Diversity and co-existence of Religions in Germany প্রোগ্রামের আওতায় জার্মান সরকার বাংলাদেশের কয়েকজন শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও মিডিয়া তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা একটিভ তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমরা মোট ছয়জন ছিলাম।
আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে জার্মান সরকার সেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের একই জায়গায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। দেখেছি কীভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা ছিল এক ধরনের শিক্ষা সফর। দেখেছি পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কীভাবে মসজিদ, গির্জা, আর ইহুদি উপাসনালয়গুলো একসঙ্গে কাজ করে। কোনো বিরোধ নেই, কোনো ধর্মীয় উন্মাদনা নেই। যে যার মতো ধর্ম চর্চা করে যাচ্ছেন। এমনকি সব ধর্মকে এক পতাকাতলে আনার একটি উদ্যোগও আমরা লক্ষ্য করেছি। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে আজকের জার্মানি। এজন্য চ্যান্সেলর মার্কেল নিশ্চয়ই কৃতিত্ব নিতে পারেন। তিনি তা প্রাপ্যও বটে। ২০১৫ সালের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে পারেন অনেকে, যখন লাখ লাখ সিরীয় অভিবাসী ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। শত শত শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছিল ভূমধ্যসাগরে, যার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ কোনোদিন দিতে পারবে না। শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণীদের সেসব দৃশ্য, বনে-জঙ্গলে, পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল দূরে অবস্থিত কোনো আশ্রয় কেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া- আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কারণে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছিল।
এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন ইউরোপে। অনেক রাষ্ট্র সেদিন সিরীয় শরণার্থীদের প্রবেশ করতে দেয়নি- যুক্তি একটাই- এরা মুসলমান, এরা প্রবেশ করলে খ্রিস্টীয় সমাজে বড় ধরনের ভারসাম্যের সৃষ্টি হবে। এমন কথাও বলা হয়েছিল যে, শুধু যারা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তাদের গ্রহণ করা হবে। সারা ইউরোপে সেদিন এন্টি-মুসলমান একটা স্রোত বয়ে গিয়েছিল। সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন এঞ্জেলা মার্কেল। তিনি জানতেন সিরীয় মুসলমান শরণার্থীদের আশ্রয় দিলে তিনি একটি রাজনৈতিক ঝুঁকির মুখে থাকবেন।
কেননা এর পরপরই ছিল জার্মানির সাধারণ নির্বাচন। সারা ইউরোপ যখন সিরিয়ার মুসলমানদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন এঞ্জেলা মার্কেলের সরকার ১০ লাখ শরণার্থীকে তার দেশে আশ্রয় দিয়েছিল। কাজটি সহজ ছিল না।
তিনি রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু মানবিকতার অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। জার্মান সরকার এদের শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, বরং তারা উদ্যোগ নিয়েছে ওইসব শরণার্থীকে জার্মান সমাজের সঙ্গে ‘ইন্টিগ্রেট’ বা অন্তর্ভুক্ত করতে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যাতে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে, সব ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারে- জার্মান সরকারের এমন উদ্যোগও প্রশংসা পেয়েছে সর্বত্র। এ সফরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এ ধরনের একটি শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায়। বার্লিনের Reinickendorf এ আমরা শরণার্থী কমিশনার তথা শরণার্থী প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গেও। তারা জানিয়েছেন কীভাবে ওই সংকটকালীন সময়ে তারা সিরীয় শরণার্থীদের জন্য বাসস্থান ও শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। এ বিষয়ে শরণার্থী সমন্বয়ক অলিভার রাবিস আমাদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একটি ছোট্ট গ্রামের পরিত্যক্ত ভবনগুলোতে তারা কীভাবে শরণার্থীদের বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন, সে ব্যাপারেও তারা আমাদের জানিয়েছেন। শরণার্থী সমস্যা নিয়ে জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গেও আমাদের সংলাপ হয়েছে।
