১৫ মার্চ সিরিয়ার যুদ্ধ আট বছরে পা দিয়েছে। আরব বসন্ত যখন তুঙ্গে, তখন ২০১১ সালের ১৫ মার্চ সিরিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন দমাতে আসাদ সরকার কঠোর অবস্থানে যায়। নাটকীয়ভাবে তখন উত্থান ঘটে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস)। এরপরের কাহিনি আমরা সবাই জানি। একপর্যায়ে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা ইরাক ও সিরিয়ার একটা অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র, যারা সেখান থেকে সমগ্র মুসলিমবিশ্বে খেলাফতের ডাক দেয়। এতে বিভ্রান্ত হন মুসলিমবিশ্বের হাজার হাজার মানুষ। এদের অনেকে তথাকথিত ‘জিহাদি যুদ্ধে’ অংশ নেওয়ার জন্য সিরিয়ায় যান। কিন্তু এখন সেসব অতীত। অব্যাহত মার্কিন ও রুশ বিমান হামলার কারণে আইএসের পতন হয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত যেসব এলাকা ছিল, সেখান থেকে তারা বিতাড়িত হয়েছে। ‘আরব বসন্তে’ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রগুলো থেকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা শাসকরা উৎখাত হলেও ব্যতিক্রম ছিলেন আসাদ। তিনি সিরিয়ায় এখনও আছেন। বলা যেতে পারে, সরাসরি রাশিয়ার সাহায্যের কারণেই টিকে গেলেন আসাদ; কিন্তু কতদিনÑ সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। সিরিয়া যুদ্ধে আইএস উৎখাত হয়েছে সত্য; কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। রাজধানী দামেস্কের পার্শ্ববর্তী পূর্ব ঘৌতায় আসাদ বাহিনী তাদের বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে। সেখানে সরকারবিরোধী বিদ্রোহী বাহিনী শক্ত অবস্থানে আছে। পূর্ব ঘৌতা এখন পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধ চলছে উত্তরাঞ্চলীয় আফরিন শহরেও। সেখানে কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের সেনাবাহিনী তাদের সেনা অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
সিরিয়া যুদ্ধে এখন অনেকগুলোর ‘ফ্রন্টের’ জন্ম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরানÑ সবারই সিরিয়ায় স্বার্থ রয়েছে। এরপর যোগ হয়েছে ইসরাইল। তুরস্ক কর্তৃক ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের পর ইসরাইল এটাকে হালকাভাবে নেবেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তুরস্ক সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত আফরিন দখল করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অথচ দেশ দুটি ন্যাটোর সদস্য। তুরস্কের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া থেকে অস্ত্রও কিনছে তুরস্ক। এই অস্ত্র কেনার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আফরিনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্রের ভালো না লাগারই কথা। তুরস্কে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- হয়েছে, তা কুর্দি সন্ত্রাসীদের কাজ বলে তুরস্কের অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কুর্দি অঞ্চল মানবিজকে নিয়ে। মানবিজ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান রয়েছে, যারা সেখানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কর্মরত। তুরস্ক মানবিজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ ভোগেল সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, পেন্টাগন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এই ফোর্স তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফরিন শহর মুক্ত করার জন্য ‘যুদ্ধ’ করছে। ফলে সিরিয়া সংকট নতুন একটি মোড় নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়কে আরও বিস্মিত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে যে বিকল্প শান্তি আলোচনা চলছিল, তাতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৯ জানুয়ারি সোচিতে যে শান্তি আলোচনা আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ তাতে যোগ না দেওয়ায় কার্যত সে উদ্যোগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে। ফলে একটা প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠেছে যে, সিরিয়ার রাজনীতি এখন কোন পথে? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী একরকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দুয়েক আগে মার্কিন ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়; কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশকিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা আইএসের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এ-ই যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এই সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের এক দিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই এই পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজি হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগে করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযান সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গেল অক্টোবরে (২০১৭) সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল, কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। সিরিয়ার কুর্দিরা বেশিরভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি বা ‘পিপলস ডিফেনস ইউনিট’ (ণচএ) ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বপাড়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই তুরস্ক একধরনের অস্বস্তিÍতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সালে থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অনেকের স্মরণ থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই তাহলে এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি রাখতে চায়। তারা সিরিয়ায় দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠাতে চায়! আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করতেন। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে, রাশিয়ার কারণেই আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ; আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ার শিবিরে অবস্থান করছে।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে? সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে আসাদকে রাখা না রাখা নিয়ে একটি ‘ডিবেট’ আছে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধী অনেকগুলো ‘পক্ষ’ রয়েছে, যারা একদিকে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেও ‘যুদ্ধ’ করছে, আবার ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত। দুটি বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও সিরিয়া সংকটে নিজেদের জড়িত করেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এখন অবধি একটি শান্তি ফরমুলা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়ার উদ্যোগে সোচিতেও আসাদবিরোধীদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে আসছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সোচি বৈঠক বয়কট করেছে সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ, যাদের কেউ কেউ জেনেভা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিতে বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে একটি হাইনেগোশিয়েশনস কমিটি (এইচএনসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কমিটির মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। এইচএনসি সৌদি আরব সমর্থিত। তবে কুর্দিদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এখানে দ্বন্দ্ব আছে। বস্তুত ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হওয়া এইচএনসির কোনো ভূমিকা নেই।
তাহলে সমাধানটা হবে কীভাবে? সিরিয়ার পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই জটিল হয়ে পড়েছে। এখানে কার্যত দুটি বড় শক্তির অবস্থান পরস্পরবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টই কুর্দিদের নিয়ে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চায়। অর্থাৎ আসাদবিরোধী একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে তুরস্কের সমর্থন না পাওয়া। কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থান ও সমর্থন তুরস্ক ভালো চোখে দেখছে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্ট্রাটেজি হচ্ছে সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব কমানো। এক্ষেত্রে সুন্নি ধর্মাবলম্বী তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল মিত্র হতে পারত; কিন্তু তা হয়নি। বরং তুরস্ক ও ইরান এক ধরনের অ্যালায়েন্সে গেছে। রাশিয়া আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল। কিন্তু রাশিয়া চায় না আসাদ অপসারিত হোক। আসাদকে রেখেই রাশিয়া এক ধরনের সমাধান চায়। এখানে তুরস্কের আপত্তি থাকলেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুরস্ক আজ রাশিয়ার মিত্র। রাশিয়া নিজ উদ্যোগে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে চায়। সেজন্যই সোচিতে সিরিয়ার সব দল ও মতের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেছিল রাশিয়া, যাকে তারা বলছে ‘সিরিয়ান কংগ্রেস অব ন্যাশনাল ডায়ালগ’। কিন্তু সেখানেও বিরোধ আছে। নানা মত ও পক্ষের প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও একটা বড় অংশ এতে অংশ নেয়নি। সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ ‘সিরিয়ান নেগোসিয়েশন কমিশন’ এই সম্মেলনে অংশ নেয়নি। সিরিয়া সংকটের মূলে রয়েছে সব মত ও পথকে একটি কাঠামোয় আনা। সেখানে সুন্নি, শিয়া, দুর্জ, আলাউট মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন সামরিক গ্রুপ রয়েছে। আসাদ সমর্থকরাও একটি পক্ষ। কিছু ইসলামিক গ্রুপও রয়েছে, যারা আইএসের বিরোধিতা করেছিল। সবাইকে নিয়ে একটি সমাধান বের করা সহজ কাজ নয়। যদিও সোচিতে সবাই সিরিয়ার অখ-তা রক্ষায় একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ধারা ও নির্বাচনের প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন। তারপরও কথা থেকে যায়Ñ বড় বিরোধী দলের অবর্তমানে এই সমঝোতা আদৌ কাজ করবে কিনা।
আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়ার সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। সিরিয়ার যুদ্ধ আট বছরে পা দিয়েছে। এতে কী পেয়েছেন আসাদ? সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে প্রায় ১ কোটি মানুষকে। জামার্নিতে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক লাখ সিরীয় নাগরিক। গেল বছর আমি এসব শরণার্থীকে জার্মানির ফ্রাংকফুট শহরে ভিক্ষা করতে পর্যন্ত দেখেছি। আমি এখন বার্লিনে। আবারও এসেছি। এবার এসেছি জার্মান সরকারের আমন্ত্রণে। কিন্তু সিরিয়া নিয়ে কোনো আশার কথা আমি শুনিনি। আসাদ ক্ষমতায় থেকে গেছেন বটে; কিন্তু তিনি একটি বিধ্বস্ত দেশ পেয়েছেন। দেশটির পুনর্গঠন হবে বড় সমস্যা। তার আগে দরকার যুদ্ধ বন্ধ। পূর্ব ঘৌতায় যে অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ছোট ছোট শিশুর মৃত্যু আর যন্ত্রণার ছবি যে-কোনো মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধ থামছে না। বৃহৎ শক্তিগুলোর অবস্থান পরস্পরবিরোধী হওয়ায় সিরিয়ায় যুদ্ধ থামছে না। তাই সিরিয়া যুদ্ধ আট বছরে পা রাখলেও কোনো ভালো খবর আমরা শুনতে পাচ্ছি না।
আলোকিত বাংলাদেশ ২৫ মার্চ ২০১৮
সিরিয়া যুদ্ধে এখন অনেকগুলোর ‘ফ্রন্টের’ জন্ম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরানÑ সবারই সিরিয়ায় স্বার্থ রয়েছে। এরপর যোগ হয়েছে ইসরাইল। তুরস্ক কর্তৃক ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের পর ইসরাইল এটাকে হালকাভাবে নেবেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তুরস্ক সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত আফরিন দখল করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অথচ দেশ দুটি ন্যাটোর সদস্য। তুরস্কের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া থেকে অস্ত্রও কিনছে তুরস্ক। এই অস্ত্র কেনার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আফরিনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্রের ভালো না লাগারই কথা। তুরস্কে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- হয়েছে, তা কুর্দি সন্ত্রাসীদের কাজ বলে তুরস্কের অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কুর্দি অঞ্চল মানবিজকে নিয়ে। মানবিজ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান রয়েছে, যারা সেখানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কর্মরত। তুরস্ক মানবিজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ ভোগেল সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, পেন্টাগন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এই ফোর্স তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফরিন শহর মুক্ত করার জন্য ‘যুদ্ধ’ করছে। ফলে সিরিয়া সংকট নতুন একটি মোড় নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়কে আরও বিস্মিত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে যে বিকল্প শান্তি আলোচনা চলছিল, তাতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৯ জানুয়ারি সোচিতে যে শান্তি আলোচনা আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ তাতে যোগ না দেওয়ায় কার্যত সে উদ্যোগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে। ফলে একটা প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠেছে যে, সিরিয়ার রাজনীতি এখন কোন পথে? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী একরকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দুয়েক আগে মার্কিন ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়; কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশকিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা আইএসের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এ-ই যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এই সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের এক দিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই এই পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজি হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগে করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযান সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গেল অক্টোবরে (২০১৭) সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল, কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। সিরিয়ার কুর্দিরা বেশিরভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি বা ‘পিপলস ডিফেনস ইউনিট’ (ণচএ) ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বপাড়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই তুরস্ক একধরনের অস্বস্তিÍতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সালে থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অনেকের স্মরণ থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই তাহলে এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি রাখতে চায়। তারা সিরিয়ায় দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠাতে চায়! আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করতেন। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে, রাশিয়ার কারণেই আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ; আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ার শিবিরে অবস্থান করছে।