আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ রুয়ান্ডা। দেশটি ল্যান্ড লকর্ড অর্থাৎ কোনো
সমুদ্রসীমা নেই। কয়েকটি দেশ রয়েছে এর সীমান্তে উগান্ডা, তানজানিয়া,
বুরুন্ডি, গণতান্ত্রিক কঙ্গো ও জায়ার। ১৯৪৪ সালে দুটি উপজাতি হুতু ও তুতসির
মধ্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের খবর সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কয়েক
লাখ মানুষ এ জাতিগত দ্বন্দ্বে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর জাতিগত উচ্ছেদ
অভিযানের শিকার হয়ে হুতু উপজাতির কয়েক লাখ মানুষ সেদিন পার্শ্ববর্তী পূর্ব
জায়ারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। রুয়ান্ডায় হুতু উপজাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ
শতকরা ৮৫ ভাগ, আর তুতসিরা শতকরা ১৪ ভাগ। তুতসি উপজাতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ
বুরুন্ডিতে। রুয়ান্ডার মতো এখানে হুতুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, তারা সংখ্যালঘু।
একসময় এ দেশ দুটি এক ছিল। বেলজিয়ামের কলোনি ছিল। ১৯৬২ সালে বেলজিয়াম
নিজেদের এখান থেকে প্রত্যাহার করে নিলে, দুটি রাষ্ট্র স্বাধীন রাষ্ট্র
হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন থেকেই শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। রুয়ান্ডায়
সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুরা চেষ্টা করেছে তুতসিদের উৎখাত করতে, অন্যদিকে
বুরুন্ডিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ তুতসিরা চেষ্টা করেছে সংখ্যালঘু হুতুদের উৎখাত
করতে। হুতু-তুতসি দ্বন্দ্বে দুই দেশের দুজন প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা
(রুয়ান্ডা), আর নাটারিয়ামিরা (বুরুন্ডি) একসঙ্গে বিমান দুর্ঘটনায় মারা
গিয়েছিলেন (এপ্রিল ১৯৯৪)। এরপর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এতে লাখ লাখ
মানুষকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যারা
হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের কারও কারও বিচার হয়েছে, কারও বা বিচার
এখনও চলছে। রুয়ান্ডায় গণহত্যায় উসকানি ও গণহত্যা সংঘটিত করার জন্য তিনজন
‘মিডিয়া যুগল’ নাহিমানা, হাস্সান নেজেজে এবং বাসকো বারাইয়াগভিজার বিচার
হয়েছিল। তাবা শহরের মেয়র জ্যা পল আকায়েসু জেন কামবানডারও (অন্তর্বর্তীকালীন
প্রধানমন্ত্রী) বিচার হয়েছিল। শুধু রুয়ান্ডা-বুরুন্ডিতে যারা হত্যাকা-
সংঘটিত করেছিল তাদেরই বিচার হয়েছে তেমন নয়; বরং ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব
কঙ্গো, উগান্ডা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, কেনিয়া, আইভরিকোস্ট, মালিসহ
সার্বিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এখন জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট
ফাইন্ডিং কমিটি মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা
কর্মকর্তাদের দায়ী করেছে। আইসিসিতে তাদের বিচারের দাবি উঠেছে। কিন্তু এটা
করা কি সম্ভব হবে?
বিষয়টি অত সহজ নয়। বৃহৎ শক্তির মাঝে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া এ চুক্তিতে (রোম স্ট্যাটিটিউট) স্বাক্ষর করেনি, যার মাধ্যমে আইসিসির জন্ম। বাংলাদেশসহ ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেছে। মিয়ানমার এর আওতাভুক্ত নয়, কেননা দেশটি রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর করেনি। এক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি অত সহজ হবে না। তবে মিয়ানমারকে ‘চাপে’ রাখার একটি কৌশল হতে পারে, যে ‘চাপ’-এ রাখার কথা জাতিসংঘ মহাসচিব বলে গিয়েছিলেন তার ঢাকা সফরের সময়। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরে (২০১৮) নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কাউকে কাউকে সম্ভাব্য একটি নিষেধাজ্ঞা (মিয়ানমারের বিরুদ্ধে) চেয়ে কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপনের বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুনেছি। বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে। কংগ্রেস বাংলাদেশ ককাস। সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস মতবিনিময় করতে পারে, এজন্য ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশ দূতাবাসকে আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইমপার্শিয়াল অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট মেকানিজম বা আইআইআইএমের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে পারে। ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ আইআইআইএম সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর আওতায় যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের ভবিষ্যৎ বিচারের জন্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। মূলত ২০১১ সালের পর থেকে সিরিয়ায় যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসব অপরাধকে বিবেচনায় নিয়েই আইআইআইএম গঠন করা হয়েছিল। যদিও এটি কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সংগঠনটির চেয়ারপারসন হচ্ছেন ফ্রান্সের একজন সাবেক বিচারপতি মিস মার্চি উল। ইরাকে ইসলামিক স্টেট কিংবা আল কায়দা যেসব অপরাধ সংঘটিত করেছে, সে ব্যাপারে তিনি অনুসন্ধান করেছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যাতে ভবিষ্যতে আইএস তথা আল কায়দার নেতাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়। এখন যেহেতু জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দল রাখাইনে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে মতামত দিয়েছে, সেহেতু রোহিঙ্গা প্রশ্নে আইআইআইএমকে এখন সক্রিয় করা যায়। