আমার দীর্ঘদিনের কর্মক্ষেত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখন আলোচনার
কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিদিনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংবাদ
ছাপা হচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষ তথা অভিভাবকদের মাঝে এই বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। আর সংবাদগুলো ছাপা হচ্ছে এমন
একসময়, যখন প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে
আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে। প্রথম সংবাদটি ছাপা হয়েছিল গাছ কাটা নিয়ে। পাঁচটি
ছাত্রাবাস তৈরির জন্য প্রায় এক হাজার গাছ কেটেছিল ছাত্রাবাস তৈরিতে
দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি সংস্থা। এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার এক মহাপরিকল্পনা।
এর মাঝে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যয় হবে ৪৫০ কোটি টাকা। ছাত্ররা কাটা গাছে রক্ত
মেখে তা নিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছিল। ডালাস শহরে বসে এই সংবাদটি পাঠ করে
আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। উন্নয়ন প্রয়োজন; কিন্তু এতগুলো গাছ কাটতে হবে? শিক্ষক
ও ছাত্ররা ক্যাম্পাসে একত্র হয়ে মিছিল করেছিলেন সেদিন। তারপর এলো আরেকটি
ভয়ঙ্কর সংবাদ- ঠিকাদারদের 'কাজ' নিশ্চিত করতে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা
দেওয়া হয়েছে। আর উপাচার্য নিজে নাকি স্বয়ং তা বিলি-বণ্টন করেছেন! যদিও পরে
উপাচার্য তা অস্বীকার করেন। এদিকে খবর আসতে থাকল, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ওপর অসন্তুষ্ট। পত্রপত্রিকা
থেকে জানা গেল, অসন্তুষ্টের অনেক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে- ছাত্রলীগের
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জাবি ভিসির কাছে চাঁদা দাবি!
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেল, ৮ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর ভিসির
সঙ্গে তার বাসভবনে দেখা করে তারা 'উন্নয়ন কাজ' সুষ্ঠু সম্পন্ন করার জন্য ৪
থেকে ৬ পার্সেন্ট চাঁদা দাবি করেন। ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম নিজে
গণমাধ্যমকে ওই তথ্যটি দেন (যুগান্তর, ১৩ সেপ্টেম্বর)। ভিসি নিজে
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি তাকেও জানান। এরপর এলো আরও একটি খবর-
ক্ষমা ছেয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি
দিয়েছেন, যে চিঠি গণমাধ্যমে ছাপাও হয়েছে (সমকাল, ১৩ সেপ্টেম্বর)। চিঠিতে
প্রধানমন্ত্রীকে 'মমতাময়ী নেত্রী' হিসেবে সম্বোধন করে তারা জানালেন,
'উপাচার্য ম্যামের স্বামী ও ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে
কাজের ডিলিংস করে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঈদুল
আজহার পূর্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি ৬০ লাখ
টাকা দেওয়া হয়।' তবে চিঠিতে তারা উপাচার্যের সঙ্গে হয় খারাপ আচরণ করেছেন
('কিছু কথা বলি'), তা তারা স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছেন (ওই)। কী ভয়ঙ্কর
কথা! তাদের দাবি, উপাচার্যের স্বামী ও ছেলে এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত! যদিও
উপাচার্য তা অস্বীকার করেছেন এবং এই অভিযোগকে 'মানহানিকর' বলে অভিহিত
করেছেন। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীরা দু'ভাগে ভাগ
হয়ে গেছেন। একদল মিছিল করেছে উপাচার্যের পক্ষে, অপর দল মিছিল করেছে
উপাচার্যের বিপক্ষে। স্পষ্টতই বিশ্ববিদ্যালয় আজ দ্বিধাবিভক্ত। মজার কথা,
যারা উপাচার্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে
উপাচার্য ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন, তারাও
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক।
