গত ১১ সেপ্টেম্বর বুধবার যুক্তরাষ্ট্র যখন ৯/১১-এর ১৮ বছর পার করেছে, তখন একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে—‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ শেষ কোথায়? ১৮ বছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদা নামের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল। ওই হামলায় সন্ত্রাসীরা চারটি হাইজ্যাক করা বিমান ব্যবহার করেছিল। দুটি বিমান নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান এলাকায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দুটি ভবনে (যা টুইন টাওয়ার নামে পরিচিত ছিল) আছড়ে পড়েছিল, যার কারণে ভবন দুটি ধ্বংস হয়ে যায়। এতে প্রাণ হারিয়েছিলেন দুই হাজার ৯৯৬ জন মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এত বড় সন্ত্রাসী হামলা অতীতে কখনো ঘটেনি। ওই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল। ১৮ বছর পার হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেনি। ২০১৯ সালে এসেও সেই যুদ্ধ আজও চলছে। গণমাধ্যমে তাই প্রশ্ন তোলা হয়েছে আর কত দিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এই যুদ্ধের ভার বহন করবে? ‘টুইন টাওয়ারে’ হামলার এক মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল। যুক্তি ছিল—তৎকালীন আফগান তালেবান নেতা মোল্লা ওমর আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দিয়েছেন। তার পরের ইতিহাস সবাই জানে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান, ২০০৩ সালে ইরাক, ২০১১ সালে লিবিয়া—একে একে ওই সব দেশের সরকারকে উত্খাত করা হয়েছিল, যারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’ ছিল না। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সাদ্দাম হোসেন অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র (weapons of mans destruction) সংগ্রহ করেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ যুদ্ধের পর জানা গেল, ওই ধরনের কোনো অস্ত্র সাদ্দাম হোসেনের ছিল না। কিন্তু যুদ্ধের কারণে দেশটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আর যুদ্ধের পর দেশটি পুনর্গঠনের দায়িত্ব পেয়েছিল মার্কিন কম্পানিগুলো। ইরাককে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল উত্তোলন করে সেই ‘বিল’ মেটাতে হয়েছিল।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ ছিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’—এর দ্বিতীয় ‘ক্ষেত্র’। তৃতীয় ‘ক্ষেত্র’ ছিল লিবিয়া। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে R2P (Responsibility to protect) তত্ত্ব ব্যবহার করেছিল—অর্থাৎ মানবিকতা রক্ষায় হস্তক্ষেপ। যুক্তিটি ছিল এ রকম—লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফি সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। তাই সামরিক হস্তক্ষেপ জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করে (১৩ মার্চ ২০১১) সেখানে গাদ্দাফিকে উত্খাত করল। কিন্তু সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে। রাষ্ট্রটি এখন কার্যত একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। যুদ্ধবাজরা একেকটি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। বাকি ছিল সিরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র R2P তত্ত্ব এখানেও প্রয়োগ করেছিল। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী স্টেট ও আল-নুসরা ফ্রন্টের (যাদের সঙ্গে আল-কায়েদার সম্পর্ক ছিল) ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান আক্রমণ চালিয়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’—এর চতুর্থ ফ্রন্ট ওপেন করেছিল। একপর্যায়ে রুশ বিমান হামলার পর আইএস বা ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাক থেকে উত্খাত হয়েছিল, এটা সত্য। কিন্তু এই জঙ্গিরা ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন দেশে। কিন্তু জঙ্গি তৎপরতা বন্ধ হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’—এর কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে এক ধরনের সংলাপে গেছেন, যখন আফগানিস্তানে একটি শান্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তখন ১১ সেপ্টেম্বর তালেবানরা কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে জানান দিল তারা কোনো ধরনের সমঝোতায় যেতে চায় না। অর্থাৎ গত ১৮ বছর ধরে আফগানিস্তানে ‘যুদ্ধ’ চলছে। একসময় তালেবানের মোকাবেলায় সেখানে প্রথমবারের মতো ন্যাটো সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। সেই ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু প্রায় পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা সেখানে এখনো রয়ে গেছে। তালেবানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের যে সংলাপ, তাতে তালেবানের দাবি ছিল একটি—আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল—আল-কায়েদার ওপর থেকে তালেবানের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এবং একই সঙ্গে মার্কিন দূতাবাস, স্থাপনা ও মার্কিনি সেনাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।