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে? সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে আসাদকে রাখা না রাখা নিয়ে একটি ‘ডিবেট’ আছে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধী অনেকগুলো ‘পক্ষ’ রয়েছে, যারা একদিকে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেও ‘যুদ্ধ’ করছে, আবার ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত। দুটি বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াও সিরিয়া সংকটে নিজেদের জড়িত করেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এখন অবধি একটি শান্তি ফরমুলা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়ার উদ্যোগে সোচিতেও আসাদবিরোধীদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে আসছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সোচি বৈঠক বয়কট করেছে সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ, যাদের কেউ কেউ জেনেভা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিতে বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে একটি হাইনেগোশিয়েশনস কমিটি (এইচএনসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কমিটির মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। এইচএনসি সৌদি আরব সমর্থিত। তবে কুর্দিদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এখানে দ্বন্দ্ব আছে। বস্তুত ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হওয়া এইচএনসির কোনো ভূমিকা নেই।
তাহলে সমাধানটা হবে কীভাবে? সিরিয়ার পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই জটিল হয়ে পড়েছে। এখানে কার্যত দুটি বড় শক্তির অবস্থান পরস্পরবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টই কুর্দিদের নিয়ে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চায়। অর্থাৎ আসাদবিরোধী একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে তুরস্কের সমর্থন না পাওয়া। কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থান ও সমর্থন তুরস্ক ভালো চোখে দেখছে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্ট্রাটেজি হচ্ছে সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব কমানো। এক্ষেত্রে সুন্নি ধর্মাবলম্বী তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল মিত্র হতে পারত; কিন্তু তা হয়নি। বরং তুরস্ক ও ইরান এক ধরনের অ্যালায়েন্সে গেছে। রাশিয়া আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল। কিন্তু রাশিয়া চায় না আসাদ অপসারিত হোক। আসাদকে রেখেই রাশিয়া এক ধরনের সমাধান চায়। এখানে তুরস্কের আপত্তি থাকলেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুরস্ক আজ রাশিয়ার মিত্র। রাশিয়া নিজ উদ্যোগে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে চায়। সেজন্যই সোচিতে সিরিয়ার সব দল ও মতের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেছিল রাশিয়া, যাকে তারা বলছে ‘সিরিয়ান কংগ্রেস অব ন্যাশনাল ডায়ালগ’। কিন্তু সেখানেও বিরোধ আছে। নানা মত ও পক্ষের প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও একটা বড় অংশ এতে অংশ নেয়নি। সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ ‘সিরিয়ান নেগোসিয়েশন কমিশন’ এই সম্মেলনে অংশ নেয়নি। সিরিয়া সংকটের মূলে রয়েছে সব মত ও পথকে একটি কাঠামোয় আনা। সেখানে সুন্নি, শিয়া, দুর্জ, আলাউট মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন সামরিক গ্রুপ রয়েছে। আসাদ সমর্থকরাও একটি পক্ষ। কিছু ইসলামিক গ্রুপও রয়েছে, যারা আইএসের বিরোধিতা করেছিল। সবাইকে নিয়ে একটি সমাধান বের করা সহজ কাজ নয়। যদিও সোচিতে সবাই সিরিয়ার অখ-তা রক্ষায় একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ধারা ও নির্বাচনের প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন। তারপরও কথা থেকে যায়Ñ বড় বিরোধী দলের অবর্তমানে এই সমঝোতা আদৌ কাজ করবে কিনা।
আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়ার সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। সিরিয়ার যুদ্ধ আট বছরে পা দিয়েছে। এতে কী পেয়েছেন আসাদ? সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে প্রায় ১ কোটি মানুষকে। জামার্নিতে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক লাখ সিরীয় নাগরিক। গেল বছর আমি এসব শরণার্থীকে জার্মানির ফ্রাংকফুট শহরে ভিক্ষা করতে পর্যন্ত দেখেছি। আমি এখন বার্লিনে। আবারও এসেছি। এবার এসেছি জার্মান সরকারের আমন্ত্রণে। কিন্তু সিরিয়া নিয়ে কোনো আশার কথা আমি শুনিনি। আসাদ ক্ষমতায় থেকে গেছেন বটে; কিন্তু তিনি একটি বিধ্বস্ত দেশ পেয়েছেন। দেশটির পুনর্গঠন হবে বড় সমস্যা। তার আগে দরকার যুদ্ধ বন্ধ। পূর্ব ঘৌতায় যে অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ছোট ছোট শিশুর মৃত্যু আর যন্ত্রণার ছবি যে-কোনো মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধ থামছে না। বৃহৎ শক্তিগুলোর অবস্থান পরস্পরবিরোধী হওয়ায় সিরিয়ায় যুদ্ধ থামছে না। তাই সিরিয়া যুদ্ধ আট বছরে পা রাখলেও কোনো ভালো খবর আমরা শুনতে পাচ্ছি না।
আলোকিত বাংলাদেশ ২৫ মার্চ ২০১৮
0 comments:
Post a Comment