এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই উত্তর কোরিয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে অষ্টম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপােের এ অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। এরপর থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া অবিলম্বে তার ইয়ংবাইওনে (Yongbyon)পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমাবিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ছয় থেকে দশটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া ৫০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এরপর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া যান এবং সেখানকার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের (বর্তমানে প্রয়াত) সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এ অঞ্চলের গেল ৫৩ বছরের রাজনীতিতে ওই ঘটনা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে আর দুই কোরিয়ার নেতারা কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টা’র জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চালু রয়েছে, আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দু-ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী ও অপর অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়ায়ই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেধে যায়। জাতিসংঘ এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় ২ বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এরপর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিবলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গেল ৭০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে দুইবারÑ ১৯৯৪ সালে কিম উল সুংয়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন কিম জং ইল অসুস্থ ছিলেন। তার মৃত্যুর পর এখন তার ছোট সন্তান কিম জং উনকে সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি যদি দায়িত্ব পালনকালে দুই কোরিয়ার একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন, সেটা হবে একুশ শতকের শুরুতে একটি বড় ধরনের ঘটনা। তবে যে-কোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ সেখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। উত্তর কোরিয়া তাদের প্রধান পরমাণু স্থাপনা ছাড়াও গোপনে আরও কয়েকটি স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে উত্তর কোরিয়া আরও পরমাণু পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনাও করছে। এজন্য তারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। এ হারে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হলে আগামী (২০১৮) মে মাস নাগাদ প্রয়োজনীয় এক হাজার মিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শেষ হবে। এর অর্থ হচ্ছে উত্তর কোরিয়া আরও পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। এতে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না; যুদ্ধ হবে কি না বলা মুশকিল। কেননা উত্তর কোরিয়া যেখানে বড় ধরনের খাদ্য সংকটের মুখে, সেখানে তারা এত বড় ঝুঁকি কি নেবে? উত্তেজনা জিইয়ে রেখে তারা সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। ইতোমধ্যে উত্তর কোরিয়া সেখানে একটি হাইড্রোজের বোমারও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু চীন। চীন যদি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া ‘একা’ হয়ে পড়বে। তখন আলোচনায় যাওয়া ছাড়া তার কোনো বিকল্প থাকবে না। উত্তর কোরিয়া বারবার বলে আসছে, তার পারমাণবিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু পশ্চিমাবিশ্ব এবং দক্ষিণ কোরিয়া এই কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও একইসঙ্গে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের হুমকিতে এ অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়াগামী সব বিমান ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল চীন। এখনও তা বহাল আছে। উত্তর কোরিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং উনের ভূমিকার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন পশ্চিমাবিশ্বÑ এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। উন কিছুটা খ্যাপাটে ধরনের। নিজের ক্ষমতা কুক্সিক্ষগত করতে তিনি নিজ আত্মীয়স্বজন, সৎভাইকে ‘খুন’ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি তাকে পরিপূর্ণ সম্মান না দেওয়ায় সিনিয়র জেনারেল ও সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রীকে পর্যন্ত তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়েছিলেন। এমনই একজন খ্যাপাটে ব্যক্তি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ কিংবা কোরিয়ার একত্রীকরণের লক্ষ্যে আদৌ কোনো সমঝোতায় উপনীত হবেন, এটা বিশ্বাস করা যায় না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কিছু ভূমিকা নতুন করে আবার প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিকার অর্থেই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে’ যেতে চায়? ট্রাম্প তার প্রশাসনে কট্টরপন্থিদের নিয়োগ দিয়েছেন। এরা যুদ্ধ চায়। যুদ্ধ মানেই মার্কিন অর্থনীতির চাঙাভাব। ফলে প্রস্তাবিত ট্রাম্প-কিম আলোচনায় কোন বিষয়টি স্থান পাবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প-কিম আলোচনার গুরুত্ব অনেক। বিশ্বে উত্তেজনা বাড়ছে। নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। কোরিয়া উপদ্বীপ হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে পারমাণবিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। এক্ষেত্রে কিম জং উনের চীন সফর, আগামী ২৭ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের সঙ্গে বৈঠক এবং আগামী মে মাসে ট্রম্প-কিম বৈঠকের সম্ভাবনা এ অঞ্চলে উত্তেজনা হ্রাস করতে সাহায্য করবে। অঞ্চলের মানুষ এটাই প্রত্যাশা করছে।
Daily Alokito bangladesh
01.04.2018
0 comments:
Post a Comment