সেই সংলাপ ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ, একটি আইনি কাঠামোয় আনা, তাদের আগ্রহ ও সহযোগিতার মনোভাব তারা বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কাজটি সম্পন্ন করা অত সহজ ছিল না। এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে একটি ‘ডাটাবেজ’-এর আওতায় আনা, জার্মানির সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা- ইত্যাদি কাজগুলো তারা নিরলসভাবে করে গেছেন মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে।
সংলাপে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত জার্মান আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মিসেস রাবেয়া হাথাওয়ে, যিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫ সালে জার্মানিতে ৮৯০০০০ শরণার্থী রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিল। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা কমে এসে দাঁড়ায় ২৮০০০০ এ। আর ২০১৭ সালে মাত্র ১৮৬৬৪৪ জন আবেদন করেছে।
আবেদনকারীর একটা বড় অংশ সিরিয়ার নাগরিক। এরপর ইরাক, আফগানিস্তান ও ইরিত্রিয়ার স্থান। Reinickendorf এ আমাদের সঙ্গে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন শরণার্থী হিসেবে আসা একজন সিরিয়ার আইনজীবী, যিনি এখন জার্মানিতে কমিউনিটি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। শরণার্থীদের ব্যাপারে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আদম পাচারকারীরা সক্রিয়। এরা ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে টাকার বিনিময়ে শরণার্থীদের জার্মানিতে নিয়ে আসছেন।
CUCULA নামে একটি সংগঠন বার্লিনে শরণার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। মিস জেসি মেদারনাক আমাদের জানিয়েছিলেন শরণার্থীদের জার্মানির মূল ধারায় মিশতে হলে তাদের প্রশিক্ষণ দরকার। এজন্য তারা তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে নানাবিধ উদ্যোগ নিচ্ছেন। এখানেই পরিচয় হয়েছিল সিরিয়া থেকে আসা এক তরুণের, যিনি কাঠমিস্ত্রি, এখন অন্য তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
আমাকে জানালেন ৫ হাজার ইউরোর বিনিময়ে আদম পাচারকারীরা তাকে বার্লিনে পৌঁছে দিয়েছে। জার্মান সরকারের মানবিকতার বিষয়টি তখনই ফুটে উঠে, যখন তারা সবকিছু জেনেও সিরীয় শরণার্থীদের সে দেশে থাকতে দিয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তারা করেছেন। বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন। আমাদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল The House of owe এ যাওয়ার এবং তাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগের কথা শোনার। House of owe হচ্ছে তিনটি ধর্মের (ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদিবাদ) একটি মিলনস্থল। যেখানে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করার খবর আমরা জানি, যেখানে ইহুদি ধর্ম আর ইসলাম ধর্মের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও বিভেদ ফিলিস্তিন সংকটকে গভীর থেকে গভীরতর করেছে, সেখানে জার্মানিতে এ তিনটি ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
একটি প্রজেক্টের আওতায় একই জায়গায় তিন ধর্মের উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য বিপুল অর্থ আসবে বেসরকারি খাত থেকে ও ব্যক্তিগত দান থেকে। প্রজেক্টের স্থান আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন ইমাম ওসমান ওরস।
