আমাজন থেকে জাহাঙ্গীরনগরের দূরত্ব কত? ইন্টারনেট আমাকে বলছে, এই দূরত্ব ১৬ হাজার ২৮০ কিলোমিটার। দুটি অঞ্চলের সঙ্গে আদৌ কোনো মিল নেই। মিল থাকার কথাও নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একটি মিল খুঁজে পেলাম আমরা। আমাজনের গভীর জঙ্গলে আগুন লেগে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে একটি বিশাল অঞ্চল। ২ দশমিক ১ মিলিয়ন বর্গমাইল এলাকা নিয়ে যে বিশাল আমাজন জঙ্গল, যাকে বলা হয় ‘Lungs of the Planet’, অর্থাৎ এই গ্রহের শ্বাসযন্ত্র, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। আগুন লেগে সেখানকার বনাঞ্চলের একটি অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ ধরে এই আগুন জ¦লছে। গেল বছরের তুলনায় এবারের আগুন লাগার ঘটনা অনেক বেশি। আমাজন এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, আমাজনে দাবানলের ঘটনার সঙ্গে বন উজাড় করার বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। অভিযোগ উঠেছে, ব্রাজিলের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারোর উন্নয়ননীতি এর জন্য দায়ী।
এর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগরের মিল কোথায়? মিল আছে এক জায়গায়Ñ আর তা হচ্ছে, জাহাঙ্গীরনগরের যে বিশাল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, তাতে প্রচুর গাছ কাটা হয়েছে। উন্নয়নের নামে কাটা হচ্ছে গাছ, আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগরের প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রচুর গাছপালা আর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য জাহাঙ্গীরনগরের যে পরিচিতি ছিল, তা এখন ঝুঁকির মুখে। উন্নয়ন জাহাঙ্গীরনগরের দরকার। কিন্তু তার জন্য কি গাছপালা ধ্বংস করতে হবে? গাছ কেটে কি উন্নয়ন কর্মকান্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে? এর কি কোনো বিকল্প ছিল না? আমাজন আর জাহাঙ্গীরনগর এক নয় কিন্তু উন্নয়নের বলি হচ্ছে আমাজনের বনাঞ্চল, প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্য। ঠিক একই ঘটনা জাহাঙ্গীরনগরেরও উন্নয়নের বলি হচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য।
কীভাবে ব্রাজিলের বলসোনারোর দক্ষিণপন্থি সরকার আমাজন বনাঞ্চল ধ্বংস করে সেখানে উন্নয়নের নামে যে বন তথা প্রকৃতি ধ্বংসের লীলাখেলায় মেতেছে, তার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে Ecowatch-এর এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘Leaked Documents show Brazils Bolsonaro Has Grave Plans for Amazon Rainforest’। Open Democracy -এর ব্লগে (২৩ আগস্ট) এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। আমাজন জঙ্গলে ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য জমি লিজ দেওয়া হয়েছে। ব্রিজটি তৈরি করা হচ্ছে অবিডোজ (Obidos) মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় আমাজন নদীর ওপর। পাশাপাশি অরিক্সিমিনা শহরে (Oriximina) জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিআর-১৬৩ হাইওয়ের কাজ শুরু হয়েছে, যা সুরিনামকে ব্রাজিলের সঙ্গে সংযুক্ত করছে। ফলে ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল। বলা হচ্ছে বিদেশি তথা দেশি কোম্পানিগুলো নিজেরাই আগুন লাগিয়ে এসব বনাঞ্চল ধ্বংস করছে। ওই প্রতিবেদনে আদিবাসী ‘কুইলোমবোলা’ (Quilombola) সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলা হচ্ছে। এই ‘কুইলোমবোলা’ আদিবাসী সম্প্রদায় এখনো টিকে আছে দাসপ্রথা থেকে এরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল এত দিন