এত বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলাম। অতীতেও উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। একাধিক উপাচার্যকে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট যেন একটু ভিন্ন। এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার এক মহাপরিকল্পনা। আমি যখন জুন মাসের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে আসি, তখনই ক্যাম্পাসে নানা গুজব শুনে এসেছিলাম। তখনই আমার কানে এসেছিল ওই দুর্নীতির কথা! শুনেছিলাম, টাকা ছাড়া এখানে কেউ কাজ করতে পারবে না। আমি কথাটা বিশ্বাস করিনি। কেননা একজন উপাচার্য ও তার পরিবারের সদস্যরা কেন দুর্নীতিগ্রস্ত হবেন? একজন উপাচার্য তো শিক্ষক। একজন শিক্ষক এবং তার পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাবেন- এই যে অভিযোগ, আমার তা ভাবতেও কষ্ট হয়! আমি উপাচার্যের স্বামীকে তেমন চিনতাম না। পরিচয় নেই। তিনি কখনও শিক্ষকতা করেননি। তবে শুনেছি, তিনি একসময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। অবসরে আছেন অনেক দিন ধরে। এখন ব্যবসা করেন। নতুন কলাভবনের একাধিক বিভাগে সিনিয়র শিক্ষকদের রুমে আমি তাকে নিয়মিত যেতে দেখেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত পাঁচ বছরে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব নিয়োগে ইউজিসির কোনো অনুমোদন ছিল না। আমার নিজের বিভাগে কর্মচারীর সংখ্যা এখন আট, সবই নতুন। একজনকে আমি পেয়েছিলাম, তিনি টাইপিস্ট হিসেবে নিয়োগ পেলেও ঠিকমতো কম্পিউটার ব্যবহার ও টাইপ করতে পারতেন না। আমার ভয়টা ছিল এখানেই। কর্মচারী আর কর্মকর্তাদের ভারে যদি বিশ্ববিদ্যালয় ভারাক্রান্ত হয়, তাহলে একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয় 'পোষ্য কোটায়' ভরে যাবে, মেধাবী ছাত্ররা তখন আর ভর্তি হতে পারবে না। কেননা কর্মচারী তথা কর্মকর্তারা কোটার সুবিধা নিয়ে তাদের সন্তানদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছেন। কোনো কোনো বিভাগে এই পোষ্য কোটায় ভর্তির সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন পর্যন্ত হয়ে যায়।
ছাত্রলীগ নেতাদের চিঠিতে ফিরে যাই। তারা সুস্পষ্টভাবে উপাচার্যের স্বামী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগটি গুরুতর। উপাচার্য তা অস্বীকার করেছেন। আমিও বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে চাই উপাচার্যের ওপর। উপাচার্য একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি কলঙ্কিত হবে, এটা একজন শিক্ষক হিসেবে উপাচার্য যেমনি চাইবেন না, ঠিক তেমনি আমিও চাইব না। ছাত্রলীগের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। অভিযুক্তদের একজন ডাকসুর নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। প্রধানমন্ত্রী চান ডাকসুর মাধ্যমে দেশের আগামী নেতৃত্ব তৈরি হোক। এখন ছাত্রলীগকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এটাও আমাকে কষ্ট দেয়। খোদ ডাকসুর সাধারণ সম্পাদককে যখন অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, তখন দেশের আগামী নেতৃত্ব নিয়ে আমি শঙ্কিত। আগামী নেতৃত্বকে কি আমরা একটা বড় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিলাম না? ছাত্রলীগের নেতৃত্ব প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাজেট, জাহাঙ্গীরনগরের উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে বেশি। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন, এমনটি আমরা এখনও শুনতে পাইনি। জানি না ভবিষ্যতে আমরা শুনতে পাব কি-না! উপাচার্য বলেছেন, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক তার বান্ধবীকে দিয়ে টাকার জন্য ফোন করাতেন। যদি এ ধরনের কোনো ফোন এসে থাকে এবং সেই ফোনালাপে কোন কোন বিষয় আলোচনা হয়েছে, তা বের করা কঠিন কিছু নয়। সরকার চাইলে সংশ্নিষ্ট ফোন কোম্পানির কাছ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। তথ্যগুলো পাওয়া আমাদের জন্য জরুরি।
উপাচার্য ফারজানা ইসলাম আমার সহকর্মী। তিনি শিক্ষক। এটাই তার পরিচয়। তিনি কেন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন? তার নিজের স্বার্থে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তিনি অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন- এটা আমার প্রত্যাশা। তবে যেহেতু স্বয়ং শিক্ষকদের একটি অংশ থেকে এ ধরনের অভিযোগ এসেছে, একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হতে বাধা কোথায়? তিনি অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি নিজের বিরুদ্ধে নিজে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন না। তবে বৃহত্তর স্বার্থে কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা তিনি জানিয়েছেন। এখন দুটি হলের নির্মাণ কাজ সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে; সবার সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন ছাত্রাবাসের জায়গা নির্ধারণ করা হবে। এই সিদ্ধান্তটি ভালো। এই সিদ্ধান্তটি আগে নিলে এমন ক্ষতি হতো না। তবে টাকা দেওয়া হয়েছে কি হয়নি- এর ফয়সালা এখনও হয়নি। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী স্বীকার করেছেন, তারা জাবি উপাচার্যের কাছে 'ন্যায্য পাওনা' দাবি করেছিলেন (দি ডেইল স্টার, বাংলা, ১৪ সেপ্টেম্বর)। 'ঈদের খরচ' হিসেবে তারা ওই টাকা চেয়েছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তার এই স্বীকারোক্তি কি সব সমস্যার সমাধান করবে? আদৌ তিনি বা জাবি ছাত্রলীগ টাকা পেয়েছিল কি-না, তার সমাধান এতে হলো না। তবে শোভন ও রাব্বানী দু'জনকেই ছাত্রলীগের পদ ছাড়তে হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই টাকা ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি অনেক প্রশ্নকে সামনে আনল। এক. ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই সরকারি ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে, যার কোনোটা পত্রিকায় প্রকাশ পায়, কোনোটা পায় না। সুতরাং শত শত কোটি টাকার ওইসব প্রকল্পে স্বচ্ছতা আনা দরকার। কেন্দ্রীয়ভাবে অথবা ইউজিসির মাধ্যমে এই কাজগুলো (ই-টেন্ডারসহ) সম্পন্ন করা যায় কি-না, তা ভেবে দেখতে হবে; দুই. উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। নারী কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেন ও মাসের পর মাস ঢাকা থেকে অফিস করার এন্তার অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য দক্ষ, নিরপেক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকদের উপাচার্য নিয়োগে একটি প্যানেল তৈরি করা যায় এবং সেই সঙ্গে 'এক টার্ম উপাচার্য' নিয়োগ পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন; তিন. ইউজিসিকে আরও সক্রিয় করে উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা প্রয়োজন; চার. দুদক রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করেছিল। ছাত্র ও শিক্ষকদের এক অংশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দুদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত করতে পারে; পাঁচ. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিয়ে সরকারের 'নয়া নেতৃত্ব' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ভালো ফল দিচ্ছে না। ছাত্রনেতারা অসততার পরিচয় দিচ্ছেন। সরকারি ছাত্র সংগঠনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আগামীর নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়। এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড না নেওয়াই মঙ্গল।
শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগবাটোয়ারার সংবাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। উপাচার্যের পরিবার এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকুক আর না থাকুক, উপাচার্যের মানসম্মান এতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এখন শোভন আর রাব্বানীকে বিদায় নিতে হলো। তাতে করে কি উত্থাপিত অভিযোগের আদৌ কোনো নিষ্পত্তি হলো? কোনো পক্ষ থেকেই এটা প্রমাণিত হলো না যে, টাকাটা কোন পক্ষকে দেওয়া হয়েছিল। যে কারণেই এই অভিযোগটি অমীমাংসিত থেকে গেল। এটা ঠিক, প্রধানমন্ত্রী শোভন-রাব্বানীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়ে একটি 'মেসেজ' দিলেন। এই মেসেজটি সবার জন্যই প্রযোজ্য এখন। কিন্তু উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম যখন বলেন, 'দুর্নীতি যেই করুক তার তদন্ত হোক। যে বা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট করেছে, তার তদন্ত হোক। হয়তো আমার দুর্নীতি বের করতে গিয়ে অন্য কিছু বেরিয়ে আসবে' (বিডিনিউজ২৪.কম, ১৪ সেপ্টেম্বর); তখন তদন্তের বিষয়টিকে আমি গুরুত্ব দিই। তদন্ত হোক। সত্য বেরিয়ে আসুক।
Daily Samakal
19.09.2019
