রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযান ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

Image result for Anti Casino movement Dhaka


গেল সপ্তাহে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন আওয়ামী যুবলীগের মালিকানাধীন বেশে কয়েকটি ক্যাসিনোতে র‌্যাবের অভিযান ও বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতাকে গ্রেফতারের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এর শেষ কোথায়? এই ক্যাসিনো পরিচালনা, সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার কিংবা বিদেশি মদ ও ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় সাধারণ মানুষ অবাক হলেও এ নিয়ে ইতোমধ্যে ‘রাজনীতি’ শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে সাবেক বিএনপি সরকারের আমলে ক্লাবগুলোতে এই ক্যাসিনো চালু হয়েছিল। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে দশ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তাহলে আওয়ামী লীগ এই দশ বছরে এই ক্যাসিনোগুলো চালাতে দিল কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন এই ক্যাসিনোগুলো অবৈধ, এগুলো সরকারের অনুমোদন নিয়ে পরিচালিত হতো না। প্রশ্নটা সেখানেই, কার বা কাদের নির্দেশে এই অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালিত হতো? ঢাকার মতিঝিল পাড়ায় একাধিক ক্লাবকে ঘিরে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালিত হতো। আরও আগে কেন এসব বন্ধের উদ্যোগ নিলেন না?

সরকার যে শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে, তার রেশ ধরেই ওয়ান্ডারার্স, কলাবাগান ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে তা বন্ধ করে দেয়। এরপর বন্ধ হয় ভিক্টোরিয়া ক্লাব, দিলকুশা ও আরামবাগ ক্লাব। অভিযান পরিচালিত হচ্ছে চট্টগ্রামেও। দেরিতে হলেও সরকারের এই শুদ্ধি অভিযান প্রশংসা পাবার যোগ্য। এখানে যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে শুধু যুবলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে কেন? যে নামগুলো পত্রিকায় এসেছে, শুধু তারাই কি এসব জুয়া বা ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত? ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, মোল্লা মো. আবু কাওসার, একেএম মোমিনুল হক সাঈদ কিংবা জিকে শামীম কিংবা শফিকুল আলম ফিরোজ (কলাবাগান) যাদেরকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে, করতে চাইছেÑ তারা প্রায় সবাই যুবলীগের সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও আরও লোক জড়িত। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত। সরকার অনেক শক্ত অবস্থানে গেছে। সবার উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা। আরও একটা কথা। কথা উঠেছে, গ্রেফতাররা সবাই ছিল যুবদলের সদস্য। এটা হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জেনে শুনে তাহলে এদের যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল কেন? এদের প্রথম যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন যুবলীগ সভাপতি অত্যন্ত উদ্ধত ভাষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করেছিলেন। তার ‘আঙুল চোষা’ তত্ত্ব নিয়ে একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্র উপ-সম্পাদকীয় পর্যন্ত প্রকাশ করেছিল। যুবলীগ সভাপতি রাগান্বিত হয়ে যা বলেছেন, তা অশোভন। এটা বলা তার উচিত হয়নি। এ ধরনের বক্তব্য প্রকারান্তরে দুর্নীতিবাজদের সমর্থন করার শামিল।
ক্যাসিনো অভিযান নিয়ে আরও তিনটি কথা। এক. ফকিরাপুল ক্লাবের সভাপতি হচ্ছেন একজন সংসদ সদস্য। তিনি তা স্বীকারও করেছেন। তবে বলেছেন ওই ক্লাবে যে ক্যাসিনো চলে, তা তিনি জানতেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে জড়িত যুবলীগ নেতাকে যদি গ্রেফতার করা হয়, তাহলে ওই সংসদ সদস্যকেও কি একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না? তিনি তার দায় এড়াতে পারেন না। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য। দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি একটি ক্লাবের সভাপতি, সেই ক্লাবে জুয়ার আসর বসে, অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে, তিনি তা জানেন নাÑ এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। হতে পারেন তিনি সংসদ সদস্য। কিন্তু তিনিও সমান অপরাধী।
দুই. সারা দেশে যখন ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলছে, তখন চট্টগ্রামের একজন সংসদ সদস্যের বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। এতে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, ক্লাবের তাস খেলা বন্ধ করে শেষ লাভ হবে না। তাস খেলা বন্ধ করলে ছেলেরা রাস্তায় ছিনতাই করবে (প্রথম আলো ২২ সেপ্টেম্বর)। তার এই বক্তব্য কী জুয়া খেলাকে উৎসাহিত করল না? একজন সংসদ সদস্য, যিনি দেশের ভালো মন্দের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন, আইন প্রণয়নে সংসদকে সহযোগিতা করবেন, তিনি কি এ ধরনের কথা বলতে পারেন? একজন সংসদ সদস্য যদি এ ধরনের কথা বলেন, তা কি প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল না? প্রধানমন্ত্রী তো ‘ক্যাসিনো সম্রাট’দের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে সর্বমহল থেকে প্রশংসা পেয়েছেন। এখন তার দলীয় একজন এমপি অবস্থান নিলেন জুয়াড়িদের পক্ষে। এটা দুঃখজনক। ওই সংসদ সদস্য চট্টগ্রামে একটি ক্লাব চালান। পত্রিকায় দেখলাম পুলিশের এক পরিদর্শক নিজের ফেসবুকে পেজে লিখেছেন, ক্লাবের জুয়া খেলা থেকে ওই সংসদ সদস্যের ৫ বছরের আয় ১৮০ কোটি টাকা। থানার ওসিরা প্রতিদিন ক্লাব থেকে কত টাকা আয় করেন, তারও হিসাব আছে তাতে। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, তিনি দায়িত্ব নিয়েই এ কথা লিখেছেন। এর সত্যতা কতটুকু আমি জানি না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এটা ভালো বলতে পারবে। তবে অভিযোগটি গুরুতর। এটাও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
তিন. যুবলীগের এক নেতা ‘ঠিকাদার মোগল’ জিকে শামীম। সরকারের এই শুদ্ধি অভিযানে তার নিকেতনস্থ অফিসে পাওয়া গেছে ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর আর নগদ প্রায় ২ কোটি টাকা। ‘টাকার কুমির’ এই ঠিকাদারের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা আছে বলে সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে। তিনি রূপপুরের বালিশ কেলেঙ্কারির সঙ্গেও জড়িত। তার সম্পর্কে আরও যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। কয়েক হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারির কাজ তিনি পেয়েছেন। এসব কাজ পেতে গণর্পূত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীকে দিয়েছেন শত শত কোটি টাকা (সমকাল ২২ সেপ্টেম্বর)। একজন শামীম ব্যবসা করতেই পারেন। কিন্তু ব্যবসার নামে তিনি যে ‘ঘুষ বাণিজ্য’ করেছেন, তা যেকোনো সাধারণ মানুষকে অবাক করে দেবে। কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না
থাকলে, তিনি এভাবে অবৈধভাবে ঠিকাদারি বাগিয়ে নিতে পারতেন না।
প্রতিদিনই যখন এ ধরনের সংবাদ ছাপা হয়, তখন এক ‘ভিন্ন বাংলাদেশে’র ছবি ভেসে ওঠে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নামে এই যে দুর্নীতি, এই দুর্নীতি আমাদেরকে হতাশার মাঝে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের মানুষ কি এই জন্য এত রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিল? যে-ই দুর্নীতি করবে, তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সে যত ‘বড়ই’ হোক, সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে পারিবারিক দুর্নীতির অভিযোগে ওঠার পরই সরকার যুবলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাসিনো সম্রাট’দের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগরের দুর্নীতির অভিযোগটি যেন ধামাচাপা পড়ে না যায়। সেখানে দুর্নীতি হয়েছে, কী হয়নি, এটা জানা দরকার। একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ গুরুতর। যারা অভিযোগটি এনেছিলেন, তারা এখনও আন্দোলন করছেন। সুতরাং বিশ^বিদ্যালয়ের স্বার্থেই এর তদন্ত হওয়া দরকার। ইউজিসি একটি তদন্ত কমিটি করেছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। দুদক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে পারে। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপসারিত হয়েছেন এ কারণেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী যে শক্ত অবস্থানে গেছেন, এটা তার বড় প্রমাণ। তিনি ছাত্রলীগ, যুবলীগ কাউকেই ছাড় দেননি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। এদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করা উচিত। এ ধরনের শুদ্ধি অভিযান অনেকগুলো মেসেজ দেবে। এক. অবৈধ উপায়ে যারা অর্থ আয় করেন, তারা সতর্ক হবেন। আওয়ামী লীগের নাম করে যে দুর্নীতি করা যাবে না, এই ‘সত্যটি’ এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে। আওয়ামী লীগ করলেই সব কিছু ‘মাফ’ এটা বলা ও চিন্তা করার দিন এখন শেষ। দুই. যারা ঘুষ নেন ও ঘুষ দেন তারা উভয়েই অপরাধী। উভয়কেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধি অভিযান চালানো উচিত। এই সেক্টরগুলোতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। অতীতে যারা শীর্ষ পদগুলোতে ছিলেন, তাদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করা উচিত। এ কাজে দুদককে ব্যাবহার করা যেতে পারে। তিন. টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি শামীমদের মতো টাকার কুমিরদের জন্ম দিয়েছে। এখন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কীভাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, তা ভেবে দেখতে হবে। ই-টেন্ডার নিয়েও কথা আছে। ই-টেন্ডারও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারছে না। শামীমদের মতো লোকেরা অসৎ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করছে। তাদের কারও কারও সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠছে মন্ত্রীদের সঙ্গে। এই ‘সখ্যতা’ যেন অপরাধী বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। চার. যারাই ছাত্রলীগ তথা যুবলীগের নেতৃত্বে আছেন বা থাকবেন, তাদের অতীত আমলনামা দেখা প্রয়োজন। যুবলীগ চেয়ারম্যান বলেছেন, তিনি অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজ যুবলীগ নেতাদের ট্রাইব্যুনালে বিচার করবেন। এতে করে তো স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয় না। বরং এটা আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার শামিল। দুর্নীতি হলে তা দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হবে। যুবলীগ চেয়ারম্যান নিজে কেন বিচার করবেন?
একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানকে স্বাগত জানাই। একটি টাস্কফোর্সের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবাজদের কতটুকু শাস্তির আওতায় আনা যাবে বলা মুশকিল। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে সামাজিক আন্দোলনের একটি অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে দিব্যি ‘আরামে’ আছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হোক। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের পক্ষে অন্যতম অন্তরায়। দুর্নীতিকে যদি আমরা উচ্ছেদ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ যে এই অঞ্চলে অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই শুদ্ধি অভিযানের ফলে জনমানসে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে
Daily Shomoyer Alo
29.09.2019

0 comments:

Post a Comment