প্রশ্নটি হচ্ছে নৈতিকতার। একদিকে সরকারের সমালোচনা, অন্যদিকে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ নেওয়া! ১০ কাঠার প্লট চাওয়া একজন এমপির জন্য মানানসই নয়। এমপি হলেই কি প্লট আর ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি নিতে হবে? একটি ১০ কাঠার প্লট না পেলে কি একজন এমপির জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে? এ দেশের অনেক লোকের এই ঢাকা শহরে কোনো প্লট কিংবা ফ্ল্যাট নেই। এ দেশের অনেক কৃতী রাজনীতিবিদ আছেন, যাঁরা রাজনীতি করেছেন; কিন্তু কোনো দিন প্লট ও ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি চাননি। মওলানা ভাসানী একজন কীর্তিমান পুরুষ। ঢাকা শহরে তাঁর কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট ছিল না। তিনি চাইলে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে প্লট, গাড়িসহ অনেক কিছুই নিতে পারতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি কিছুই চাননি। সন্তোষের ওই কুঁড়েঘরে থেকে আজীবন তিনি সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলে গেছেন। রাজনীতির জন্য তাঁর প্লট, গাড়ি, বাড়ির প্রয়োজন ছিল না। প্রকাশ্যে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করলেও ওই বঙ্গবন্ধুই তাঁকে প্রতি মাসে লুঙ্গি-গামছা কিনে দিতেন। তাঁর সন্তুষ্টি ছিল এখানেই। আজ যিনি বিরোধী দলের এমপি, তিনি কি না চাইলেন ১০ কাঠার একটি প্লট! রাজনীতি কি সত্যিকার অর্থেই সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির একটি জায়গা?
দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ঢাকায় তাঁর একটি অ্যাপার্টমেন্ট, তিন কাঠার একটি প্লট ও চট্টগ্রামেও একটি প্লট আছে। অথচ মন্ত্রীর কাছে লেখা পত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, ঢাকায় তাঁর কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট নেই। অথচ তাঁর বাবার সহকর্মী ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, ওই সংসদ সদস্যের লালমাটিয়ায় তিন কাঠার প্লট আছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তিনি পৈতৃক সূত্রে এই প্লট ও এলিফ্যান্ট রোডের এপার্টমেন্ট পেয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ওই সংসদ সদস্য মিথ্যা বলেছেন কি না? একজন সংসদ সদস্য এফিডেভিটে সত্য তথ্য উল্লেখ করবেন—এটাই কাম্য। এখন তাঁর দেওয়া বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় রাজনীতিতে তাঁর ‘অবস্থান’ দুর্বল হলো মাত্র। তিনি এ কাজটি না করলেও পারতেন। তৃতীয়ত, তাঁর বাবা উজ্জ্বল এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর বিশাল এক ভূমিকা ছিল। জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগের তিনি সমালোচনা করে গেছেন। এখানে বাবার সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মিল আছে। কিন্তু অমিলটা এক জায়গায়। আর তা হচ্ছে তাঁর প্রয়াত বাবা জীবিতকালীন কোনো সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেননি। কিন্তু মেয়ে হয়ে তিনি নিতে চাইলেন, যা কি না তাঁর বাবার আদর্শের পরিপন্থী। চতুর্থত, গৃহায়ণমন্ত্রীকে লেখা তাঁর চিঠি এবং ১০ কাঠার একটি প্লট চাওয়া এখন প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানকেও দুর্বল করল। প্রধান বিরোধী দলটি ক্ষমতায় নেই প্রায় ১৩ বছর। সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে ‘ব্যর্থ’ এই দলটিতে নানা সংকট চলছে। এখন শীতের পর তারা নতুন করে আন্দোলনের কথা বলছে। কিন্তু এই দলের একজন সংসদ সদস্য যখন সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিতে চান, তখন দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বৈকি! নিশ্চয়ই আমি একজন সংসদ সদস্যের কর্মকাণ্ড নিয়ে পুরো দলের কর্মকাণ্ডকে বিচার-বিশ্লেষণ করব না। ওই দলটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। মানুষের কাছে দলটির জনপ্রিয়তা এখনো আছে। কিন্তু নেতৃত্বের প্রশ্নে দল যে ভুল করছে, এটা তার বড় প্রমাণ। দলটি যোগ্য লোকদের এখনো খুঁজে বের করতে পারেনি। পঞ্চমত, টক শোতে অংশ নিয়ে সরকারবিরোধী কথাবার্তা বলে সাময়িক জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়, কিন্তু বাস্তব ও ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রতিফলন ঘটে না, ব্যক্তিস্বার্থ সেখানে বড় হয়ে দেখা দেয়। ওই সংসদ সদস্যই এর বড় প্রমাণ।
