রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি সিদ্ধান্ত ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


মন্ত্রিসভা ভারতকে দুটি বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। ভারত এখন থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে কলকাতা থেকে ১ হাজার ৫৫৯ কিলোমিটার দূরত্বের আগরতলায় এতদিন যে পণ্য পরিবহনে সময় লাগত আট দিন, তা এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পৌঁছে যাবে আগরতলায়। ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলোর আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও ব্যবহূত হবে এই দুটি পোর্ট। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পৃথিবীর অনেক দেশই, এমনকি ইউরোপের অনেক দেশ অন্য দেশের পোর্ট ব্যবহার করে থাকে। এটি একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতীয় পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ওই বন্দর দুটি যদি ব্যবহূত হয়, তাতে করে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা? কিংবা চট্টগ্রাম ও মোংলা পোর্টের সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণ না করার ফলে এই দুটি পোর্টের সক্ষমতা আছে কিনা ভারতীয় পণ্য হ্যান্ডলিং করার? ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের আমদানি-রফতানি বেড়েছে। এই আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহূত হয় বেশি। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে ‘নেক্সট ইলেভেন’-এর অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ। অর্থাৎ, যে ১১টি দেশ আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে অবির্ভূত হচ্ছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এর অর্থ পরিষ্কার- আগামীতে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাড়বে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর ‘চাপ’ বাড়বে। মোংলা বন্দরের ব্যবহার কম। কেননা পলি জমে যাওয়ায় মোংলা বন্দরে জাহাজ তেমন একটা ভিড়তে পারে না। ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকেই ব্যবহার করতে হয়। এখানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আরেকটি সমস্যা- বাংলাদেশে কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা। কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কথা ছিল। চীনের এখানে অর্থায়ন ও বন্দরটি নির্মাণ করার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় (২০১৪) ওই চুক্তিটি স্বাক্ষরের কথা ছিল, কিন্তু স্বাক্ষর হয়নি। পরে জানা গেল, ‘একটি দেশের’ আপত্তির কারণে চুক্তিটি আমরা স্বাক্ষর করতে পারিনি। অথচ সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে তাতে করে আমরা এবং সেই সঙ্গে ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো ওই গভীর সমুদ্রবন্দরটি ব্যবহার করতে পারত। এমনকি চীনও এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারত। কেননা বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য এই গভীর সমুদ্র পোর্টের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি ছিল। চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, বিসিআইএম করিডোর তার একটি অংশ। এর মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং শহরের সঙ্গে কক্সবাজার সড়ক পথে সংযুক্ত হবে। এতে করে চীনা পণ্য সড়ক পথে কক্সবাজারে এসে গভীর সমুদ্রপথ ব্যবহার করে বিদেশে রফতানি হবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশ সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ না করায় চীন এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে কাইয়াউকপিউতে (Kyaukphyu) একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। চীনের স্বার্থ এখানে অনেক বেশি।
সোনাদিয়ায় যদি আমরা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারতাম, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর থেকে আমরা ‘চাপ’ কমাতে পারতাম। সময় ও দেশের প্রযোজনে পণ্য হ্যান্ডলিং ক্রমাগত বেড়ে গিয়ে বন্দরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫.৫ শতাংশ। অথচ সেই সমানুপাতে জেটি-বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড, ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের মতো সুবিধাগুলো দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। মূল জাহাজ চলাচল চ্যানেলের দীর্ঘদিন ড্রেজিং না হওয়ায় ভরাট হয়ে নাব্য হারাচ্ছে বন্দর। এ কারণে বহির্নোঙরে বড় জাহাজ বহর থেকে আমদানি পণ্য লাইটারিং করতে গিয়েই সময় ও আর্থিক অপচয় বেড়ে যাচ্ছে। পোর্ট-শিপিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় ভারত যদি এ পোর্ট ব্যবহার করে, তাহলে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম বন্দরটি। কেননা নিজের সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে বন্দরটি। ২০২০ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে প্রায় ২৮ লাখ টিইইউএস (Twenty-Foot Equivalent unit, ২০ ফুট চওড়া ও ৮ ফুট উঁচু কনটেইনার)। তখন বন্দরের সক্ষমতায় ঘাটতি থাকবে সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টিইইউএস কিংবা আরো বেশি। আজ কেবিনেটে ভারতকে এ বন্দর ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বটে। কিন্তু ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়েই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছিল। ভারত অনেক আগে থেকেই এ ব্যাপারে প্রস্তুত নিয়ে রেখেছিল। যে কারণে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি সড়কপথে এবং ভবিষ্যতে রেল পথে ত্রিপুরা দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবাহিত হতে পারে। দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুমেব আনন্দপাড়া থেকে রামগড়ের মহামুণি পয়েন্ট পর্যন্ত ৪১২ মিটার দীর্ঘ এবং ১৪.