রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিরিয়া : যে যুদ্ধের শেষ নেই



গত ১৪ এপ্রিল সিরিয়ার তিনটি রাসায়নিক অস্ত্রাগারে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সে দেশে ‘চতুর্থ যুদ্ধ’ এর সূচনা করেছিলেন কিনা, সে ব্যাপারে এখনও কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা ১৪ এপ্রিলের পর আর কোনো বিমান হামলার ঘটনা ঘটেনি। রাশিয়া স্পষ্টই এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। তবে রাশিয়ার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র (সেই সঙ্গে ফ্রান্স ও ব্রিটেন) বিমান হামলা বন্ধ রেখেছে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। যারা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিনি নীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান টার্গেট হচ্ছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ। যে-কোনো মূল্যে তাকে তিনি সরাতে চান। এজন্য একটি দীর্ঘ ‘যুদ্ধ’ এর সম্ভাবনাকেও একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ১৯৯১ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করে নিয়েছিল, তখন আরববিশ্বে ‘প্রথম যুদ্ধ’ শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করেছিল ইরাক। সেটা ছিল ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’। আর ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় জ্বলে উঠেছিল লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি। সেটা ছিল ‘তৃতীয় যুদ্ধ’। আর এখন ‘ক্ষেত্র’ প্রস্তুত হচ্ছে ‘চতুর্থ যুদ্ধ’ এর। ইরাকের কাছে মারাত্মক সব মারণাস্ত্র রয়েছে, সেই অভিযোগ তুলে ইরাক দখল হয়ে গিয়েছিল। ২০১১ সালে লিবিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছেÑ এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে দীর্ঘ বোমা হামলা চালিয়ে গাদ্দাফি সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল। আর এখন সিরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আসাদ সরকার নিজ জনগণের ওপর দৌমায় রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে! সেখানে রাসায়নিক হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কে এই হামলা চালিয়েছেÑ আসাদ সরকারের সেনাবাহিনী, নাকি ইসরাইল? রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার আঙুল কিন্তু ইসরাইলের দিকেই।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার কথিত হস্তক্ষেপ, ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি, পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে রাশিয়ার সমর্থন, লন্ডনের স্যালিসব্যারিতে ‘ডাবল এজেন্ট’ স্কিরপালকে হত্যা প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের কূটনীতিকদের বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে টান টান উত্তেজনা বজায় রয়েছে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো সিরিয়া প্রসঙ্গ। ফলে সামগ্রিক বিচারে অনেকেই এই পরিস্থিতিকে স্নায়ুযুদ্ধের নয়া সূচনা হিসেবে অভিহিত করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস এ ধরনের একটি কথাই বলেছেন। সিরিয়ার পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। অনেকগুলো পক্ষ এই সংকটে জড়িয়ে গেছে। ইসরাইলের একটি ভূমিকাও এতে আছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ নিজেই বলেছেন, সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলার যে প্লট সাজানো হয়েছে এবং যার মাধ্যমে আসাদ সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তার সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত। তার কাছে এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। দৌমায় যে রসায়নিক বোমা হামলা চালানো হয়েছিল এবং যাতে ৪০ জন সিরীয় নাগরিকের মৃত্যু, যাদের অনেকেই ছিল শিশুÑ সেই হামলার সঙ্গে সিরিয়ার সেনাবাহিনী কি আদৌ জড়িত ছিল? এটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এই যুক্তি তুলে ধরে সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হলো। অথচ অভিযোগ আছে, এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নেই। এমনকি ব্রিটেনের পার্লামেন্টেও ব্রিটেনের বিমান হামলার কোনো অনুমতি ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো প্রেসিডেন্ট নিজে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন না। এজন্য তার কংগ্রেসের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তা করেননি। তবে ট্রাম্পের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যানদের অনেকেই আসাদবিরোধী। ফলে কংগ্রেসের সমর্থন তিনি পাবেন। তবে এই ‘যুদ্ধ’ সিরিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিল। সিরিয়া সংকটের সমাধানের পথে এলো এখন বড় অনিশ্চয়তা। তবে এটা এখনও নিশ্চিত নয়, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মেরিন সেনা পাঠাবে কি না। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল ২০০৩ সালে। কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে যখন উৎখাতের উদ্যোগ নেওয়া হয় (২০১৩), তখন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সেনা পাঠায়নি। বিমান হামলার মধ্য দিয়ে সেখানে গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়েছিল। ‘আরব বসন্ত’পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিতে ‘রেজিম চেঞ্জ’ এর একটি ধারণা আছে অর্থাৎ ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করা। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে বলেই ধারণা অনেকের। 
তাহলে সমাধানটা হবে কীভাবে? সিরিয়ার পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই জটিল হয়ে পড়েছে। এখানে কার্যত দুইটি বড় শক্তির অবস্থান পরস্পরবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টই কুর্দিদের নিয়ে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চায়। অর্থাৎ আসাদবিরোধী একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে তুরস্কের সমর্থন না পাওয়া। কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থান ও সমর্থন তুরস্ক ভালো চোখে দেখছে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব কমানো। এক্ষেত্রে সুন্নি ধর্মাবলম্বী তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল মিত্র হতে পারত; কিন্তু তা হয়নি। বরং তুরস্ক ও ইরান এক ধরনের অ্যালায়েন্সে গেছে। রাশিয়া আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল; কিন্তু রাশিয়া চায় না আসাদ অপসারিত হোক। আসাদকে রেখেই রাশিয়া একধরনের সমাধান চায়। এখানে তুরস্কের আপত্তি থাকলেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুরস্ক আজ রাশিয়ার মিত্র। রাশিয়া নিজ উদ্যোগে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে চায়। সেজন্যই সোচিতে সিরিয়ার সব দল ও মতের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেছিল রাশিয়া, যাকে তারা বলছে ‘সিরিয়ান কংগ্রেস অব ন্যাশনাল ডায়ালগ’। কিন্তু সেখানেও বিরোধ আছে। নানা মত ও পক্ষের প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও একটা বড় অংশ এতে অংশ নেয়নি। সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ ‘সিরিয়ান নেগোসিয়েশন কমিশন’ এ সম্মেলনে অংশ নেয়নি। সিরিয়া সংকটের মূলে রয়েছে সব মত ও পথকে একটি কাঠামোয় আনা। সেখানে সুন্নি, শিয়া, দুর্জ, আলাউট মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন সামরিক গ্রুপও রয়েছে। আসাদ সমর্থকরাও একটি পক্ষ। কিছু ইসলামিক গ্রুপও রয়েছে, যারা আইএসএর বিরোধিতা করেছিল। সবাইকে নিয়ে একটি সমাধান বের করা সহজ কাজ নয়। যদিও সোচিতে সবাই সিরিয়ার অখ-তা রক্ষায় একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ধারা ও নির্বাচনের প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন। তারপরও কথা থেকে যায়Ñ বড় বিরোধী দলের অবর্তমানে এই সমঝোতা আদৌ কাজ করবে কি না।
যুক্তরাষ্ট্রের এই বিমান হামলা স্পষ্টই আসাদকে উৎখাত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের। তখন নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছিলÑ  Humanitariam Intervention অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায় সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ অনুমোদন দেয়নি ইরাক আক্রমণের। তবে নিরাপত্তা পরিষদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল; তাতে বলা হয়েছিল ‘প্রয়োজনীয় বিধিব্যবস্থা’ গ্রহণ করার। আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যায় এই ‘প্রয়োজনীয় বিধিব্যবস্থা’ কোনো পর্যায়েই যুদ্ধকে সমর্থন করে না। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন লিবিয়া আক্রমণ করল, তখনও কোনো সমর্থন ছিল না নিরাপত্তা পরিষদের। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছেÑ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। কিন্তু সেই অনুমোদন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে ও লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু করেছিল। লিবিয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল একটি তত্ত্ব ঐঁ Humanitariam Intervention। আর সিরিয়ার ক্ষেত্রে এখন ব্যবহৃত হতে পারে Responsibility to protect তত্ত্ব। অর্থাৎ বাংলা করলে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে মানবতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। সিরিয়ায় অতীতেও ওই ধরনের রাসায়নিক হামলার খবর আমরা জানি। জাতিসংঘের টিমকে পর্যন্ত সেখানে পাঠানো হয়েছিল, যারা খুঁজে পায়নি কারা সেখানে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। 
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিঃসন্দেহে শুধু নিন্দনীয়ই নয়, বরং একটি অপরাধও। এখানে অনেকগুলো পক্ষ আছে, যারা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। আসাদ সরকারের সেনাবাহিনী যেমনি এটা করতে পারে, তেমনি বিদ্রোহী বাহিনীও এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এর আগে ২০১৩ সালেও এ রকম একটি অভিযোগ ছিল। ওই সময় রাশিয়া জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, সিরিয়ার বিদ্রোহী সৈন্যরাই এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান Global Research  ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলÑ সিরীয় সরকার নয়, বরং বিদ্রোহীদের হাত রয়েছে ওই রাসায়নিক অস্ত্রের হামলার পেছনে। এটাও সত্য, আসাদ বাহিনী যে এটা করতে পারবে না, তেমনিটও নয়। তারাও করতে পারে।
সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র আছেÑ এ অভিযোগ অনেক পুরানো। ২০১৩ সালে জেনেভায় লেভারড-কেরি একটি সমঝোতা হয়েছিল। ওই সমঝোতার কারণে সেখানে যুদ্ধ এড়ানো গেছে। ওই সমঝোতায় সিরিয়ায় রাসায়নিক তদন্তের হিসাব, অবস্থান, মজুত, অস্ত্রের ধরন, গবেষণা ইত্যাদি সম্পর্কে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কমিটি জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে একটি রিপোর্টও দিয়েছিলেন। ফলে ওই সময় আর যুদ্ধ হয়নি। এখানে বলা ভালো, ধারণা করা হয়, সিরিয়ায় মোট ৪০টি রাসায়নিক কারখানা অথবা এলাকা রয়েছে, যেখানে এসব অস্ত্র উৎপাদন করা হয়, অথবা তা সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন গ্যাস (সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাস) সিরিয়া সংরক্ষণ করেছে, এমন একটা কথা পশ্চিমা বিশ্বে চাউর হয়ে আছে। এসব গ্যাস ধ্বংস করা কঠিন কাজ। একজন গবেষক লিখেছেনÑ যুক্তরাষ্ট্র ২৮ বছর ধরেই তাদের কাছে রক্ষিত রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করে আসছে। কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। আরও একটা সমস্যা ছিল, কোন প্ল্যান্ট বা স্থানে তা ধ্বংস করা হবে! সিরিয়ায় তা করা যাবে না। সিরিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কোনো দেশে তা ধ্বংস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ১৩টি প্ল্যান্টের মধ্যে ৯টি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপের পরিবেশবাদীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা যে-কোনো পরিবহন ব্যবস্থায় (গ্যাস পরিবহন) প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলতে পারে। একমাত্র সম্ভাবনা ছিল রাশিয়ায়। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্কের কারণে সেটা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। ফলে একটি সমঝোতা হয়েছিল, কিন্তু তাতে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র সব ধ্বংস হয়েছে, তা বলা যাবে না।
পরিস্থিতি এখন কোনদিকে যাবে বলা মুশকিল। রাশিয়া সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও চূড়ান্ত বিচারে রাশিয়া এই ‘যুদ্ধে’ আদৌ জড়াবে না। এমনিতেই রাশিয়া নানাবিধ সংকটে আছেন এখন। ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করার পর জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। রাশিয়ার ওপর সীমিত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। তা এখনও বলবৎ আছে। ১৪ জুন থেকে রাশিয়ায় শুরু হচ্ছে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল। রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব যদি শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘর্ষের জন্ম দেয়, তাহলে বিশ্বকাপ ফুটবল ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। পশ্চিমা কিছু কিছু দেশ কিংবা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক দিতে পারেন! এ ধরনের একটি ঝুঁকি আছেই। ফলে প্রেসিডেন্ট পুতিন সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়াকে জড়িত করবেন না। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। সিরিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এই যুদ্ধ আবারও প্রমাণ করল যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থায়ই ‘যুদ্ধ’ থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। আফগান যুদ্ধ পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে, এটা বলা যাবে না। সেখানে ট্রাম্প আরও কিছু সেনা পাঠাতে চান। ট্রাম্পের সিরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ায় যুদ্ধের খরচ আরও বাড়বে। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, শুধু একটি টমহক মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্রের দাম ৮ লাখ ৩২ হাজার ডলার  (Invertopedia), তা-ও ১৯৯৯ সালের হিসাবে এর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান হিসাবে এর দাম আরও বেশি। সুতরাং যুদ্ধ যদি সেখানে প্রলম্বিত হয়, তাহলে মিসাইলের ব্যবহার বাড়বে। বাড়বে যুদ্ধের খরচ। Internaion Closing House (ICH) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গত ১৪ এপ্রিল ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের একটি খরচ দিয়েছে। এর পরিমাণ ৪৫ লাখ ৯২ কোটি ৯১ লাখ ৬১ হাজার ৮৯৬ ডলার (সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খরচ এতে ধরা হয়নি)। Nathal Priorities Project থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ICH  আরও উল্লেখ করেছেÑ ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হাতে মারা গিয়েছিলেন ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯০ ইরাকি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্য মারা গিয়েছিলেন ৪ হাজার ৮০১ জন। আফগানিস্তানে বিদেশি সেনা মারা গেছেন ৩ হাজার ৪৩০ জন। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয়, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি যেমন বাড়বে, বাড়বে যুদ্ধের খরচ। আর এই খরচ মেটাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ।
যুদ্ধ মানুষ চায় না। ইরাক, লিবিয়া কিংবা আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। যুদ্ধ সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে সেখানে অস্থিতিশীলতা বাড়বে বৈ কমবে না। ইতোমধ্যে পরিস্থিতির সেখানে আরও অবনতি হয়েছে। রাশিয়া সিরিয়ার মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এস-৩০০ মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সিরিয়ায় সরিয়ে নিয়েছে। এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শুধু মার্কিন টমহক মিসাইলকে ধ্বংসই করবে না, বরং ১২০ মাইল দূরে শক্ত স্থাপনার ওপর আঘাতও হানতে সম্ভব। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমেরিকার সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান (যার আওতায় রয়েছে সিরিয়া) জেনারেল জোসেফ ভোটেল ইসরাইল সফর করেছেন। ফলে স্পষ্টই সিরিয়ার সংকট একটি নতুন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একটি ‘সীমিত যুদ্ধ’ এর সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপে এ ধরনের একটি সীমিত যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। আজ এত বছর পর বিশ্ব সে রকম আরেকটি সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে।
Daily Alokito Bangladesh
29.04.2018

0 comments:

Post a Comment