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আইআইআইএমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস মতবিনিময় করতে পারে। আরও একটা কথা, জাতিসংঘের ওই রিপোর্টকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে চীন ও রাশিয়ায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। এরই মধ্যে ২৮ আগস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বিতর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথা বললেও নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বিতর্কে আবারও চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত উ হাইতাও বলেছেন, এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারÑ এ দুই দেশের সমস্যা। দ্বিপক্ষীয়ভাবেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতও চীনা বক্তব্য সমর্থন করেন। বাস্তবতা হচ্ছে, এটা এখন আর দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়, এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যেখানে সাড়ে ৭ লাখ নাগরিক (মোট প্রায় ১২ লাখ) নিজ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং অন্য দেশে আশ্রয় নেয়, তখন তা আর দ্বিপক্ষীয় সমস্যা থাকে না। বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কসোভো, রুয়ান্ডাতে যে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বড় ধরনের সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তা-ও কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সমস্যায় আটকে থাকেনি। আমাদের এখন কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অপরাধের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, তা প্রতিটি ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জন্য প্রযোজ্য। যেমনÑ রোম স্ট্যাটিটিউটের ৫নং ধারায় ‘অপরাধের’ কথা বলা হয়েছে। এই ‘অপরাধগুলো’ পরে আবার ৬, ৭ ও ৮নং ধারায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ৬নং ধারায় বলা হয়েছে, Genocide বা জাতিগত দ্বন্দ্বের কথা। ৭নং ধারায় বলা হয়েছে,Crime against humanity বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ৮নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘War crime and crimes of aggression এর কথা। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসন-সংক্রান্ত অপরাধ। আইসিসির প্রসিকিউটররা যদি মনে করেন ৬, ৭ ও ৮নং ধারা বলে কোনো একটি দেশে, কোনো একটি বিশেষ শ্রেণি ‘অপরাধ’ সংঘটন করেছেন, তাহলে তাদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সার্বিয়ার যুদ্ধবান নেতা রাদোভান কারাদজিক, লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলর, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা (অভিযাগ পরে প্রত্যাহার) সবার বিচার হয়েছিল উপরে উল্লিখিত ধারা বলে। ৬নং ধারায় Genocide বা গণহত্যার ক্ষেত্রে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট ‘অপরাধ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণির জনগোষ্ঠীতে হত্যা, তাদের মানসিক কষ্ট দেওয়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ জনগোষ্ঠীর লোকদের উচ্ছেদ, পরিকল্পিতভাবে এই জনগোষ্ঠীর জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের অন্যত্র স্থানান্তর ইত্যাদি। ৭নং ধারায় ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এ যেসব ‘অপরাধ’ ও অপরাধের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে খুন (Murder), পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা বা বিনাশ সাধন (Extermination), দাসত্ব ( Enslavement),, জোরপূর্বক বিতাড়ন (Deportation), অত্যাচার ( Torture ), ধর্ষণ ( Rape ), যৌন দাসত্ব (Enforced Prostitution ), বর্ণবাদী নীতি ( Crime of Apartheid ) ইত্যাদি। যুদ্ধাপরাধ (৮নং ধারা) ধারায় যেসব অপরাধের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সুপরিকল্পিত হত্যা ( Wilful Killing), অত্যাচার ( Torture of inhuman treatment ), অমানবিক আচরণ (Inhuman treatment ), বিচার অস্বীকার করা ( Right of fair and regular trial ), আইনবহির্ভূতভাবে বিতাড়ন (Unlawful deportation ), সম্পত্তি ধ্বংস করা (Destruction of property) ইত্যাদি।
এখন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইডিং কমিটির রিপোর্টের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে তারা মিয়ানমারে তাতমাদোর (মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর স্থানীয় নাম) যেসব ‘অপরাধ’ সংঘটিত করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন, সেসব ‘অপরাধ’ আইসিসি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেমন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বিচারে হত্যা, নারীদের গণধর্ষণ, শিশুদের হত্যা এবং পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে কখনোই সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করা যায় না। হত্যা, ধর্ষণ, শিশুহত্যা, রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি ‘অপরাধ’ আইসিসির ৬, ৭ ও ৮নং ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের অভিযুক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুপারিশ করেছে ওই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। প্রশ্নটা এখানেই নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের বিচারের সিদ্ধান্ত নেবে কি না? এর জবাব হচ্ছে ‘না’। চীন ও রাশিয়ার অনুমোদন এতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিচার সম্ভব। এজন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মিয়ানমারের গণহত্যা ও ধর্ষণের জন্য আইসিসির বাইরে আলাদা একটি অপরাধ আদালত গঠন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাবেক যুগোসøাভিয়া, রুয়ান্ডা ও কেনিয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল। ২৯ আগস্ট সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডসসহ আরও কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গাদের গণহত্যার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সুতরাং সাধারণ পরিষদকে আলাদাভাবে মিয়ানমারের জন্য একটি অপরাধ আদালত গঠন করতে হবে। আর উদ্যোগটা নিতে হবে জাতিসংঘের মহাসচিবকেই। আর এটা যদি করা না হয়, যদি ‘অপরাধ’ করেও জেনারেলরা মাফ পেয়ে যান, তাহলে পৃথিবীর অন্যত্র এ ধরনের অপরাধ আরও সংঘটিত হবে। সুতরাং জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থেই এ ধরনের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন।
Daily Alokito Bangladesh
02.09.2018
বিষয়টি অত সহজ নয়। বৃহৎ শক্তির মাঝে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া এ চুক্তিতে (রোম স্ট্যাটিটিউট) স্বাক্ষর করেনি, যার মাধ্যমে আইসিসির জন্ম। বাংলাদেশসহ ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করেছে। মিয়ানমার এর আওতাভুক্ত নয়, কেননা দেশটি রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর করেনি। এক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি অত সহজ হবে না। তবে মিয়ানমারকে ‘চাপে’ রাখার একটি কৌশল হতে পারে, যে ‘চাপ’-এ রাখার কথা জাতিসংঘ মহাসচিব বলে গিয়েছিলেন তার ঢাকা সফরের সময়। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরে (২০১৮) নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কাউকে কাউকে সম্ভাব্য একটি নিষেধাজ্ঞা (মিয়ানমারের বিরুদ্ধে) চেয়ে কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপনের বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুনেছি। বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে। কংগ্রেস বাংলাদেশ ককাস। সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস মতবিনিময় করতে পারে, এজন্য ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশ দূতাবাসকে আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইমপার্শিয়াল অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট মেকানিজম বা আইআইআইএমের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে পারে। ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ আইআইআইএম সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর আওতায় যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের ভবিষ্যৎ বিচারের জন্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। মূলত ২০১১ সালের পর থেকে সিরিয়ায় যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেসব অপরাধকে বিবেচনায় নিয়েই আইআইআইএম গঠন করা হয়েছিল। যদিও এটি কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সংগঠনটির চেয়ারপারসন হচ্ছেন ফ্রান্সের একজন সাবেক বিচারপতি মিস মার্চি উল। ইরাকে ইসলামিক স্টেট কিংবা আল কায়দা যেসব অপরাধ সংঘটিত করেছে, সে ব্যাপারে তিনি অনুসন্ধান করেছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যাতে ভবিষ্যতে আইএস তথা আল কায়দার নেতাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যায়। এখন যেহেতু জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দল রাখাইনে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে মতামত দিয়েছে, সেহেতু রোহিঙ্গা প্রশ্নে আইআইআইএমকে এখন সক্রিয় করা যায়। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আইআইআইএমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস মতবিনিময় করতে পারে। আরও একটা কথা, জাতিসংঘের ওই রিপোর্টকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে চীন ও রাশিয়ায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। এরই মধ্যে ২৮ আগস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বিতর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথা বললেও নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বিতর্কে আবারও চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত উ হাইতাও বলেছেন, এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারÑ এ দুই দেশের সমস্যা। দ্বিপক্ষীয়ভাবেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতও চীনা বক্তব্য সমর্থন করেন। বাস্তবতা হচ্ছে, এটা এখন আর দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়, এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যেখানে সাড়ে ৭ লাখ নাগরিক (মোট প্রায় ১২ লাখ) নিজ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং অন্য দেশে আশ্রয় নেয়, তখন