিচারে হাজারো রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। নাগামিন ড্রাগন অপারেশনের ফলে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান উদ্বাস্তু হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। উদ্বাস্তু সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তখন আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কামনা করে। ফলে ১৯৭৯ সালে দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির বিনিময়ে কয়েক হাজার শরণার্থী (রোহিঙ্গা) নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের পর মিয়ানমারে আসা রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ কারণে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি অর্জন, রাজনৈতিক অধিকার ও অবাধচলাচল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমনকী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে গিয়ে বসবাস করতে পারেন না। উচ্চশিক্ষার কোনও সুযোগ তাদের নেই। এক সন্তানের বেশি তারা গ্রহণ করতে পারে না। এমনকী তাদের বিয়েতেও একধরনের নিয়ন্ত্রণ আছে। আরাকান রাজ্যে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় তাদের। রোহিঙ্গাদের ওপর পুনরায় নির্যাতন শুরু হলে ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু-সংকটের সৃষ্টি হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯১ সালের ২৬ জুনের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ রোহিঙ্গা মুসলমান আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। বর্তমানে কক্সবাজারে ১৯টি শরণার্থী শিবিরে ও শিবিরের বাইরে আরও ২ লাখ ৫০ হাজার ৬৬১ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন। দুদেশের সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির ফলে ১৯৯২ সালের ১৫ মে ৬ মাসের মধ্যে মিয়ানমার সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা হয়েছে একটিই- মিয়ানমার সরকার মাত্র ২২ হাজার শরণার্থীকে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে। বাকিদের স্বীকার করে না। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমস্যাটি দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাও চাচ্ছে না রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যান।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের পরও যখন মিয়ানমারের উসকানিতে সীমান্তে রক্ত ঝরে, তখন বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যায় না। মিয়ানমার একটি অভিযোগ করেছে, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন নামে একটি জঙ্গি সংগঠন মিয়ানমারের ভেতরে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছেন। বিজিবির টহলকে তারা ওই সংগঠনের তৎপরতা মনে করে গুলি চালিয়েছিল। এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এ ধরনের কোনও সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। এমনকী রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের খবরও আমাদের জানা নেই। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য যদি সত্য বলে আমরা ধরে নিই, তাহলেও আমাদের চিন্তার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। প্রথমত, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আমাদের নিরাপত্তাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারেন। বহিস্থ কোনও রাষ্ট্র বা সংগঠন নিজেদের স্বার্থে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে তাদের ব্যবহার করতে পারে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সরকারের দমননীতি রোহিঙ্গা তথা আরাকানবাসীদের বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমনিতেই মিয়ানমারে বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে (যেমন কারেন)। তারা দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। তাদের কাতারে রোহিঙ্গাদের যোগ হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তৃতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সব সেন্য প্রত্যাহার করলে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে নতুন করে একধরনের জঙ্গি তৎপরতার জন্ম হতে পারে। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ৬টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করবে যুক্তরাষ্ট্র। সেসব যুদ্ধজাহাজ বর্তমানে এশিয়া প্যাসিফিক প্লিটে (ষষ্ঠ প্লিট) নিয়োজিত রয়েছে। চীনকে ঘিরে ফেলা ও চীন সরকারের পতন ঘটানোর (অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার পতনের মতো, ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে) টার্গেট নিয়েই এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ, বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের গুরুত্ব বেশি। সুতরাং রোহিঙ্গারা আগামীতে ব্যবহৃত হতে পারে। রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে মিয়ানমার সরকারকে যদি দুর্বল করা যায়, তাহলে মার্কিন স্বার্থ হাসিলে সুবিধা হয়। তাই বাংলাদেশ সরকারকে সব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশ দুটি বিমসটেক ও নতুন অর্থনৈতিক জোট বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) সদস্য। এই বিসিআইএম আমাদের জন্য অপার এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। এর মাধ্যমে আসিয়ানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতে পারে। আসিয়ানে ২০২০ সালে বিশাল এক মুক্তবাজারের সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের পণ্যের বিশাল এক বাজার সেখানে সৃষ্টি হতে পারে। উপরন্তু কক্সবাজার-কুনমিং মহাসড়ক নির্মাণ যদি সম্ভব হয়, তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল এক পরিবর্তন আসবে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন যাচ্ছেন ৬ জুন। বেইজিংয়ে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। এই গভীর সমুদ্রবন্দর এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে পুরোপুরিভাবে বদলে দেবে। চীন ও ভারত এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। সঙ্গত কারণেই মিয়ানমারের সমর্থন আমাদের প্রয়োজন। সীমান্তহত্যার ঘটনা যেন এই সম্পর্কে কোনও তিক্ততার সৃষ্টি না করে।
অবশ্যই সীমান্তহত্যা নিন্দনীয়। ৮ ও ৯ জুন মিয়ানমারে বিজিপি-বিজিবি বৈঠক বসছে। বিজিবির মহাপরিচালকের মিয়ানমারে যাওয়ার কথা। জুনের মাঝামাঝি আসছেন মিয়ানমারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নিঃসন্দেহে এসব সফরের গুরুত্ব রয়েছে। সীমান্তহত্যা বন্ধের ব্যাপারে অবিলম্বে দুদেশের মধ্যে একটা ‘হটলাইন’ চালু করা দরকার। দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে ঘন-ঘন বৈঠক হওয়াও প্রয়োজন। অবৈধ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ করা উচিত। এ দায়িত্বটি পালন করবে বিজিবি। আর মিয়ানমারের উপ-পরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় গুরুত্ব দেওয়া উচিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। তারা আমাদের জন্য বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনও জঙ্গি তৎপরতা বা জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব আছে কি না, সে ব্যাপারে দুদেশ গোয়েন্দা তথ্যবিনিময় করতে পারে। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য যে-কোনও ধরনের জঙ্গি তৎপরতা বন্ধ করা উচিত। আমাদের উন্নয়নে মিয়ানমার অংশীদার হতে পারে। মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ (মিয়ানমারের গ্যাস যাচ্ছে চীন ও ভারতে) দিয়ে আমাদের জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে পারি। উপরন্তু মিয়ানমারে আমরা জমি নিয়ে চাষাবাদ করতে পারি। একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
Daily Amader Somoy
04.06.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment