এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত ২৫টি পশ্চিমা দেশ থেকে ১৩৯ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়াও এর মধ্যে তার দেশে কর্মরত ১৫০ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর এ প্রথমবারের মতো রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সম্পর্কে বড় ধরনের অবনতি ঘটল। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করল। তবে কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা একেবারে নতুন নয়। আমরা যদি সাম্প্রতিককালে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দিকে তাকাই তাহলে দেখব এর আগেও কূটনীতিকদের বহিষ্কারের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮৬, ১৯৯৪, ২০০১, ২০১০ এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালেও যুক্তরাষ্ট্র রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছিল। এর পাল্টা ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে রাশিয়াও মার্কিন কূটনীতিকদের তার দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিল। তবে এখানে পার্থক্যটা হল ২৫টি পশ্চিমা দেশ একসঙ্গে রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করল, এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
এ ঘটনা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এটা স্পষ্ট, যা মার্কিন প্রশাসন বলছে, তারা তাদের বন্ধু, বিশেষ করে ব্রিটেনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্রিটেনের রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র শুধু সমর্থনই করেনি বরং তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে লক্ষ্য করার বিষয় চীন কিংবা ভারতের মতো বড় দেশ, এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোও ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ৪ মার্চ স্যালিসব্যারি শহরে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দু’সপ্তাহ আমি ইউরোপে ছিলাম। জার্মানি, পোল্যান্ডে কিংবা চেক রিপাবলিকে আমি এ ঘটনার তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখিনি।
জার্মান টিভিতে আমি জার্মান পার্লামেন্টের বিতর্ক দেখেছি। সেখানে সদ্যগঠিত এঞ্জেলা মার্কেলের কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসপিডি) একজন এমপি রলফ ম্যুটজেনিচ জার্মান সরকারের কিছুটা সমালোচনা করে বলেছিলেন যে তদন্তে এখনও প্রমাণিত হয়নি কে বা কারা রুশ গোয়েন্দাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করেছে। তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার আগেই খুব দ্রুতই কূটনীতিক বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। অপর একজন সংসদ সদস্য যিনি গ্রিন পার্টির সদস্য, ইয়র্গেন ট্রিটিন বললেন, এ কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করবে।
এখানে বলা ভালো, জার্মানি ৪ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। জার্মান সংসদে এ বিতর্কে প্রমাণ করল, জার্মানিতে এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস, যিনি এসপিডি দলের সদস্য, তিনি রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কারের ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে আছেন। স্পষ্টতই সেখানকার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। পোল্যান্ড ৪ ও চেক রিপাবলিক ৩ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করলেও, ওয়ারশ’তে আমার স্বল্প অবস্থানকালে আমি দেখেছি, এটা নিয়ে সেখানে তেমন উত্তেজনা নেই; তেমন আলোচনাও নেই। পোল্যান্ড ও চেক রিপাবলিকে দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায়। পোল্যান্ডে আমি অনেকের সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি- সেখানে সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব একরকম নেই বললেই চলে।
এমনকি যে ‘সলিডারিনস’ সংগঠনটি পোল্যান্ডে সমাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল, সেই ‘সলিডারিনস’ও (যা পরে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়) এখন অস্তিত্বহীন। লেস ভ্যালেসা এখনও বেঁচে আছেন। কিন্তু তিনি রাজধানী ওয়ারশ’তে থাকেন না, থাকেন গাদানস্কে; তিনি রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ৪৬০ আসনবিশিষ্ট সংসদের নিম্নকক্ষে (সেজেম) দক্ষিণপন্থী ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (২৩৪ আসন) এখন ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী ম্যাথিউজ মোরাভিয়েকি।
তবে মূল ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেইজ দুদার হাতে। চেক রিপাবলিকেও দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায়- আন্দ্রেই বাবিস সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। ফলে দেশ দুটো যে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসরণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এখানে স্মরণ করিয়ে দেই, স্ক্রিপালকে হত্যার ব্যাপারে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে রাশিয়া। এখন যে প্রশ্নটি এর মধ্যেই উচ্চারিত হয়েছে তা হচ্ছে, এ কূটনীতিক বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে? সম্ভাব্য দিকগুলো হচ্ছে-
এক. রুশ কূটনীতিকদের বহিষ্কারের ঘটনায় ইউরোপে রুশ গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে যাবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র তথা সামরিক কূটনীতির ক্ষেত্রে এ গোয়েন্দা সংস্থা (এসভিআরআরএফ) একটি বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এসভিআরআরএফ কেজিবির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন এক সময় কেজিবির শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে পুতিনের হাতকে অনেক দুর্বল করবে। তবে ভুলে গেলে চলবে না পুতিন সম্প্রতি ছয় বছরের জন্য আবারও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। সুতরাং এ ঘটনার এখানেই যে সমাপ্তি ঘটবে তা বলা যাবে না।
দুই. এ ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ইউক্রেন, রাশিয়া এবং সেইসঙ্গে সাইবার আক্রমণের ঘটনাবলী। পাঠক স্মরণ করতে পারেন ২০১৪ সালের ঘটনাবলী। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়ার সেনাবাহিনী। যদিও পরবর্তী সময়ে ক্রিমিয়ার জনগণ গণভোটে রাশিয়ার সঙ্গে এ সংযুক্তিকে সমর্থন করেছিল। কৃষ্ণসাগরের পাশে ক্রিমিয়া অবস্থিত এবং রাশিয়ার নৌবাহিনীর জন্য ক্রিমিয়ার অবস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সংযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবে মেনে নেয়নি। ক্রিমিয়া ছিল ইউক্রেনের অংশ। এখানে ২০১৪ সালে তথাকথিত গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ সরকারের পতন ঘটে। অভিযোগ আছে, ইয়ানোকোভিচ যিনি ছিলেন অনেকটা মস্কো-ঘেঁষা, তার উৎখাতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। প্রেট্রো প্রোসেনকো এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। একজন ধনী ব্যবসায়ী প্রোসেনকো পশ্চিমা-ঘেঁষা। মস্কোর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। পূর্ব ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক খারাপ। কেননা ইউক্রেন মনে করে রাশিয়ার মদদে পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। পূর্ব ইউক্রেন অনেকটা ক্রিমিয়ার মতো রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি চায়।
যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। রাশিয়ার এখানেই আপত্তি। যদি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে ইউক্রেনের মাটিতে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে, যা রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের হুমকি বলে রাশিয়া মনে করে। রাশিয়ার আপত্তিটা সে কারণেই। যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই এ এলাকায় রাশিয়ার ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছে। একইসঙ্গে সিরিয়ায় রাশিয়ার ভূমিকাকেও ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। এটা তো স্পষ্ট রাশিয়ার হস্তক্ষেপে (বিমান হামলা) সিরিয়া থেকে আইএস বিতাড়িত হয়েছে। আবার সিরিয়ায় আসাদ সরকারও টিকে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রাশিয়ার বিমান হামলায় আসাদবিরোধী শক্তিও (যারা আইএসএ’র বিরুদ্ধেও যুক্ত করেছিল) ধ্বংস হয়ে গেছে। রাশিয়া আসাদের পক্ষ অবলম্বন না করলে, সিরিয়ার পরিস্থিতি আজ অন্যরকম হতো। এ অঞ্চলজুড়ে রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক একটা অক্ষ গড়ে উঠছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরোধী। সঙ্গত কারণেই রাশিয়ার ভূমিকাকে খুব ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে ট্রাম্প নাটকীয়ভাবে বিজয়ী হন, তাতে রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল- এটা এখন প্রকাশ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে এবং ওয়াশিংটনে এটা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। ফলে ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয়ের পর ট্রাম্পের প্রো-রাশিয়া বক্তব্য থেকে মনে করা হয়েছিল ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার কাছাকাছি নিয়ে যাবেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সেই অবস্থান থেকে একটা ‘ইউটার্ন’ নিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি এখন অনেকটাই রাশিয়াকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান, সিরিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা রাশিয়ার স্বার্থকে আঘাত করছে।
পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী রাশিয়া ১৫০ বিদেশি কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে, যার মধ্যে ৬০ জন হচ্ছেন মার্কিন কূটনীতিক। এদের এখন মস্কো ছাড়তে হবে। এখন স্পষ্টতই একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপ ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করায় এ দেশগুলো এখন ‘রাশিয়ার জ্বালানি বয়কটের’ মুখে পড়তে পারে। অনেকেই জানেন পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তিনটি পাইপলাইনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে রাশিয়ার গ্যাস এখন পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিম ইউরোপে যায়। ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানির জন্য এখন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া যদি এ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ইউরোপ।
কী হতে পারে এখন? পল ক্রেইগ রবার্টস লিখেছেন, On the verse of Nuclear War? এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হল? এটা তার আশঙ্কা। ফিনিয়ান কুনিনহাম লিখেছেন। Skripal Poison sage just another Episode in Wests propaganda campaign to Corral Russia অর্থাৎ এটা এক ধরনের রাশিয়াবিরোধী প্রোপাগান্ডা। ‘Corral’ বলছেন কুনিনহাম- রাশিয়াকে খোঁয়াড়ে নিক্ষেপ করল। তবে একটি ভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ৩০ মার্চ ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে। লিখেছেন অড আর্নে ওয়েসটাড (Odd arne westad)- প্রবন্ধের শিরোনাম Has a nwe cold war Really Begun? নতুন করে কি স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হল? এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা।
নয়া স্নায়ুযুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেল? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা এটাকে ব্যাখ্যা করেছেন স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে। বোঝাই যাচ্ছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। উত্তেজনা রয়েছে। এ উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে কোন দিকে নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Jugantor
02.04.2018
0 comments:
Post a Comment