এমনি এক পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
আফগানিস্তানে একটি ‘শান্তির’ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ইতিমধ্যে একাধিকবার আফগান তালেবানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এমনকি তিনি তালেবান নেতাদের হোয়াইট হাউজে পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের আগের দিন কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে হামলার কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পিছিয়ে যান। তাই শান্তি আলোচনায় সৃষ্টি হয়েছে এক অনিশ্চয়তার। এখানে বলা ভালো, আল-কায়েদা ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই হামলা চালিয়েছিল। ওই ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল ১২ বিলিয়ন ডলারের। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পরিশোধ করেছিল ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের দাবিনামা। শুধু বিধ্বস্ত ভবন পরিষ্কার করতে ব্যয় হয়েছিল ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। এসব পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে, ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। যারাই এ কাজটি করে থাকুক না কেন, এর পেছনে ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্র। তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, তা আজও পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি অনেকের কাছেই। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বিশ্বাস করেন, তারা বলার চেষ্টা করেন, ‘টুইন টাওয়ার’-এ হামলায় এতগুলো মানুষ মারা গেল, একজন ইহুদিও মারা গেল না? এটা কী কাকতালীয়, না ওর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন এলাকার একদম শেষ প্রান্তে টুইন টাওয়ারটি অবস্থিত ছিল। সাবওয়ের ওটাই ছিল সর্বশেষ স্টেশন। ওই এলাকা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এ এলাকায় তথা টুইন টাওয়ারে ছিল। ওই এলাকায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অবস্থিত। আর সবাই এটা জানেন, ইহুদিরা এই এলাকার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে একজন ইহুদিও মারা যাবে না, এটা অনেকেই মানতে চান না।
ওই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেছিল। সেই যুদ্ধ আজও চলছে। ওই হামলায় প্রথমবারের মতো আল-কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং তৎকালীন আফগান তালেবান নেতা মোল্লাহ ওমর আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছেন, এই অভিযোগ তুলে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দেশটি দখল করে নেয়। এরপর ২০০৩ সালে ইরাকে মারণাস্ত্র রয়েছে এই অভিযোগ তুলে ইরাকও দখল করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপরের ঘটনা লিবিয়া ও সিরিয়ায়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ থেমে থাকেনি এবং আল-কায়েদার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও বন্ধ হয়নি। এরই মাঝে জন্ম হয়েছিল (সিরিয়া-ইরাক) ইসলামিক স্টেট নামে ভয়ংকর এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। অব্যাহত মার্কিন ও রুশ বিমান হামলায় ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা ২০১৭ সালে সিরিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ১৮ বছর ধরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকায়। মালি, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইরিত্রিয়া কিংবা সোমালিয়ায় নতুন নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যারা আল-কায়েদা কিংবা ইসলামিক স্টেটের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত, বোকো হারাম (নাইজেরিয়া) ও আল-শাবাব (সোমালিয়া)-এর নাম উল্লেখ করা যায়।
আফগানিস্তান, ইরাক কিংবা লিবিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন ডলার। ব্রাউন বিশ^বিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া আর সিরিয়ায় ‘যুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছেন ১১ মিলিয়ন মানুষ। এর মাঝে ইরাকে ৫০ লাখ, আফগানিস্তানে ৫০ লাখ এমনকি সিরিয়াতেও মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ লাখ। প্রায় ১০ লাখ সিরীয় নাগরিক যুদ্ধের কারণে দেশান্তরিত হয়েছেন এবং এরা এখন জার্মানিতে বসবাস করছেন। যুদ্ধ এই দেশগুলোক পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। একটি নতুন প্রজন্ম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? শিগগিরই এই যুদ্ধের শেষ হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল আফগান যুদ্ধ অবসানের। কিন্তু সে সম্ভাবনাও এখন পিছিয়ে গেল। এমনকি শান্তি আলোচনায়