এত বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলাম। অতীতেও উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। একাধিক উপাচার্যকে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট যেন একটু ভিন্ন। এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার এক মহাপরিকল্পনা। আমি যখন জুন মাসের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে আসি, তখনই ক্যাম্পাসে নানা গুজব শুনে এসেছিলাম। তখনই আমার কানে এসেছিল ওই দুর্নীতির কথা! শুনেছিলাম, টাকা ছাড়া এখানে কেউ কাজ করতে পারবে না। আমি কথাটা বিশ্বাস করিনি। কেননা একজন উপাচার্য ও তার পরিবারের সদস্যরা কেন দুর্নীতিগ্রস্ত হবেন? একজন উপাচার্য তো শিক্ষক। একজন শিক্ষক এবং তার পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাবেন- এই যে অভিযোগ, আমার তা ভাবতেও কষ্ট হয়! আমি উপাচার্যের স্বামীকে তেমন চিনতাম না। পরিচয় নেই। তিনি কখনও শিক্ষকতা করেননি। তবে শুনেছি, তিনি একসময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। অবসরে আছেন অনেক দিন ধরে। এখন ব্যবসা করেন। নতুন কলাভবনের একাধিক বিভাগে সিনিয়র শিক্ষকদের রুমে আমি তাকে নিয়মিত যেতে দেখেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত পাঁচ বছরে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব নিয়োগে ইউজিসির কোনো অনুমোদন ছিল না। আমার নিজের বিভাগে কর্মচারীর সংখ্যা এখন আট, সবই নতুন। একজনকে আমি পেয়েছিলাম, তিনি টাইপিস্ট হিসেবে নিয়োগ পেলেও ঠিকমতো কম্পিউটার ব্যবহার ও টাইপ করতে পারতেন না। আমার ভয়টা ছিল এখানেই। কর্মচারী আর কর্মকর্তাদের ভারে যদি বিশ্ববিদ্যালয় ভারাক্রান্ত হয়, তাহলে একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয় 'পোষ্য কোটায়' ভরে যাবে, মেধাবী ছাত্ররা তখন আর ভর্তি হতে পারবে না। কেননা কর্মচারী তথা কর্মকর্তারা কোটার সুবিধা নিয়ে তাদের সন্তানদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাচ্ছেন। কোনো কোনো বিভাগে এই পোষ্য কোটায় ভর্তির সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন পর্যন্ত হয়ে যায়।
ছাত্রলীগ নেতাদের চিঠিতে ফিরে যাই। তারা সুস্পষ্টভাবে উপাচার্যের স্বামী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগটি গুরুতর। উপাচার্য তা অস্বীকার করেছেন। আমিও বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে চাই উপাচার্যের ওপর। উপাচার্য একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি কলঙ্কিত হবে, এটা একজন শিক্ষক হিসেবে উপাচার্য যেমনি চাইবেন না, ঠিক তেমনি আমিও চাইব না। ছাত্রলীগের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। অভিযুক্তদের একজন ডাকসুর নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। প্রধানমন্ত্রী চান ডাকসুর মাধ্যমে দেশের আগামী নেতৃত্ব তৈরি হোক। এখন ছাত্রলীগকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এটাও আমাকে কষ্ট দেয়। খোদ ডাকসুর সাধারণ সম্পাদককে যখন অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, তখন দেশের আগামী নেতৃত্ব নিয়ে আমি শঙ্কিত। আগামী নেতৃত্বকে কি আমরা একটা বড় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিলাম না? ছাত্রলীগের নেতৃত্ব প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাজেট, জাহাঙ্গীরনগরের উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে বেশি। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন, এমনটি আমরা এখনও শুনতে পাইনি। জানি না ভবিষ্যতে আমরা শুনতে পাব কি-না! উপাচার্য বলেছেন, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক তার বান্ধবীকে দিয়ে টাকার জন্য ফোন করাতেন। যদি এ ধরনের কোনো ফোন এসে থাকে এবং সেই ফোনালাপে কোন কোন বিষয় আলোচনা হয়েছে, তা বের করা কঠিন কিছু নয়। সরকার চাইলে সংশ্নিষ্ট ফোন কোম্পানির কাছ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। তথ্যগুলো পাওয়া আমাদের জন্য জরুরি।
