বিএনপি যে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছে, তা অনেকটা এ রকম : খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার নামে দেয়া সব মামলা প্রত্যাহার, তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। সুস্পষ্টভাবে ৬ দফার কথা বলা না হলেও নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে এ কথাগুলোই উচ্চারিত হয়েছে বারবার। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার যদি এ দাবিগুলো শেষ পর্যন্ত না মানে, তাহলে কি বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পথ অনুসরণ করবে? একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বয়কট করবে?
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন টিভি টকশোতে বক্তারা, যারা কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগ করেন, কেউ বা আবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা নিত্য এ বিষয়টি নিয়েই ‘বিতর্ক’ করছেন। টিভি টকশো দেখলেই বোঝা যায় আমরা কী অসহিষ্ণু রাজনীতির মধ্য দিয়ে দিন পার করছি!
বিএনপির ৬ দফা, আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি, আর এসব নিয়ে যে ‘রাজনীতি’, তা নির্বাচন পর্যন্ত চলবে বলেই আমার ধারণা। তবে এখানে দুটি প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ : এক. খালেদা জিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তি পাবেন কিনা এবং নির্বাচনে অংশ নিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন কিনা। দুই. বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা। খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি যেমন অর্থহীন, তেমনি খালেদা জিয়া চাইলেও তিনি বিএনপি ছাড়তে পারবেন না। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা। এক এক করে প্রায় সব মামলাতেই তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
জামিন পেলে জেল থেকে তার মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতা ও অভিজ্ঞ আইনজীবী মওদুদ আহমদ ১ সেপ্টেম্বরের জনসভায়ও বলেছেন, ‘আইনের মাধ্যমে বেগম জিয়া মুক্তি পাবেন না!’ পরোক্ষভাবে তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে জেলেই থাকতে হবে। হয়তো আরও মামলা হবে। এগুলো সবই আশঙ্কার কথা। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই- খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা? ৬ দফার ১ নম্বরেই আছে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি। যদিও মুক্তির বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার, তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের (সরকারের মুখ্য আইন কর্মকর্তা) একটি ভূমিকা তো আছেই। আমরা তা অস্বীকার করি কীভাবে? অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যাপারে বারবার আপত্তি জানানো হচ্ছে।
সাধারণত নিম্ন আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন থাকে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে এর প্রতিকার পাওয়া যায়। সেটাই মঙ্গল। সেটাই শ্রেয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত ওই মামলাটি নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় ‘রাজনীতি’ হচ্ছে। এটা নিয়ে বিএনপি যেমন রাজনীতি করছে, তেমনি আওয়ামী লীগও রাজনীতি করছে। মন্ত্রীরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানান, তারা তা না জানালেও পারতেন। বিচারাধীন বিষয় উচ্চ আদালতের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। বিএনপির দ্বিতীয় দফায় তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ছোট মন্ত্রিসভা থাকবে, এমন কথাই বলা আছে সংবিধানে। সংবিধানের ৫৭(৩) ধারায় বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।’
এর অর্থ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে ও পরে ‘নতুন প্রধানমন্ত্রী’ নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত নিজ দায়িত্বে বহাল থাকবেন। তবে এটা স্পষ্ট নয় কিংবা সংবিধান এটা স্পষ্ট করেনি যে তিনি ‘নির্বাহী কর্তৃত্ব’ প্রয়োগ করতে পারবেন, কী পারবেন না। কনভেনশন হচ্ছে, ওই অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য কোনো প্রধানমন্ত্রীই কোনো দেশে কোনো ‘নির্বাহী কর্তৃত্ব’ প্রয়োগ করেন না। তিনি রুটিন কাজ করেন।
আরও একটা কথা। সংসদ বিলুপ্ত না করেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর অর্থ কী? সংসদ সদস্যরা নিজেদের অবস্থান ঠিক রেখেই প্রার্থী হবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অর্থাৎ যিনি এখনও এমপি, তিনি প্রার্থী হবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এক্ষেত্রে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার একটা অভিযোগ থেকেই যাবে। স্থানীয় প্রশাসন একজন এমপিকে অস্বীকার করতে পারে না। এমপিকে তারা সমীহ করেন। এমপি স্থানীয় রাজনীতির প্রধান ব্যক্তি। এমপির কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন অন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না।
এ ক্ষেত্রে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। পৃথিবীর সব দেশে সাধারণত নিজ নিজ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েই নির্বাচনটি হয়। ভারত এর বড় উদাহরণ। সংসদ বহাল রেখে কোনো নির্বাচনই হয় না। এটা অবশ্য ঠিক, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকেন; কিন্তু তার কোনো নির্বাহী কর্তৃত্ব থাকে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবিধানের এই ধারা নিয়ে বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান পরস্পর বিরোধী এ ক্ষেত্রে।
তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির একটি সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দলটি এখনও বিএনপির বিকল্প রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে পারেনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপিতে ভাঙন এসেছে। তবে যারা মূলধারা থেকে বেরিয়ে গেছে, তারা কেউই সুবিধা করতে পারেননি। আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতা আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে বাকশাল নিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। মূলধারায় ফিরে এসেছিলেন। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওবায়দুর রহমান কিংবা মান্নান ভূঁইয়া চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। আর নাজমুল হুদা একবার বেরিয়ে গেছেন, আবার ফিরে গেছেন, এখন আবার ১৪ দলে আশ্রয় খুঁজছেন। তার গ্রহণযোগ্যতা কিংবা ক্যারিশমা কোনোটাই নেই। ফলে মুজিব কিংবা জিয়া পরিবারের বাইরে গিয়ে কেউই সফল হবেন না।
আরও একটা কথা, আর তা হচ্ছে তৃতীয় শক্তি গড়ে ওঠার ব্যর্থতা। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সফলতা আসেনি। আমরা যদি পঞ্চম (১৯৯১) থেকে নবম জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দুটি বড় দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪০ আসন, (শতকরা ৪৬.৬৬ ভাগ), আওয়ামী লীগ ৮৮ আসন (২৯.৩৩ ভাগ), জাতীয় পার্টি ৩৫ আসন (১১.৬৬ ভাগ), আর জামায়াত ১৮ আসন (৬ ভাগ)। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসন (৩৭.০৪), বিএনপি ১১৬ (৩৩.৬১), জাতীয় পার্টি ৩২ (১৬.৪), জামায়াত ৩ (৮.৬১)।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০১) বিএনপি ১৯৩ (৪৪.৯৭), আওয়ামী লীগ ৬২ (৪০.১৩), জাতীয় পার্টি ১৪ (৭.২৫), আর জামায়াত ১৭ (৪.২৮)। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগ ২৩০ (৪৯), বিএনপি ৩০ (৩৩.২), জাতীয় পার্টি ২৭ (৭), জামায়াত ২ (৪.৬)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভোটাররা দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর আস্থাশীল। ফলে সংসদীয় রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এ দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এ আস্থার সম্পর্ক না থাকলে সংসদীয় রাজনীতি বিকশিত হবে না।
বিদ্বেষ আর পরস্পরকে ঘৃণা কোনো ভালো রাজনীতির জন্ম দেয় না। পারস্পরিক অশ্রদ্ধা আর বিদ্বেষ এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মানুষ এটা পছন্দ করে না। একটা পর্যায় ছিল যখন একটি বড় দলের ব্যর্থতাই অপর দলকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। পঞ্চম সংসদে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। আর সপ্তম সংসদে আওয়ামী লীগ। অষ্টম সংসদে আবার বিএনপি। নবম সংসদে বিএনপির ব্যর্থতা আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু এরপর থেকেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। অসহিষ্ণুতার রাজনীতি চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আমরা তা পারছি না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও যদি বিএনপি বয়কট(?) করে, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। রাজনৈতিক অস্থিরতা যে দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, ভেনিজুয়েলা তার বড় প্রমাণ। বিএনপি কতগুলো দাবি উত্থাপন করেছে। তার পেছনে যুক্তি থাকুক আর নাই থাকুক, ‘সংলাপ’ করতে দোষ কী? দেশে সংবিধান আছ। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে এটাই নিয়ম। সংবিধান ক্ষমতাসীন দলকে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছে। বিরোধী দলের এটা পছন্দ না হওয়ারই কথা।
প্রয়োজনে বিএনপি ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনও করতে পারবে। কিন্তু নির্বাচন বয়কট কোনো সমাধান নয়। তবে সংসদ নির্বাচনটি যাতে সুষ্ঠু হয়, যাতে ভোট কেন্দ্র দখল আর ‘সিল মারা’র দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, আমরা এমনটিই চাই। এটা সরকারের জন্যও মঙ্গলজনক। সাম্প্রতিককালে খুলনা, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন ভালো হয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না- আমরা এমনটাই চাই। এর জন্য যা কিছু করা দরকার তা যদি সরকার করে, তাতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বৈকি। শুধু বিএনপি কেন, সরকার অন্য দলগুলোর সঙ্গেও সংলাপ করতে পারে। এতে কোনো ক্ষতি নেই। বিএনপি ৬ দফা দিয়েছে বটে। কিন্তু এটাই চূড়ান্ত নয়। বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে- এটাই বাস্তবতা, এটাই সঠিক রাজনীতি।
Daily Jugantor
08.09.2018
0 comments:
Post a Comment