তথাকথিত একটি ‘ঐকমত্যে’ উপনীত হওয়া সম্ভব হলেও, আফগানিস্তানে শান্তি নিশ্চিত হবে কি না বলা মুশকিল। কেননা, সেখানে শুধু তালেবানরাই একমাত্র ‘বিরোধীপক্ষ’ নয়। বরং আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরাও সেখানে তৎপর।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন তালেবান নেতাদের ওয়াশিংটনে ডাকার উদ্যোগ নিচ্ছেন (যা পরে পরিত্যক্ত হয়), তখন আল-কায়েদা একটা ভিডিও প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, প্রায় ১০০ আল-কায়েদা জঙ্গি মোটরসাইকেলে করে জাবুল প্রদেশের প্রাদেশিক হেডকোয়ার্টার দখল করে নিয়েছে (ভিডিওর শিরোনাম Fath operation in zabul)। এটা জুলাই ৩০-এর ঘটনা। যদিও আফগান সরকার এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই জাবুল প্রদেশসহ আরও দুটি প্রদেশ বাদাখাসান ও কুনার প্রদেশে আল-কায়েদা বেশ কিছুদিন ধরেই সক্রিয়। এর অর্থ হচ্ছে, তালেবানদের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন একটি ‘সমঝোতায়’ উপনীত হলেও, আল-কায়েদা সেই সমঝোতায় আসবে কি না সে প্রশ্ন থাকলই। একই সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের প্রশ্নটিও আছে ( Militants pose Major threat In Afganistan, Gandhara, July 02, 2019)। শীর্ষ ন্যাটো কমান্ডার জেনারেল অস্ট্রিন মিলার মে-জুন মাসে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আইএস আফগানিস্তান তথা আমাদের সবার জন্যই একটি সমস্যা’। একটি গণমাধ্যমে ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে এভাবে ‘আইএস সিরিয়া-ইরাকে তাদের খিলাফত হারানোর পর আফগানিস্তানে একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিচ্ছে।’ [দেখুন, মুসতাফা সারোয়ারের প্রবন্ধ S Militants pose Major threat In Afganistan, Gandhara, July 02, 2019। যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের গবেষক মাইকেল ক্যুগেলম্যানও মনে করেন, আফগানিস্তানে আইএসের তৎপরতা আমাদের সবার জন্যই একটি চিন্তার কারণ। আইএস যে খোদ রাশিয়া তথা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও হুমকি, তা স্বীকার করেছেন রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রধান আলেকজান্ডার রবার্টনিকভও। এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর পাশাপাশি চীন ও পাকিস্তানের ভূমিকা ভবিষ্যতে কী হবে এটাও একটা বড় চিন্তা।
চীন এই সংকটে এত দিন নিশ্চুপ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের একটি ভূমিকা লক্ষণীয়। চীন সম্প্রতি আফগানিস্তানের তালেবান নেতাদের বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। উদ্দেশ্য পরিষ্কার চীন আফগান সরকার ও তালেবানদের মধ্যে এক ধরনের দূতিয়ালি করতে চায়। কেননা, চীনের স্বার্থ দুটি। এক. আফগানিস্তানের খনি উন্নয়নে চীন জড়িত। দুই. চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে চীন আফগানিস্তানকেও অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ভুলে গেলে চলবে না, চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের ৭৬ কিলোমিটারের এক সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তের এক পাশে রয়েছে তাজিকিস্তান, অপর পাশে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তান, যে অঞ্চল হয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সড়কপথটি বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরে পৌঁছেছে। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ৮৮৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি চীন ও পাকিস্তানি সমুদ্রবন্দর গাওদারকে সংযুক্ত করেছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৬ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৬২ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। চীন স্বাভাবিক কারণেই এ সড়কের ‘নিরাপত্তা’ চাইবে। তাই তালেবানদের সঙ্গে তারা এক ধরনের সমঝোতায় যেতে চাচ্ছে। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান একটি ফ্যাক্টর। এটা সবাই জানে, তালেবানদের অস্ত্রের একটা বড় উৎস হচ্ছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
ফলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি যে খুব সহজ, তা বলা যাবে না। ১৮ বছর পার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর অবসান ঘটায়নি। এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস দমনে’ একটি বড় অবদান রাখতে পারবে। অন্যান্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘এই উদ্যোগ একই সঙ্গে একটি বড় অবদানও রাখতে পারবে
Daily Desh Rupantor
15.09.2019
0 comments:
Post a Comment