উপাচার্য ফারজানা ইসলাম আমার সহকর্মী। তিনি শিক্ষক। এটাই তার পরিচয়। তিনি কেন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন? তার নিজের স্বার্থে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তিনি অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন- এটা আমার প্রত্যাশা। তবে যেহেতু স্বয়ং শিক্ষকদের একটি অংশ থেকে এ ধরনের অভিযোগ এসেছে, একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হতে বাধা কোথায়? তিনি অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি নিজের বিরুদ্ধে নিজে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারেন না। তবে বৃহত্তর স্বার্থে কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা তিনি জানিয়েছেন। এখন দুটি হলের নির্মাণ কাজ সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে; সবার সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন ছাত্রাবাসের জায়গা নির্ধারণ করা হবে। এই সিদ্ধান্তটি ভালো। এই সিদ্ধান্তটি আগে নিলে এমন ক্ষতি হতো না। তবে টাকা দেওয়া হয়েছে কি হয়নি- এর ফয়সালা এখনও হয়নি। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী স্বীকার করেছেন, তারা জাবি উপাচার্যের কাছে 'ন্যায্য পাওনা' দাবি করেছিলেন (দি ডেইল স্টার, বাংলা, ১৪ সেপ্টেম্বর)। 'ঈদের খরচ' হিসেবে তারা ওই টাকা চেয়েছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তার এই স্বীকারোক্তি কি সব সমস্যার সমাধান করবে? আদৌ তিনি বা জাবি ছাত্রলীগ টাকা পেয়েছিল কি-না, তার সমাধান এতে হলো না। তবে শোভন ও রাব্বানী দু'জনকেই ছাত্রলীগের পদ ছাড়তে হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই টাকা ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি অনেক প্রশ্নকে সামনে আনল। এক. ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই সরকারি ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে, যার কোনোটা পত্রিকায় প্রকাশ পায়, কোনোটা পায় না। সুতরাং শত শত কোটি টাকার ওইসব প্রকল্পে স্বচ্ছতা আনা দরকার। কেন্দ্রীয়ভাবে অথবা ইউজিসির মাধ্যমে এই কাজগুলো (ই-টেন্ডারসহ) সম্পন্ন করা যায় কি-না, তা ভেবে দেখতে হবে; দুই. উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। নারী কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেন ও মাসের পর মাস ঢাকা থেকে অফিস করার এন্তার অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য দক্ষ, নিরপেক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকদের উপাচার্য নিয়োগে একটি প্যানেল তৈরি করা যায় এবং সেই সঙ্গে 'এক টার্ম উপাচার্য' নিয়োগ পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন; তিন. ইউজিসিকে আরও সক্রিয় করে উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা প্রয়োজন; চার. দুদক রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করেছিল। ছাত্র ও শিক্ষকদের এক অংশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দুদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত করতে পারে; পাঁচ. প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিয়ে সরকারের 'নয়া নেতৃত্ব' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ভালো ফল দিচ্ছে না। ছাত্রনেতারা অসততার পরিচয় দিচ্ছেন। সরকারি ছাত্র সংগঠনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আগামীর নয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়। এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড না নেওয়াই মঙ্গল।
শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগবাটোয়ারার সংবাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। উপাচার্যের পরিবার এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকুক আর না থাকুক, উপাচার্যের মানসম্মান এতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এখন শোভন আর রাব্বানীকে বিদায় নিতে হলো। তাতে করে কি উত্থাপিত অভিযোগের আদৌ কোনো নিষ্পত্তি হলো? কোনো পক্ষ থেকেই এটা প্রমাণিত হলো না যে, টাকাটা কোন পক্ষকে দেওয়া হয়েছিল। যে কারণেই এই অভিযোগটি অমীমাংসিত থেকে গেল। এটা ঠিক, প্রধানমন্ত্রী শোভন-রাব্বানীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়ে একটি 'মেসেজ' দিলেন। এই মেসেজটি সবার জন্যই প্রযোজ্য এখন। কিন্তু উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম যখন বলেন, 'দুর্নীতি যেই করুক তার তদন্ত হোক। যে বা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট করেছে, তার তদন্ত হোক। হয়তো আমার দুর্নীতি বের করতে গিয়ে অন্য কিছু বেরিয়ে আসবে' (বিডিনিউজ২৪.কম, ১৪ সেপ্টেম্বর); তখন তদন্তের বিষয়টিকে আমি গুরুত্ব দিই। তদন্ত হোক। সত্য বেরিয়ে আসুক।
Daily Samakal
19.09.2019
0 comments:
Post a Comment