কিন্তু তালেবানরা মার্কিনি স্থাপনার ওপর সন্ত্রাসী হামলা অব্যাহত রেখেছে। এর অর্থ পরিষ্কার—তালেবানের কর্মকাণ্ড অর্থাৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে! সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকায়। মালি, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইরিত্রিয়া কিংবা সোমালিয়ায় নতুন নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যারা আল-কায়েদা কিংবা ইসলামিক স্টেটের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত, বোকো হারাম (নাইজেরিয়া) ও আল-শাবাব (সোমালিয়া)-এর নাম উল্লেখ করা যায়। আফগানিস্তান, ইরাক কিংবা লিবিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন ডলার। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া আর সিরিয়ায় ‘যুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছে ১১ মিলিয়ন মানুষ। এর মধ্যে ইরাকে ৫০ লাখ, আফগানিস্তানে ৫০ লাখ, এমনকি সিরিয়ায়ও মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ লাখ। প্রায় ১০ লাখ সিরীয় নাগরিক যুদ্ধের কারণে দেশান্তরিত হয়েছে এবং এরা এখন জার্মানিতে বসবাস করছে। যুদ্ধ এই দেশগুলোকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। একটি নতুন প্রজন্ম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? খুব শিগগিরই এই যুদ্ধের যে শেষ হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা খোদ সিরিয়ায়ও আবার ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা সংগঠিত হচ্ছে, এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। উপরন্তু ইরান সংকট সেখানে নতুন করে আরেকটি ফ্রন্ট ‘ওপেন’ করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের যদি আরো অবনতি ঘটে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। আর এতে করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ এক নতুন ধরনের ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে যাবে। তখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়বে বৈ কমবে না। যে আফগানিস্তানে ২০০১ সালে বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল, সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা এখন নিয়ন্ত্রণ করে তালেবান জঙ্গিরা। ইরাকে এই সেপ্টেম্বর মাসে আশুরা মিছিলে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ৩১ জনকে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৩১ আগস্ট সিরিয়ার ইদলিনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার, গত ১৮ বছরেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হয়নি। ফলে প্রশ্নটা থাকা স্বাভাবিক যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ আদৌ শেষ হবে না!
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আজ বিশ্বব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। একসময় ইউরোপ ছিল স্থিতিশীল একটি এলাকা। কিন্তু সন্ত্রাসীরা আজ প্যারিস, ব্রাসেলস কিংবা লন্ডনের মতো শহরে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বলতে দ্বিধা নেই, বেশির ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মুসলমানরা জড়িত। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদেরই বেশি সন্দেহ করা হচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশে মুসলমান ধর্মাবলম্বী কিছু তরুণ জিহাদি মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল যুদ্ধ করতে। এদের কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারলেও এরাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফিরে এসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। আবার এমন কথাও বলা হচ্ছে যে ২০১৭ সালে আইএস জঙ্গিরা সিরিয়া-ইরাক থেকে উত্খাত হলেও, তারা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে একটা ভয় থাকলই যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ হবে না। তাহলে এর পরিণতি কী?
স্পষ্টতই আফগানিস্তানে তালেবানরা অনেক শক্তিশালী। আফগান সরকারের অস্তিত্ব শুধু কাবুলেই সীমাবদ্ধ। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি তার সব সেনা সদস্যকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে কাবুলে ঘানি সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ ক্ষেত্রে তালেবানরা কি আবার ক্ষমতা দখল করবে? একসময় (১৯৯৪-২০০১) তো তারা ক্ষমতায় ছিল। তথ্যগতভাবে তালেবানরা যতি আবার কাবুলে ক্ষমতা দখল করে, তাহলে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আফগানিস্তান কি আবারও প্রত্যক্ষ করবে সেই মধ্যযুগীয় শাসন? এই এলাকার শান্তি তথা স্থিতিশীলতার জন্য, তা কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।
আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সংলাপ’ যখন ভেঙে গেছে, তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির একটি ভিডিও বার্তা। ৯/১১ উপলক্ষে তিনি এই ভিডিও বার্তাটি ছাড়েন। তাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ সব ইউরোপীয়, ইসরায়েলি ও রাশিয়ার স্থাপনার ওপর হামলার আহ্বান জানান।
SITE Intelligence আমাদের এই খবরটি দিয়েছে (এপির উদ্ধৃতি দিয়ে Military Times, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। এটা সত্য, ইদানীং আল-কায়েদার তৎপরতার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে সীমিত আকারে তারা ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। এখন জাওয়াহিরির এই ভিডিও বার্তায় এটা প্রমাণ হয়ে গেল আল-কায়েদার তৎপরতা থামবে না। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এটা ঠিক, ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছেন। তিনি হোয়াইট হাউসে তালেবান নেতাদের আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘সমঝোতায়’ গেলেও আল-কায়েদা কিংবা আইএসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কি সম্পর্কে জড়াবে—এটা একটা বড় প্রশ্ন। সেখানে সমঝোতা, না বৈরিতা—সেটাই বড় বিষয়। তাই প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক—‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’—এর শেষ কোথায়?
Daily Kalerkontho
17.09.2019
লে
0 comments:
Post a Comment