তা আর দ্বিপক্ষীয় সমস্যা থাকে না। বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কসোভো, রুয়ান্ডাতে যে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বড় ধরনের সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তা-ও কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সমস্যায় আটকে থাকেনি। আমাদের এখন কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অপরাধের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, তা প্রতিটি ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জন্য প্রযোজ্য। যেমনÑ রোম স্ট্যাটিটিউটের ৫নং ধারায় ‘অপরাধের’ কথা বলা হয়েছে। এই ‘অপরাধগুলো’ পরে আবার ৬, ৭ ও ৮নং ধারায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ৬নং ধারায় বলা হয়েছে, Genocide বা জাতিগত দ্বন্দ্বের কথা। ৭নং ধারায় বলা হয়েছে,Crime against humanity বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ৮নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘War crime and crimes of aggression এর কথা। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসন-সংক্রান্ত অপরাধ। আইসিসির প্রসিকিউটররা যদি মনে করেন ৬, ৭ ও ৮নং ধারা বলে কোনো একটি দেশে, কোনো একটি বিশেষ শ্রেণি ‘অপরাধ’ সংঘটন করেছেন, তাহলে তাদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সার্বিয়ার যুদ্ধবান নেতা রাদোভান কারাদজিক, লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলর, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা (অভিযাগ পরে প্রত্যাহার) সবার বিচার হয়েছিল উপরে উল্লিখিত ধারা বলে। ৬নং ধারায় Genocide বা গণহত্যার ক্ষেত্রে পাঁচটি সুনির্দিষ্ট ‘অপরাধ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণির জনগোষ্ঠীতে হত্যা, তাদের মানসিক কষ্ট দেওয়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ জনগোষ্ঠীর লোকদের উচ্ছেদ, পরিকল্পিতভাবে এই জনগোষ্ঠীর জন্মহার নিয়ন্ত্রণ, শিশুদের অন্যত্র স্থানান্তর ইত্যাদি। ৭নং ধারায় ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এ যেসব ‘অপরাধ’ ও অপরাধের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে খুন (Murder), পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা বা বিনাশ সাধন (Extermination), দাসত্ব ( Enslavement),, জোরপূর্বক বিতাড়ন (Deportation), অত্যাচার ( Torture ), ধর্ষণ ( Rape ), যৌন দাসত্ব (Enforced Prostitution ), বর্ণবাদী নীতি ( Crime of Apartheid ) ইত্যাদি। যুদ্ধাপরাধ (৮নং ধারা) ধারায় যেসব অপরাধের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সুপরিকল্পিত হত্যা ( Wilful Killing), অত্যাচার ( Torture of inhuman treatment ), অমানবিক আচরণ (Inhuman treatment ), বিচার অস্বীকার করা ( Right of fair and regular trial ), আইনবহির্ভূতভাবে বিতাড়ন (Unlawful deportation ), সম্পত্তি ধ্বংস করা (Destruction of property) ইত্যাদি।
এখন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইডিং কমিটির রিপোর্টের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে তারা মিয়ানমারে তাতমাদোর (মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর স্থানীয় নাম) যেসব ‘অপরাধ’ সংঘটিত করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন, সেসব ‘অপরাধ’ আইসিসি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেমন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বিচারে হত্যা, নারীদের গণধর্ষণ, শিশুদের হত্যা এবং পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে কখনোই সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করা যায় না। হত্যা, ধর্ষণ, শিশুহত্যা, রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি ‘অপরাধ’ আইসিসির ৬, ৭ ও ৮নং ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ জেনারেলদের অভিযুক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুপারিশ করেছে ওই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। প্রশ্নটা এখানেই নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের বিচারের সিদ্ধান্ত নেবে কি না? এর জবাব হচ্ছে ‘না’। চীন ও রাশিয়ার অনুমোদন এতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিচার সম্ভব। এজন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মিয়ানমারের গণহত্যা ও ধর্ষণের জন্য আইসিসির বাইরে আলাদা একটি অপরাধ আদালত গঠন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাবেক যুগোসøাভিয়া, রুয়ান্ডা ও কেনিয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল। ২৯ আগস্ট সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডসসহ আরও কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গাদের গণহত্যার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সুতরাং সাধারণ পরিষদকে আলাদাভাবে মিয়ানমারের জন্য একটি অপরাধ আদালত গঠন করতে হবে। আর উদ্যোগটা নিতে হবে জাতিসংঘের মহাসচিবকেই। আর এটা যদি করা না হয়, যদি ‘অপরাধ’ করেও জেনারেলরা মাফ পেয়ে যান, তাহলে পৃথিবীর অন্যত্র এ ধরনের অপরাধ আরও সংঘটিত হবে। সুতরাং জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থেই এ ধরনের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন।
Daily Alokito Bangladesh
02.09.2018
0 comments:
Post a Comment