৮ মিটার চওড়া মৈত্রী সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পে ভারত সরকার ১২৫ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছে। তা ছাড়া ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে আখাউড়ার সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে, যা বন্দর থেকে সরাসরি কন্টেইনার আগরতলায় পৌঁছানোর প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের ব্যাপারে ‘চাপ’ কীভাবে বাড়ছে, তা একটি পরিসংখ্যান দিলে বোঝা যাবে। ২০১২-১৩ সালে এই বন্দর ব্যবহার করে আমদানি হয়েছে ৩,৮৩,১২,০২৮ টন, আর রফতানি হয়েছে ৫০,৫৯,৬৪০ টন। ২০১৪-১৫ সালে এর পরিমাণ ৪,৮৯,৪১,৪০৬ টন (আমদানি) ও ৫৮,৩৯,৯৮৬ টন (রফতানি)। ২০১৬-১৭ সময়সীমায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬,৬৪,৬৪,২৮৫ টন (আমদানি) ও ৬৭,০৯,৭৫৯ টন (রফতানি)। এর অর্থ একদিকে আমদানির পরিমাণ যেমনি বেড়েছে, ঠিক তেমনি রফতানির পরিমাণও বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, কার্গো হ্যান্ডলিং (টন) এ ২০১২-১৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৯৫ শতাংশ, ২০১৪-১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫.২১ শতাংশে, আর ২০১৫-১৬ সালে ১৫.২৮ শতাংশে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় আগামীতে কার্গো হ্যান্ডলিং কীভাবে বাড়বে। আরো কিছু পরিসংখ্যান দিই। ২০১৪ সালে এই বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ১৮ লাখ ৬৭ হাজার টিইইউএস। তখন জাহাজ আসা-যাওয়া করে ১ হাজার ৪৭টি। ২০১৫-১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩৯ টিইইউএস (জাহাজ এসেছে ১১৯৩টি)। আর ২০১৬-১৭ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৪ লাখ ১৯ হাজার ৪৮১টি টিইইউএস (জাহাজের সংখ্যা ১২৩০টি)। এর অর্থ কী? কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়ছে দিনে দিনে। সমুদ্রপথে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এর মধ্যে আমদানি বাণিজ্যের প্রায় ৮৫ ভাগ ও রফতানি বাণিজ্যের ৮০ ভাগই পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। অথচ গত সাত বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন কোনো কনটেইনার টার্মিনাল ও ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়নি। অর্থাৎ পণ্য হ্যান্ডলিং বাড়লেও অবকাঠামো আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে। তুলনামূলক বিচারে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা কম। ২০১৬-১৭ সালে মাত্র ৮৭টি বিদেশি জাহাজ এখানে ভিড়েছে (মোট জাহাজের সংখ্যা ৬২৩)। আর কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে মাত্র ৭৫.১১ লাখ টন (২০১৬-১৭)। এই বন্দরে নাব্য সঙ্কট রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে ঝুঁকছেন চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে। মোদির ঢাকা সফরের পর ভারত কর্তৃক পাঠানো স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরে (এসওপি) বাংলাদেশের বন্দর সুবিধার আওতায় ‘অগ্রাধিকার’ ভিত্তিতে তাদের জাহাজ জেটি-বার্থে ভেড়ানো ও পণ্যসামগ্রী ট্রানজিট মজুতের জন্য ‘বিশেষায়িত’ ইয়ার্ড চাওয়া হয়েছে। এখন অব্দি ‘ফি’ও নির্ধারিত হয়নি। কেবিনেটের সিদ্ধান্তের আগেই ২০১৫ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় জাহাজ এমভি ইরাবতী স্টার ও এমভি ওশান গ্রুপ। এ সময় কোনো ধরনের ট্যারিফ, ফি, চার্জ, মাসুল কিংবা শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমাদের তাই সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা জরুরি। পায়রাতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে বটে, কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের ‘চাপ’ কমাতে হলে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। পায়রাতে একটি ভারতীয় কোম্পানি (আদানি গ্রুপ) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। চীন এখন কোনো ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু ভারত কেন, অদূর ভবিষ্যতে নেপাল-ভুটান, এমনকি চীনও ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই। বিষয়টি নিয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা প্রচুর। চীন এ অঞ্চলে হামবানতোতা ও কলম্বো (শ্রীলঙ্কা) এবং গাওদারে (পাকিস্তান) গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে মিয়ানমারের কাইয়াউক পিউতে ছয়টি চীনা কোম্পানি এখন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানির অভিজ্ঞতা কম। তারপরও চীন ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হতে পারে। এতে ভারত ও চীনের উভয়েরই লাভ।
বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে কাজটি করা দরকার, তা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো।
Daily Bangladesher Khobor
 ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
 

0 comments:

Post a Comment