একই ভবনে তিন ধর্মের মিলনমেলা। থাকবে আলাদা আলাদা লাইব্রেরি। বহুতল ভবন হবে এটি। আগামী বছর শুরু হবে কাজ। ওরা এর নামকরণ করেছে House of one। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ রকমটি আছে কিনা আমার জানা নেই। House of one আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল জেরুজালেমের কথা। এ জেরুজালেম শহরেই তিন ধর্মের- ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদিবাদের ধর্মীয় স্থাপনা আছে। জার্মানিতে, বার্লিনে এমনটাই হতে যাচ্ছে। তবে পার্থক্যটি হল একই ভবনে হতে যাচ্ছে তিন ধর্মের ধর্মস্থান, মসজিদ, গির্জা আর সিনোগোগ। বার্লিনে থাকাকালীন আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মসজিদ, সিনোগোগ আর গির্জায়। একটি সিনোগোগে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গাইড জোচিন শেফার আমাদের জানিয়েছিলেন ওই সিনোগোগটি যা কয়েকশ’ বছরের পুরনো, তা হিটলারের সময় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল।
অনেক দিন থেকেই তা আবার চালু হয়েছে। দুটি মসজিদে আমরা গিয়েছিলাম- একটি আরবি মসজিদ, অপরটি তুর্কি মসজিদ। মসজিদগুলো সবার জন্যই উন্মুক্ত। আরবি মসজিদের ভেতরকার কারুকার্য চোখে দেখার মতো। কয়েক মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছে এ মসজিদটি তৈরি করতে। এখানে জার্মান সরকারের কোনো আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় না। সৌদি আরব বা কোনো আরব দেশ থেকেও কোনো সাহায্য আসে না। চাঁদায় ও দানে চলে এ মসজিদ।
অন্যদিকে তুর্কি মসজিদের জন্য জমি দিয়েছিল জার্মান সরকার। তুর্কি নাগরিকদের দানেই চলে মসজিদটি। তবে তুরস্ক সরকার একজন ইমামকে এখানে পাঠান। তিনি ধর্মীয় কর্তব্যগুলো পালন করেন। তুরস্ক সরকার তাকে বেতন দেয়। নির্দিষ্ট সময় পর তিনি তুরস্কে ফিরে যান। তখন আরেকজন আসেন। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন এক তরুণ তুর্কি দম্পতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল, যারা মসজিদে বিয়ে করতে এসেছেন। সাবেক পূর্ব জার্মানির ব্রান্ডেনবুর্গ (Brandenburg) শহরে ব্রান্ডেনবুর্গ ক্যাথেড্রাল দেখতে যাওয়া ছিল আমাদের জন্য অনেক অভিজ্ঞতার।
বার্লিন শহর থেকে প্রায় দেড়-দু’ঘণ্টার জার্নি। সাবেক সমাজতান্ত্রিক শাসনামলেও এ ক্যাথেড্রালটি খোলা ছিল। পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি এটাকে বন্ধ করে দেয়নি। তবে মানুষ আসত কম, এ কথা জানালেন ক্যাথেড্রালের একজন কর্মী। এখানে একটি মিউজিয়ামও আছে। পুরনো অনেক ধর্মীয় ঐতিহ্য এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কয়েকশ’ বছরের পুরনো এ ক্যাথেড্রালের মিউজিয়ামে কয়েকশ’ বছরের আগের রাজাদের চিঠিও সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কিউরেটর ড. কর্ড-জর্জ হাসেলম্যান আমাদের পূর্ব জার্মানির ঐতিহ্যে দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে তিনি জানেন এবং মাস্টার্স পর্যায়ে বাংলাদেশের নগর ব্যবস্থাপনা নিয়ে তার থিসিস লেখার অভিজ্ঞতা আছে- এ কথাটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। চমৎকার মিশুক মানুষ। অত্যন্ত হৃদ্যতার সঙ্গে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ব্রান্ডেনবুর্গ শহর অতীতে উপেক্ষিত ছিল। এখানে কোনো শিল্প-কারখানা নেই। ফলে তরুণ প্রজন্ম চলে যায় শিল্পোন্নত শহরগুলোতে। পুরনো শহর।
ছোট ছোট রাস্তা। পরিবেশবান্ধব। শহুরে জীবনের ছোঁয়া এখানে পাওয়া যায় না। কিন্তু ছিমছাম। শান্ত। কিছুটা দারিদ্র্যের ছাপও লক্ষ্য করলাম। পুরনো বাড়িগুলোর সংস্কারও হয়নি তেমন। তবে একটা মজার কথা শুনলাম অনেকের কাছ থেকেই। গির্জা সদস্য সংখ্যা দিন দিন কমছে। প্রতিটি জার্মান নাগরিককে চার্চ কর দিতে হয়, যদি তিনি কোনো গির্জার সদস্য হন। সদস্য না হলে কর দিতে হয় না। চার্চের সদস্য না হওয়ার পেছনে এটা কোনো কারণ কীনা, এর জবাব কেউ আমাকে দিতে পারলেন না। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও আন্তঃধর্ম সম্পর্ক বৃদ্ধিকে জার্মান সরকার যে কত গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ আমরা পেলাম জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে। সেখানে একটি টাস্কফোর্স পর্যন্ত গঠন করা হয়েছে (Responsibility of the Religions for Peace)। এই টাস্কফার্সের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ মতবিনিময় হয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ম কী ভূমিকা পালন করে, আমরা তা বলেছি। টাস্কফোর্সের প্রধান ক্রিস্টোফ রোমহিল্ড একজন ফাদার।
