সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটিটি রয়েছে ইদলিবে। ইদলিব শহরটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। আলেপ্পো থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে। সিরিয়ায় একে একে যখন বিদ্রোহী বাহিনীর পরাজয় ঘটছে এবং আসাদ সরকার কর্তৃক যখন সিরিয়ায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন আসাদবিরোধী বিদ্রোহীরা এ ছোট্ট শহরটি অনেক দিন ধরেই ধরে রেখেছিল। সিরিয়ায় আরব বসন্তের ঢেউ এসে যখন লাগল, তখন ২০১১ সালে ইদলিবে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছিল। ওই সময় বারবার ইদলিবের ঘটনা, যা কিনা সামরিক সংঘর্ষের রূপ নিয়েছিল। ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শহর ও শহরের আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণভার চলে যায় বিদ্রোহীদের হাতে। ২০১২ সালে সরকারি বাহিনী এটা দখল করে নেয়। ২০১৫ সালের মার্চে বিদ্রোহী বাহিনীর বড় জয় আসে। নূসরা ফ্রন্ট ও আহরার আল শাম বিদ্রোহী গ্রুপের নেতৃত্বে একটি যৌথ বাহিনী ইদলিব দখল করে নেয় এবং সেখানে বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে একটি ‘স্থানীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। একসময় আসাদবিরোধী একটি অভ্যন্তরীণ সরকারের হেডকোয়ার্টারও এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে ইদলিব বারবার আলোচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ লেগে ছিল। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নূসরা ফ্রন্টকে বিলুপ্ত করে তাহরির আল শাম নামে আরও একটি বিদ্রোহী গ্রুপের জন্ম হয়। এই গ্রুপটি ইদলিব ও এর আশপাশের এলাকা থেকে অপর বিদ্রোহী গ্রুপ আহরার আল শামকে উৎখাত করে। এখন আসাদ সরকার ইদলিবে অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এদের সহযোগিতা করছে রাশিয়া। অপরদিকে বিদ্রোহী গ্রুপ সহায়তা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে ইদলিবকে কেন্দ্র করে একটি ‘ছায়াযুদ্ধের’ জন্ম হতে যাচ্ছে। দুই বড় শক্তির পাশাপাশি তুরস্কও ‘সিরিয়া যুদ্ধে’ নিজেদের জড়িত করেছিল। তুরস্ক কুর্দি শহর আফরিন দখল করে নিয়েছিল। অথচ কুর্দিরা সাহায্য পেত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে তুরস্ক-রাশিয়া-ইরান ঐক্য গড়ে ওঠে। অথচ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তুরস্কে সম্প্রতি যেসব সন্ত্রাসী কর্মকা- হয়েছে, তা কুর্দি বিদ্রোহীদের কাজ বলে তুরস্কের অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা ছিল কুর্দি অঞ্চল মানবিজকে নিয়ে। মানবিজ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান রয়েছে, যারা সেখানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কর্মরত রয়েছে। তুরস্ক মানবিজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ ভোগেল সিএনএনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, পেন্টাগন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এ ফোর্স তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফরিন শহর মুক্ত করার জন্য ‘যুদ্ধ’ করছে। ফলে সিরিয়া সংকট নতুন একটি মোড় নিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও বিস্মিত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে যে বিকল্প শান্তি আলোচনা চলছিল, তাতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৯ জানুয়ারি সোচিতে যে শান্তি আলোচনা আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ তাতে যোগ না দেওয়ায় কার্যত সেই উদ্যোগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে এ প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠবে যে, সিরিয়ার রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা কাটবে কি? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী একরকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দু-এক আগে মার্কিন ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশকিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা আইএসের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এই যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এই সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে একধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের একদিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই এ পরিকল্পনা করে। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজি হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযান সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এ হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গেল অক্টোবরে (২০১৭) সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে! সিরিয়ার কুর্দিরা বেশিরভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি বা পিপলস ডিফেনস ইউনিট (ণচএ) ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব পাড়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই তুরস্ক এক ধরনের অস্বস্তিতে ছিল। বলা ভালো, ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অনেকের স্মরণ থাকার কথা, কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি আরও অনেক দিনের জন্য রাখতে চায়। তারা আরও সিরিয়ায় ২ হাজার সামরিক উপদেষ্টা সেখানে পাঠাতে চায়! আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা দেশটির (তুরস্ক) সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে, রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে, রাশিয়ার কারণে আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ার শিবিরে অবস্থান করছে।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে?
আপাতত সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী নয়া স্নায়ুযুদ্ধের যে সূচনা হয়েছে, তার প্রভাব এখানেও পড়েছে। রাশিয়ার যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে সিরিয়ায়। সিরিয়ার পোর্ট আর বিমানঘাঁটি ব্যবহার করছে রাশিয়া। সীমিত আকারে রাশিয়ার সেনাসদস্যরাও সেখানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসদস্যরাও ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে সিরিয়ার একটি অঞ্চলে কর্মরত। তুরস্কের সেনাবাহিনী সিরিয়ার ভেতরেই অবস্থান করছে। এদিকে ইসরাইলি বিমানবাহিনী সিরিয়ার একটি বিমানঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়েছিল। এ হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমর্থন রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। এর অর্থ হচ্ছে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবেই হোক ইসরাইল সিরীয় সংকটের একটা অংশ হয়ে গেল। তাই আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়া সংকটের সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এমনি এক পরিস্থিতিতে ইদলিবকে নিয়ে দুই বৃহৎ শক্তির মাঝে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটেছে। গেল সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইদলিব আক্রমণ না করার জন্য রাশিয়া ও সিরিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাম্প উগ্র কনজারভেটিভদের কাছ থেকে সিরিয়ায় সরাসরি আক্রমণ চালানোর জন্য এক ধরনের ‘চাপ’ এর মুখে আছেন। তথাকথিত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। এখন যে-কোনো মাকিনি আগ্রাসন রাশিয়াকে সিরিয়ায় সাময়িকভাবে জড়িয়ে যেতে উৎসাহ জোগাবে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে যে ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছে, তা শেষ পর্যন্ত দুটি বড় শক্তিকে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে উৎসাহ জোগায় কি না সেটাই দেখার বিষয়।
Daily Alokito Bangladesh
16.09.2018
0 comments:
Post a Comment