সায়েন্স জার্নালের এক প্রতিবেদনে (২৪ আগস্ট) বলা হয়েছে, ‘The Amazon cannot be recovered once its gone’। একবার ধ্বংস হয়ে গেলে আমাজন জঙ্গলকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। আর নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের এক প্রতিবেদনে (২৩ আগস্ট) উল্লেখ করেছে, চলতি বছর এখন অব্দি সেখানে ৪ হাজার ৩৪১টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, যা ২০১০ সাল খেকে গড়পড়তা লাগা অগ্নিকান্ডের চেয়ে শতকরা ৩৫ ভাগ বেশি (Amazon Rain Forest Fires : Here’s what Really Happening)। ওই প্রতিবেদনে আমাজন বনাঞ্চলের কোন কোন অঞ্চল (Mato Grosso) কীভাবে বনশূন্য হয়েছে, তার ছবি আছে। কীভাবে প্রতি বছর বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে, তার পরিসংখ্যানও আছে। এভাবে বনাঞ্চল যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তা শুধু ব্রাজিলকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, ক্ষতিগ্রস্ত করবে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধিকে তা ত্বরান্বিত করবে। পৃথিবীর উষ্ণতা আরও বাড়বে। দ্রুততার সঙ্গে গলে যাবে মরু অঞ্চলের বরফ। মরু অঞ্চলের বরফ যে দ্রুততার সঙ্গে গলছে, তার প্রমাণ স্যাটেলাইটে ধারণ করা চিত্র থেকে জানা গেছে।
এখন আমাজন বনাঞ্চল ধ্বংসের সঙ্গে ১৬ হাজার ২৮৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগরের মিলটা কোথায়? বলসোনারো সরকার উন্নয়নের নামে আমাজনের বনাঞ্চল ধ্বংস করছে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও অনেকটা তেমনি। উন্নয়নের নামে গাছ কেটে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। গত ২৩ আগস্ট কেটে ফেলা গাছে কাফনের কাপড় পরিয়ে বিক্ষোভ করেছে ছাত্ররা। এ ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পেলাম ব্রাজিলের গুয়াজাজারা (Guajara) আদিবাসীদের। জার্মান গণমাধ্যম ‘ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদনে সেই ছবি আছে, যেখানে ব্রাজিলের মারানহো (Maranho) এলাকায় গুয়াজাজারা আদিবাসীরা বন রক্ষায় নিজেরাই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ সেই ছবি প্রকাশ করেছে গত ২৩ আগস্ট। এভাবেই মানুষ প্রতিবাদী হয়। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার নামে করপোরেট জগতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়। জাহাঙ্গীরনগরের প্রতিবাদী ছাত্রদের সঙ্গে গুয়াজাজারা আদিবাসীদের মিলটা এখানেই। গুয়াজাজারার আদিবাসীরা যা করতে পেরেছে, হয়তো জাহাঙ্গীরনগরের আমার ছাত্ররা তা করতে পারেনি বা পারবে না। তবুও তাদের লাল সালাম।
মারানহোতে আদিবাসী গুয়াজাজারারা করপোরেট জগতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে জঙ্গলের ভেতরেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আর জাহাঙ্গীরনগরেও একধরনের ‘করপোরেট জগৎ’-এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা প্রতিবাদী হয়েছে। এই করপোরেট জগতে আছে ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর সুবিধাভোগী কিছু শিক্ষক। গাছ কেটে যে উন্নয়ন, সেই উন্নয়ন আমরা চাই না। ইতিমধ্যে তথাকথিত উন্নয়নের নামে যে টাকার ভাগাভাগি হয়েছে, সে ব্যাপারে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ আগস্ট)। সংবাদে বলা হয়েছে, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের দুই কোটি টাকা ছাত্রলীগের পকেটে’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯ আগস্ট উপাচার্যের বাসভবনে এ টাকা ছাত্রলীগকে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তী সময়ে এটা নিয়ে প্রতিবেদন করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোপানলে পড়তে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টারদের। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে ছাত্রলীগকে ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছে বলেও জানাচ্ছে পত্রিকাগুলো (দ্য স্টার বাংলা, ২৭ আগস্ট)। এবার জাবির উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। যে দুই কোটি টাকা ছাত্রলীগকে দেওয়া হয়, তার মধ্যে এক কোটি টাকা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পেয়েছে বলেও (ওই) সংবাদে উল্লেখ করা হয়। এখানে বলা ভালো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ বা একনেক জাহাঙ্গীরনগরের ‘অধিকতর উন্নয়ন’-এর জন্য যে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে তার মধ্যে ৪৫০ কেটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ক্যাম্পাসের প্রায় ১ হাজার ১৩২টি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং ইতিমধ্যে ৫০০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। যদিও টাকা দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি কেউই স্বীকার করেনি। তবে ক্যাম্পাসে এখন এটাই মূল আলোচনার বিষয়। সম্প্রতি একটি ভিডিও বার্তাও সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ছাত্রছাত্রীরা কোরাস করে গান গাইছে ‘জাবিতে বাকি টাকার বাগান রয়েছে’! পেছনে একটি ফেস্টুন, তাতে লেখা ‘স্বৈরাচার্যের মাস্টার প্ল্যান চ্যাট’।
এই জাহাঙ্গীরনগরে আমার কেটেছে অনেক দিন। আমার শিক্ষকতা জীবন কেটেছে এখানে। প্রথমে নতুন সমাজবিজ্ঞান ভবন, পরে নতুন একটি বিভাগ গড়ার দায়িত্ব নিয়ে পুরনো কলা ভবন ও শেষ পর্যায়ে নতুন কলা ভবনের তিনতলায় আমার কক্ষÑ সব যেন ছবির মতো। ক্যাম্পাসের প্রতিটি গাছ যেন আমার চেনা! আমি ক্যাম্পাসে গেলেই সেই গাছের গন্ধ পাই। আমার রুম থেকে ডান দিকে চোখ মেললেই লেক, আর চারদিকে সবুজ। সেই ক্যাম্পাস এখন বিষাদময়, ছাত্ররা কাটা গাছ নিয়ে তাতে কাফনের কাপড় পরিয়ে ‘মৃত্যু শবযাত্রায়’ অংশ নিচ্ছে! আমাজন থেকে ৫ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার দূরে আর জাহাঙ্গীরনগর থেকে ১৩ হাজার ৬৬৮ কিলোমিটার দূরে ডালাসে বসে আমি যেন আমাজনের গুয়াজাজারা আদিবাসীদের মতো জাহাঙ্গীরনগরের আমার ছাত্রদের কান্না শুনতে পাই! উন্নয়নের নামে আদৌ কি জাবিতে ৫০০ গাছ কাটার প্রয়োজন ছিল? জাবির উপাচার্য আমার সহকর্মী ছিলেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদে। তিনি পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন নন, কিংবা বিশ্বের উন্নয়ন বোঝেন না, তেমন তো নয়। তিনি বোঝেনও, জানেনও। নৃ-বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে তার অজানা নয়। এই যে গাছ কাটা কিংবা দুই কোটি টাকার ভাগ-বাটোয়ারার সংবাদ, তা কি তার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করল না? একজন উপাচার্যের সম্মান তিনি কোথায় নামালেন? তাকে যখন সন্তানতুল্য ছাত্ররা ‘স্বৈরাচার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করে, তখন ওই দুঃখবোধ আমি কোথায় রাখি! তিনি তো আমার মতোই শিক্ষক। একজন শিক্ষক কি কখনো স্বৈরাচার হতে পারেন?
উন্নয়ন আমি চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় ৫০০টি গাছ কেটে ফেলতে হবে! নিশ্চয়ই জাবিতে অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে ছাত্রাবাস নির্মাণ করা সম্ভব। আমি পরিকল্পনাটি পুনঃমূল্যায়ন দাবি করছি। একই সঙ্গে দুই কোটি টাকার ভাগ-বাটোয়ারার যে সংবাদ, তার পুনঃতদন্ত দাবি করছি। ছাত্রলীগ করা কোনো অপরাধ নয়। অপরাধ ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি টাকা আদায় করে কিংবা টেন্ডার ছিনতাই করে, এটা অপরাধ। এই অপরাধের বিচার হওয়া দরকার। সরকারের জন্যও এটা বিব্রতকর। কেননা সরকার উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু সেই টাকা যদি কেউ লুটেপুটে খায়, আর তাতে সরকার যদি নিশ্চুপ থাকে, তাহলে সরকারেরও ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সরকার যদি প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো তদন্তের নির্দেশ দেয়, আমি তাতে খুশি হব।
অধিক ব্যবসায়ের স্বার্থে আমাজন ধ্বংস করে দিচ্ছে বড় বড় করপোরেট হাউস। তাদের চাই উন্নয়ন! আমরা উন্নয়ন চাই জাহাঙ্গীরনগরেরও। কিন্তু গাছ কাটা নয়। আমাজনের ওই করপোরেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগরের গাছ কাটা ব্যবসায়ী আর প্রশাসনের কোনো পার্থক্য আমি খুঁজে পাই না। আমার দুঃখবোধ এখানেই আমরা শিক্ষিত বলে দাবি করি, কিন্তু সত্যিকার অর্থেই আমরা ‘শিক্ষিত’ হলাম না।
Daily Desh Rupantor
02.09.2019
0 comments:
Post a Comment