রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মির্জা ফখরুলের জাতিসংঘ দর্শন!


মির্জা ফখরুল জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। এটা কোনো ধরনের নালিশ জানাতে নয়, বরং তার মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবহিত করতেই তিনি জাতিসংঘের সহকারী সেত্রেুটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জাতিসংঘ কী স্ব-উদ্যোগে কোনো দেশের নির্বাচন করতে পারে? এটা সত্য জাতিসংঘের ‘ইলেকট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন (ইএডি)’ নামে একটি শাখা আছে। এটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই শাখা পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে নির্বাচন করে আসছে। এরা বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের আয়োজনের ক্ষেত্রে ‘টেকনিক্যাল সহযোগিতা’ দেয়, সেখানে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে, নির্বাচন যে ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে তা ‘সার্টিফাই’ করে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এককভাবে, স্ব-উদ্যোগে ‘ইলেকট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন’ কোনো দেশে নির্বাচনের আয়োজন, পর্যবেক্ষণ বা নির্বাচন মনিটরিং করতে পারে না। শুধুমাত্র জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদনই নয়, বরং ওই দেশের এবং বিবাদমান গোষ্ঠীরও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। নেপালের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি।
২০০৬ সালের  নভেম্বরে নেপাল সরকার ও মাওবাদীর সাথে একটি শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়। ওই সময় সরকার ও মাওবাদীরা জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানায় সেখানে সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে সাংবিধানিক পরিষদ (সংসদ) গঠিত হবে, তা আয়োজন করে দেখার জন্য। জাতিসংঘ মিশন সেই কাজটি শুরু করে ২০০৭ সালে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে সেখানে সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ‘ইলেক্ট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন’ তাদের লোকবল দিয়ে, পর্যবেক্ষণ দিয়ে এই নির্বাচনের কাজটি সম্পন্ন করে। কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধের পর জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল ১৯৯২-৯৩ সালে, সেখানে ওই সময় প্রায় ৪৬ দেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল (বাংলাদেশসহ)। এই কর্তৃপক্ষ সেখানে নির্বাচর্নে আয়োজন করেছিল। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে নির্বাচনে সহযোগিতা করেছিল জাতিসংঘ। গৃহযুদ্ধের পর নামিবিয়ায় (১৯৮৯-৯০) জাতিসংঘ একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পরিচালনা করেছিল এবং সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশে জাতিসংঘের ‘ইলেক্ট্ররাল অ্যাসিসট্যান্স ডিভিশন’ (ইএডি) নির্বাচন পরিচালনা করেছে (দেখুন, টঘঙডঅঝ ঘবংি, ১৪ উবপবসনবৎ ২০১৭)। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে ওইসব দেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। ওইসব দেশে গৃহযুদ্ধ চলছি, তারপর বিবাদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়। শান্তিচুক্তি হয় এবং জাতিসংঘ সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এটা তো সত্য, অতীতে জাতিসংঘের ্উর্ধতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের উতপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সফর গেছেন। সরকার ও বিরোধী দলের সাথে কথাও বলেছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখনও মির্জা ফখরুল গেলেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাদের অবহিত করলেন। জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিরা এসব বিষয়ে অবগত নন? নিশ্চয়ই তারা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে তাদের কিছু করার নেই। এটা ঠিক একটা নির্বাচনকালীন সরকারের কথা শুধু বিএনপিই বলছে না, বলতে গেলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে প্রতিটি দলই একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট কিংবা ঐক্য প্রক্রিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর তিন মাস ছুটি’ শীর্ষক একটি ফর্মুলা মাঝেমধ্যে বলা হয়। কিন্তু এটাও অসম্পূর্ণ। তাহলে ওই সময় সরকার পরিচালনা করবে কে? উপরুন্তু সরকার একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। সংবিধান তো প্র্রধানমন্ত্রীর ‘তিনমাস ছুটি’ অনুমোদন করে না! সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকার এই শেষ সময়ে এসে সংবিধান সংশোধন করবে, এটা মনে হয় না। তাহলে সমঝোতাটা হবে কীভাবে?
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় হয়ে গেছে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রচার বিষয়ক কর্মসূচি। তাতে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট ও যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক। অনুষ্ঠানে এইচটি ইমাম বলেছেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই’। মঈন খান বলেছেন, ‘সুবিচার ছাড়া রাজনীতিতে শান্তি সম্ভব নয়’। বার্নিকাটের বক্তব্য, ‘গণতান্ত্রিক দেশে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ’। আর ব্লেইকের বক্তব্য ছিল এরকম, ‘নির্বাচন সহিংসতামুক্ত হওয়া প্রয়োজন’।
এসবই হচ্ছে আসল কথা। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। এবং সবার কাছে  গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে আলোচনাটাই আসল। একটি সংলাপ প্রয়োজন। জাতিসংঘে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
Daily Amader Somoy.com
23.09.2018

0 comments:

Post a Comment