রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রশ্নটি নৈতিকতার


advertisement
বিএনপির একজন সংসদ সদস্যের ১০ কাঠা প্লটের আবেদনপত্র নিয়ে যে ‘বিতর্ক’ তার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো আরও একটি সংবাদ। এবারের সংবাদের শিরোনাম একজন প্রভাবশালী সাংসদের স্ত্রীকে নিয়ে। ওই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য নন। তবে তিনি মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত একটি ছোট দলের সাধারণ সম্পাদক ও পরপর দুবার মহাজোট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। সংবাদটি বের হয়েছে তার স্ত্রীকে নিয়ে, যিনি একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক। রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজের তিনি শিক্ষক। ৮ বছর ধরে কলেজে তিনি কোনো ক্লাস নেন না। তবে নিয়মিত বেতন নেন। থাকেন স্বামীর সঙ্গে ঢাকায়। তবে তিনি নিজে ক্লাস না নিয়ে যে কাজটি করেন তা শুধু অনৈতিকই নয়, বরং ফৌজদারি অপরাধতুল্য। তিনি ‘একজন মিমি’কে ঠিক করে রেখেছেন। ওই মিমি মাঝে মধ্যে ক্লাস নেন। আর এর বিনিময়ে মিমি একটি মাসোহারা পান। আর কলেজ অধ্যক্ষের বক্তব্য এ রকম : ‘ওই সাংসদের স্ত্রী নিয়মিত কলেজে আসতে পারেন না। সে কারণে তিনি একজনকে ঠিক করে দিয়েছেন তার ক্লাস নেওয়ার জন্য।’ কী সাংঘাতিক কথা? যিনি নিজে শিক্ষক হয়েও আরেকজনকে ঠিক করে দেন ক্লাস নেওয়ার জন্য! আর কলেজ অধ্যক্ষও বা কী করে তার অনুমতি দিলেন? এই অপরাধের ভার তো তারও।
একজন সংসদ সদস্যের স্ত্রী ঢাকায় স্বামীর পাশে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তিনি শিক্ষক হতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে তার উচিত ছিল কলেজ থেকে ছুটি নেওয়ার। কিন্তু তিনি তা না করে একজনকে ‘নিয়োগ’ দিলেন তার হয়ে কলেজে ক্লাস নেওয়ার জন্য। এটা কি তিনি পারেন? উপরন্তু তিনি নিয়মিত বেতন-ভাতা নেন। এটা কি নৈতিকতার পর্যায়ে পড়ে? তিনি একজন কলেজ শিক্ষক। তার কাছ থেকে তো তরুণ প্রজন্ম অনেক কিছু শিখবে? তিনি কী শেখালেন? আমি অবাক হয়ে যাই যখন তার স্বামী একজন সংসদ সদস্য হয়ে এই অনৈতিক কর্মকা-কে সমর্থন করেন! তার অজ্ঞাতে তার স্ত্রী ক্লাস না নিয়ে নিয়মিত কলেজে উপস্থিত না থেকে বেতন-ভাতা তোলেন, আর তিনি তা জানেন না, এটা আমি মানতে নারাজ। তিনি নিশ্চয়ই জানেন এবং জেনেশুনে তিনি স্ত্রীকে এই কাজটি করতে দিয়েছেন! একজন সংসদ সদস্য, যিনি দেশের জন্য আইন প্রয়োগ করবেন, জাতিকে নৈতিকতা শেখাবেন, তিনি কী করে নিজের স্ত্রীর অনৈতিক কর্মকা-কে সমর্থন করলেন? আমার দুঃখবোধ এখানেই। আমরা কার কাছ থেকে শিখব? তরুণ প্রজন্ম কাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাবে? ওই সংসদ সদস্য একটি বামদলের সাংসদ। তিনি অনেক ভালো ভালো কথা বলেন। কিন্তু ‘ঘরের মানুষ’ যখন অনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত থাকেন, তিনি নিশ্চুপ থাকেন কীভাবে? আমাদের আস্থার জায়গাটা আর থাকে কোথায়? এর আগে একজন বিএনপির সংসদ সদস্য ১০ কাঠার প্লট চেয়ে আবেদন করেন এবং আবেদনপত্রে ‘সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব’ এ কথা লিখে বড় বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন। সরকারের বড় সমালোচক এই তরুণ সংসদ সদস্য টক শোতে অনেক জনপ্রিয়। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে তিনি যেতে পারলেন না। ১০ কাঠার একটি প্লট তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। এর কোনো প্রয়োজন তার ছিল না। তার কাছে সুযোগ ছিল একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার। নিছক ব্যক্তিস্বার্থে তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জানালেন, তার কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট নেই। অথচ তার বাবার সহকর্মী ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, ওই সংসদ সদস্যের লালমাটিয়ায় ৩ কাঠার প্লট আছে। তিনি পৈতৃক সূত্রে এই প্লট ও এলিফ্যান্ট রোডের অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছেন (বাংলাদেশ জার্নাল, ২৭ আগস্ট)। তা হলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ওই সংসদ সদস্য মিথ্যা বলেছেন কিনা? একজন সংসদ সদস্য এফিডেভিটে সত্য তথ্য উল্লেখ করবেন, এটাই কাম্য। এখন তার দেওয়া বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় রাজনীতিতে তার ‘অবস্থান’ দুর্বল হলো মাত্র। তিনি এ কাজটি না করলেও পারতেন। তার বাবা উজ্জ্বল এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তার বিশাল এক ভূমিকা ছিল। জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগের তিনি সমালোচনা করে গেছেন। এখানে বাবার সঙ্গে তার রাজনৈতিক দর্শনের মিল আছে। কিন্তু অমিলটা এক জায়গায়। আর তা হচ্ছে তার প্রয়াত বাবা জীবিতকালে কোনো সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেননি। কিন্তু মেয়ে হয়ে তিনি নিতে চাইলেন, যা কিনা তার বাবার আদর্শের পরিপন্থী। গৃহায়নমন্ত্রীকে লেখা তার চিঠি এবং ১০ কাঠার একটি প্লট চাওয়া এখন প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানকেও দুর্বল করল। প্রধান বিরোধী দলটি ক্ষমতায় নেই প্রায় ১৩ বছর। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে ‘ব্যর্থ’ এই দলটিতে নানা সংকট চলছে। এখন শীতের পর তারা নতুন করে আন্দোলনের কথা বলছেন। কিন্তু এই দলের একজন সংসদ সদস্য যখন সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিতে চান, তখন দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বৈকি। নিশ্চয়ই আমি একজন সংসদ সদস্যের কর্মকা- নিয়ে পুরো দলের কর্মকা-কে বিচার-বিশ্লেষণ করব না। এই দলটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। মানুষের কাছে দলটির জনপ্রিয়তা এখনো আছে। কিন্তু নেতৃত্বের প্রশ্নে দল যে ভুল করছে, এটা তার বড় প্রমাণ। দলটি যোগ্য লোকদের এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি। টক শোতে অংশ নিয়ে সরকারবিরোধী কথাবার্তা বলে সাময়িক জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, কিন্তু বাস্তব এবং ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রতিফলন ঘটে না, ব্যক্তিস্বার্থ সেখানে বড় হয়ে দেখা দেয়। ওই সংসদ সদস্যই এর বড় প্রমাণ।
এটা ঠিক, ১০ কাঠার প্লট চেয়ে তিনি নৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু আমি তাকে দোষ দিই না। সব এমপিই তো প্লটসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন। ইতোমধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের পূর্বাচলে ১০ কাঠা করে প্লট দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনিও চাইলেন। তিনি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন। তিনি সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা না নিয়ে আগামীর সংসদ সদস্যদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু সুবিধাবাদিতা আর ব্যক্তিস্বার্থের যে রাজনীতি তাতে তিনি নিজেকে সমর্পণ করলেন। আমাদের দুঃখ এখানেই, দেশে ত্যাগী রাজনীতিবিদের জন্ম হচ্ছে না। সিনিয়র রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে সবাই বয়সের ভারে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদ আমাদের দরকার। যারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু আমরা কি তা পাচ্ছি? ব্যক্তি সুবিধার কাছে অন্য সবকিছু হেরে যাচ্ছে।
আমরা এখন কাদের কাছে আস্থা রাখব? তরুণ রাজনীতিবিদ তৈরির জন্য আমরা ডাকসু নির্বাচন করলাম। নির্বাচনটি যাই হোক না কেন, সংবাদপত্র থেকে জানলাম ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক একটি হলে এসি রুমে থাকেন, যেখানে সাধারণ ছাত্ররা গাদাগাদি করে গণরুমে থাকে। ছাত্ররা সিট পায় না, আর তাদের প্রতিনিধিত্বকারী ‘নেতা’ থাকেন এসি রুমে! আমরা ভবিষ্যৎ কেমন নেতা তৈরি করছি? এ জন্যই কী আমরা ডাকসু নির্বাচন দিয়েছিলাম? নৈতিকতা কোথায় গেল? আরও একটি সংবাদে আমি মর্মাহত। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুল্কমুক্ত গাড়ির জন্য আবেদন করেছেন। তিনি তো আর মন্ত্রী নন! ভাই মন্ত্রী। তিনি কী করে এই সুবিধা চান? তা হলে তাকে অনুমতি দিলে তো সাবেক সব মন্ত্রীকেই এই সুযোগ দিতে হবে! রাষ্ট্র তো কোনো বৈষম্য করতে পারে না। সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রের সব নাগরিক সমান। তাই সাবেক অর্থমন্ত্রী কোনো বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন না। রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেদের জন্য ‘সুযোগ’ তৈরি করে নিয়েছেন। এভাবে তারা সংসদ সদস্য হিসেবে যদি ‘বিশেষ সুবিধা’ চান, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য আগামীতে সম্ভব হবে না। একটি ‘বিশেষ শ্রেণি’ যদি এভাবে সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকেন তা হলে রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখার কর্মকর্তারাও এক সময় এ ধরনের দাবি করে বসবেন। সেনাসদস্য ও পুলিশ সদস্যদের (শুধু অফিসার পর্যায়ে) এই সুযোগ আছে। এতে করে জনসাধারণের মাঝে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। অনেক উন্নত দেশে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ নেই। তাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ বিশেষ করে প্লট বরাদ্দ, শুল্কমুক্ত গাড়ি বাতিল করা উচিত। রাষ্ট্র নাগরিকদের মাঝে কোনো বৈষম্য তৈরি করতে পারে না।
একজন সংসদ সদস্যের স্ত্রী অনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত থাকবেন বছরের পর বছর, একজন সংসদ সদস্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্লট চাইবেন, একজন ছাত্রনেতা বিলাসী জীবনযাপন করবেনÑ এ ধরনের সংবাদ আমাদের আহত করে। আমরা কার কাছে আস্থা রাখব? একজন সরকারি কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকা ঘুষ খান। একজন কর্মচারী শত শত কোটি টাকা অবৈধ পন্থায় অর্জন করেন। একজন ডিআইজি জেলখানা থেকে প্রতিদিন লাখ টাকা আয় করেন। এসব অবৈধ কর্মকা-। তাদের চিহ্নিত করে বিচার করা হচ্ছে। আর আজ যারা জাতিকে পথ দেখাবেন, তাদের অনৈতিক কর্মকা- যখন প্রশ্নের জন্ম দেয়, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না কোথাও।
Daily Amader Somoy
18.09.2019

0 comments:

Post a Comment