এটা ঠিক, তিনি ১০ কাঠার প্লট চেয়ে তাঁর নৈতিক অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু আমি তাঁকে দোষ দিই না। সব এমপিই তো প্লটসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন। ইতিমধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের পূর্বাচলে ১০ কাঠা করে প্লট দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনিও চাইলেন। তিনি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন। তিনি সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা না নিয়ে আগামীর সংসদ সদস্যদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু সুবিধাবাদিতা আর ব্যক্তিস্বার্থের যে রাজনীতি, তাতে তিনি নিজেকে সমর্পণ করলেন। আমাদের দুঃখ এখানেই, দেশে ত্যাগী রাজনীতিবিদের জন্ম হচ্ছে না। সিনিয়র রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে সবাই বয়সের ভারে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদ আমাদের দরকার, যাঁরা একুশ শতকে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু আমরা কি তা পাচ্ছি? ব্যক্তি সুবিধার কাছে অন্য সব কিছু হেরে যাচ্ছে। আমরা ত্যাগী রাজনীতিবিদ পাচ্ছি না। এটা দুঃখজনক। ওই সংসদ সদস্যের চিঠিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ায় কিছু প্রশ্ন আমাদের মধ্যেও উদয় হয়েছে। এক. চিঠিটি মন্ত্রণালয় থেকে মিডিয়ার কাছে গেল কিভাবে? কিংবা এই ফাঁস হওয়ার ঘটনাটি কি ঠিক হয়েছে? এ প্রশ্ন ওই সংসদ সদস্য নিজেও করেছেন। চিঠিটি একটি ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে আবেদনকারীর ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করা একটা অপরাধ। গৃহায়ণমন্ত্রী কিংবা তাঁর মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এর দায় এড়াতে পারেন না। আমরা এখনো পর্যন্ত এ ব্যাপারে তাঁর কোনো বক্তব্য পাইনি। মন্ত্রী নিজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের সাঁড়াশি অভিযানের হুমকি দিয়েছেন। তিনি নিজে তাঁর মন্ত্রণালয়কে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চান। কিন্তু এই ‘ঘটনা’ কি তাঁর নিজের ভাবমূর্তিকে এতটুকুও ক্ষুণ্ন করবে না? এটা যদি বিরোধী সংসদ সদস্যকে অসম্মানিত ও ‘ছোট’ করার কোনো ‘কৌশল’ হয়ে থাকে, তাহলে তাও ভালো নয়। এই ‘কৌশল’ বুমেরাং হয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতে! কিভাবে এই চিঠি গণমাধ্যমে গেল, কে দিল, এটা বের করার জন্য তিনি যদি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন, তাহলে ভালো করবেন। তাঁর অবস্থান শক্তিশালী হবে। তিনি নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারবেন। না হলে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এ ঘটনায় মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বেড়াতে চাইবেন!
দুই. চিঠি ফাঁসের বিষয়টির সঙ্গে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের শুল্কমুক্ত গাড়ি চাওয়ার দাবিকে আড়াল করার একটি কৌশল হিসেবে দেখছেন ওই সংসদ সদস্য। একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী, যিনি এখন আর এমপি নন, তিনি কী করে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ পান? রাষ্ট্র কি তাঁকে এ সুবিধা দিয়েছে? তাহলে তো সাবেক সব মন্ত্রী একে একে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ চেয়ে বসবেন। রাষ্ট্র এভাবে কোনো ব্যক্তিকে কোনো বিশেষ সুবিধা দিতে পারে না। উপরন্তু সংবিধানের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান। সাবেক অর্থমন্ত্রী, তাই কোনো বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন না। তিন. রাজনীতিবিদরা নিজেরা নিজেদের জন্য ‘সুযোগ’ তৈরি করে নিয়েছেন। এভাবে তাঁরা সংসদ সদস্য হিসেবে যদি ‘বিশেষ সুবিধা’ চান, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য আগামীতে সম্ভব হবে না। একটি ‘বিশেষ শ্রেণি’ যদি এভাবে সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখার কর্মকর্তারাও একসময় এ ধরনের দাবি করে বসবেন। সেনা সদস্য ও পুলিশ সদস্যদের (শুধু অফিসার পর্যায়ে) এই সুযোগ আছে। এতে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। অনেক উন্নত দেশে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ নেই। সুতরাং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’, বিশেষ করে প্লট বরাদ্দ, শুল্কমুক্ত গাড়ি বাতিল করা উচিত। রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য তৈরি করতে পারে না।
বিরোধী দলের জনৈক সংসদ সদস্যের ১০ কাঠার প্লট চেয়ে গৃহায়ণমন্ত্রীর কাছে আবেদন ওই সংসদ সদস্যের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তাঁর দলও এ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সংসদ সদস্যের যে ‘সুনাম’ ছিল, তিনি সরকারের কাছ থেকে ‘বিশেষ সুবিধা’ নিতে চাওয়ায় তাঁর নামের প্রতি তিনি সুবিচার করতে পারলেন না। অবশ্য পরে তিনি পূর্বাচলের প্লটের জন্য করা তাঁর আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
Daily Kalerkontho
02.09.2019
0 comments:
Post a Comment