তাকে সহযোগিতা করছেন কূটনৈতিক কোরের সদস্য ড. সিলকে লেসনার ও টিমবার্সাট। আলোচনায় তারা জানালেন ধর্মকে তারা গুরুত্ব দেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সংহতি স্থাপন, সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই তাদের কাজ। জার্মান পররাষ্ট্রনীতির এটি একটি দিক। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। ধর্মীয় সম্প্রীতি এখানে অত্যন্ত শক্তিশালী। এটা জার্মান সরকার অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখে।
লাঞ্চে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক গেহার্ড আলমারের সঙ্গে। এক চমৎকার মানুষ তিনি। বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা ডেস্কের প্রধান তিনি। বার্লিনের ভারডারসার মার্কেট-১ এ অবস্থিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুরনো ভবনের ছাদে আমাদের নিয়ে গেলেন মি. আলমার। সেখান থেকে দেখালেন বার্লিন শহরকে। আমার জার্মান ভাষা শুনে তিনি আমাকে প্রশংসাও করেছিলেন। বিপুলসংখ্যক মুসলমান ধর্মাবলম্বী সিরীয় শরণার্থীদের জার্মানিতে উপস্থিতি জার্মানির রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে কিছুটা বদলে দিলেও জার্মান সরকারের সুস্পষ্ট নীতির কারণে সেখানে সমাজে বড় কোনো প্রতিক্রিয়া পড়েনি। জার্মান সরকারের নীতির মূল কথাই হচ্ছে ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন ধর্মের মাঝে সহাবস্থান। এ নীতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর সে কারণেই, এঞ্জেলা মার্কেল এত বেশি জনপ্রিয়। তিনি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে শরণার্থীদের আটকে দেননি (যা অনেক ইউরোপীয় দেশ করেছে), বরং মানবিকতার মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমরা খুব কাছ থেকে বদলে যাওয়া জার্মানিকে দেখলাম। দুই বার্লিন এখন এক শহর। শহরটি বড় হয়েছে। এটি একটি বড় আন্তর্জাতিক শহরে পরিণত হয়েছে। পূর্ব বার্লিনে সেই বিখ্যাত বার্লিন দেয়ালের ভগ্নাংশ এখন সেভাবেই রেখে দেয়া হয়েছে। তারা এটা সংরক্ষণ করেছে। বার্লিন দেয়ালে ম্যুরাল আঁকার জন্য তারা বিশ্বের বড় বড় আর্টিস্টদের বার্লিনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারা যে ছবি এঁকেছেন, তা দেখার মতো। একটি ছবিতে দেখলাম ব্যঙ্গ করে রিগ্যান-গরবাচেভের চুমু খাবার ছবিও আঁকা হয়েছে। পূর্ব বার্লিনে এখনও সেই কনডোনিয়ামগুলো আছে। বৃহৎ জনশক্তিকে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার জন্য দুই রুমের (এক বাথরুম) শত শত উঁচু ভবন তৈরি করা হয়েছিল। সেই ভবনগুলো এখনও তেমনি আছে। তেমনি একটি ভবনে আমার ছাত্র আল আমিন ও তার স্ত্রীর আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম দু’দিনের জন্য। দুই জার্মানির একত্রীকরণের পর অ্যাপার্টমেন্টগুলো বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। জার্মানি এখন এনার্জি ‘সেভ’ করছে। এটাও আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।
ইউরোপের রাজনীতিতে জার্মানির প্রভাব পড়ছে। ইউরোপে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতি বাড়লেও, কোনো কোনো দেশে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল (ফ্রান্স), জার্মানিতে তেমনটি হয়নি। মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৪ দশমকি ৪ ভাগ। ফলে এখানে মুসলমানদের নিয়ে তেমন কোনো সংকট নেই। শতকরা ২৯ ভাগ রোমান ক্যাথলিক, শতকরা ২৭ ভাগ প্রোটেসটানদের দেশ জার্মানিতে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহাবস্থান একটি বড় উদাহরণ। আমাদের জার্মানি সফরের সময় সরকারি কর্মকর্তা, গির্জা ও মসজিদ পরিচালনাকারী এবং সেই সঙ্গে এনজিও গ্রুপগুলোর সঙ্গে আলোচনায় আমার মনে হয়েছে জার্মানি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বিভিন্ন ধর্মের মাঝে সহাবস্থান ও সম্প্রীতির যে উদ্যোগ নিয়েছে, এটাই সঠিক নীতি। এ সঠিক নীতিই ইউরোপে জঙ্গিবাদকে নিরুৎসাহিত করবে।
Daily Jugantor
09.04.2018
0 comments:
Post a Comment