বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্ট
কুতুপালং ক্যাম্পে একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে তাদের পাঁচ দফা দাবি
উত্থাপন করে বলেছে এসব দাবি মানা না হলে কোনো রোহিঙ্গা নিজ দেশ মিয়ানমারের
রাখাইনে ফিরে যাবে না। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ৭
লাখ ৪২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এরপর রোহিঙ্গাদের ফেরত
নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও, মিয়ানমারের
সময়ক্ষেপণ ও নানা টালবাহানের কারণে এতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন
সম্ভব হয়নি। ২২ আগস্ট একটি দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ওই দিন একজন
রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট এই রোহিঙ্গা
সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয় ও তারা তাদের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করে। এই পাঁচ
দফার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান, নির্যাতনের
জন্য ক্ষতিপূরণ, মিয়ানমারে তাদের চলাফেরার অধিকার ও রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও
নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার। এর আগে আরও একটি দাবি তারা
জানিয়েছিল আর তা হচ্ছে রোহিঙ্গারা কোনো অভ্যর্থনা ক্যাম্পে নয়, বরং তারা
নিজেদের পৈতৃক ভিটায় ফিরতে চায়।
সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গাদের এই দাবি ও একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফেরত না যাওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, বেশকিছু এনজিও চায় না রোহিঙ্গারা ফেরত যাক। রোহিঙ্গারা চলে গেলে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদান কমে যাবে। তাই তারা রোহিঙ্গাদের উসকে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন, জনসমাবেশ সংঘটিত করা এসবই এনজিওদের উৎসাহে হয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন, মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড কারম্যান রাখাইন স্টেটকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি করেছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। জাতিসংঘ সনদে এ ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ সনদের ২নং ধারায় (২.৩) উল্লেখ করা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল রাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে সব ধরনের বিরোধের মীমাংসা করবে। তারা এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না, যা বিশ^ শান্তিকে বিঘিœত করে। জাতিসংঘ সনদের ২.৪ ধারায় বলা আছে কোনো রাষ্ট্র অপর একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব বিঘিœত হয় এমন কোনো কর্মকাÐে অংশ নেবে না। সুতরাং জাতিসংঘ সনদের ২.৩ ও ২.৪ ধারা লঙ্ঘিত হয় এমন কোনো কর্মকাÐে (অর্থাৎ পরোক্ষভাবে যুদ্ধ কিংবা অন্যের এলাকা দখল করা) বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে না। কংগ্রেসম্যান শারম্যানের বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি ও অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়ে আসছে। এটাই বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাসি। রাখাইন প্রদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনও উত্তোলন করা হয়নি। মিয়ানমার ২০১২ সালে একটি আইন পাস করেছে (ঠরৎমরহ খধহফং গধহধমবসবহঃ ধপঃ-ঠঋঠ)। এই আইন অনুযায়ী পরিত্যক্ত কিংবা যে জমি ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার প্রয়োজন ও উন্নয়নের স্বার্থে যেকোনো ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। মিয়ানমার সরকারও তাই করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনের প্রায় ৩৬২ গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানকার বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব গ্রামের বসতবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও সেনা ছাউনি করা হয়েছে। কোথাও বা আবার ওই জমি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। খনি খনন করে তারা সেখান থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে অন্যান্য মিনালের অনুসন্ধান চলছে। তুলনামূলক বিচারে চীন ও ভারতের আগ্রহ এখানে বেশি। রাখাইন শেষে বঙ্গোপসাগরের গভীরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ পাওয়া গেছে। চীনের আগ্রহটা সে কারণেই। চীন রাখাইনের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে। এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ তার জ্বালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান রাজ্যে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার) সরবরাহ করেছে। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাই বাহুল্য ইউনান প্রদেশের জ্বালানি সুধা মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে ৫৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে এবং তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ শতাংশ। চীন রাখাইন প্রদেশের শুধঁশঢ়যুঁ-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একই সঙ্গে গঁংব-গধহফধষধু রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে করে শুধঁশঢ়যুঁ থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী গঁংব পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশ নিয়ে যাওয়া। সুতরাং সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগে রয়েছে। সেখানে তাদের জাতীয় ঋণ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক, কিংবা মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, এটা চীন চায় না। চীন ভালো করে জানে এ সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তাহলে ইঈওগ করিডোর মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থাৎ কুনমিং (ইউয়ানের রাজধানী) থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত যে সড়কপথ রেলপথ (মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে) তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদৌ বাস্তবায়িত তবে না। অথচ চীনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে ইঈওগ করিডোরের পরিকল্পনাটি। চীন তাই একধরনের সমঝোতা চায়, যাতে তার স্বার্থ রক্ষিত হয়। এদিকে গত মার্চ মাসেই মিয়ানমার সরকার রাখাইন স্টেটে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ৩০টি চুক্তি করেছে। এতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ দশমিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার (সিনহুয়া নিউজ, ১ মার্চ ২০১৯)। এর অর্থ পরিষ্কার চীন মিয়ানমারের বিরোধী কোনো কর্মকাÐকে সমর্থন করবে না। চীন বারবার বলে আসছে দ্বিপক্ষীয় (মিয়ানমার ও বাংলাদেশ) আলোচনার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাজটি সম্পন্ন হোক। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন ও একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফেরত না যাওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটি এখন ঝুলে গেল। প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কী? ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গেল দু’বছরে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের পেছনে খরচ করেছে ৭২ হাজার কোটি টাকা (বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ আগস্ট)। বাংলাদেশ যে আগামীতে আর এই অর্থ বহন করতে পারবে না, এ কথাটাও তিনি জানিয়েছেন। আরও একটা উদ্বেগের খবর আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। আর তা হচ্ছে একাধিক সন্ত্রাসী দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসী আল ইয়াকিন গ্রæপের নামও সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিরা ইতোমধ্যে সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে বাঙালিদের মৃত্যুর খবরও একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এই যে পরিস্থিতি, তা কোনো আশার কথা বলে না। বিশাল একটি বিদেশি গোষ্ঠী অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করবে, এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে ভ‚মিকা পালন করার কথা তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পালন করছে না। সংগত কারণেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? মাত্র ৩৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমার গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য এই সংখ্যা কিছুই না। কিন্তু তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি মিয়ানমার। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আশ^াস না পেলে রোহিঙ্গারা যে যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা ও মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সে সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা, যারা নির্যাতন ও হত্যার জন্য দায়ী, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। Daily Somoyer Alo 01.09.2019 |
রোহিঙ্গাদের পাঁচ দফা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
19:51
No comments
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment