ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো তাসলিমা বেগম রেনুকে। ছেলেধরা সন্দেহে কিছু 'খুনি' তাকে পিটিয়ে হত্যা করল, হাজার হাজার লোক তাকিয়ে দেখল, কোনো প্রতিবাদ করল না। যে শহরে মানুষকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়, প্রতিবাদ হয় না, সে শহর আমার না। সোশ্যাল মিডিয়ায় রেনুর বিধ্বস্ত মুখ এখন ঘুরছে। তার আকুতি কেউ শুনল না। ছেলেধরা সন্দেহে তাকে 'সাপের মতো' পিটিয়ে মেরে ফেলল। একটা লোকও এগিয়ে এলো না তাকে বাঁচাতে। কেউ জানল না, শুনল না ছোট্ট মেয়ে তুবার কী হবে? তার বিধ্বস্ত চেহারা, এলোমেলো চুল কি বলতে চেয়েছিল তুবার কথা? স্বামী পরিত্যক্ত এই নারী একা দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। রাষ্ট্র কি এখন তুবার দায়িত্ব নেবে? প্রধানমন্ত্রী তো কত দুস্থ, অনাথ শিল্পীকে লাখ লাখ টাকা সাহায্য করেন। প্রধানমন্ত্রী কি তুবার আত্মীয়-স্বজনকে ডেকে তুবার ভবিষ্যতের জন্য কয়েক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তুলে দেবেন? যে শহর অসহায় তুবার মাকে বাঁচতে দিল না, সেই শহর আমার না। যে শহর 'পদ্মা সেতুর জন্য কল্লা চাই' গুজব ছড়ায়, এই শহর আমার না।
ডেঙ্গু এখন আতঙ্কের নাম। এরই মধ্যে মারা গেছেন অন্তত ৫০ জন। শত শত মানুষ ভর্তি রয়েছে হাসপাতালে। যে শহরে দুটি সিটি করপোরেশনের মশক নিধনের বার্ষিক বাজেট ৪০ কোটি টাকা, সেই বাজেটের টাকা কোথায় যায়- আমরা এই প্রশ্ন কেউ করি না। যে শহর নাগরিকদের নূ্যনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, সেই শহর আমার না। যে শহরের একজন ডিআইজি মিজান পুরো পুলিশ প্রশাসনের সব ভালো কর্মকাণ্ডকে ম্লান করে দেয়, যে শহরে একজন ডিআইজি তার হলফনামায় চার কোটি ৯২ লাখ ৪৯ হাজার টাকার হিসাব দেয় এবং অপ্রদর্শিত অর্থ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না- সে শহর আমার না। যে শহরে আবারও বোমা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে (পল্টন ও খামারবাড়িতে পাওয়া বোমাসদৃশ বস্তু), সে শহর আমার না।
২০১৬ সালের হলি আর্টিসানের ঘটনার পর আমরা স্বস্তিতে ছিলাম। ঢাকায় আবার জঙ্গিবাদ কি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে? হাইকোর্টের নির্দেশে পাস্তুরিত দুধের ১১টি নমুনা বিভিন্ন গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। তাতে পাওয়া গেছে, যা আগেই অধ্যাপক ফারুকের গবেষণায় পাওয়া গিয়েছিল। এখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে। কিন্তু ওই অতিরিক্ত সচিবের কী হবে, যিনি অধ্যাপক ফারুককে হুমকি দিয়েছিলেন? এই শহরে আমার কেটেছে কৈশোর, যৌবন আর আমার কর্মক্ষেত্র। ৪৭ বছরের এই 'শহুরে জীবনে' অতিসম্প্রতি আমার বাসায় ডাকাতি হয়েছে। গাড়ি চুরির চেষ্টা চালানো হয়েছে। এই শহর আমার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। যে শহর আমার নূ্যনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, এই শহর আমার না।
গত ২৩ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ বসে নেই। পুলিশকে দুর্বল ভাববেন না। ফেসবুকে গুজব সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশে তিনি এ কথা বলেন (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই)। পদ্মা সেতু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের গুজবের জেরে গণপিটুনিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেন। প্রায় একই সময় আইজিপিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। রাজধানীর পল্টন ও খামারবাড়িতে বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের আইজি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী মন্তব্য করেছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে! এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। রাষ্ট্রের পুলিশপ্রধান যখন এ ধরনের একটি মন্তব্য করেন, তখন বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়া যায় না। ছেলেধরা সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে মানুষ পিটিয়ে মারা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে গুজবটি আরও মারাত্মক। একই সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বোমাসদৃশ বস্তু রেখে যাওয়া হচ্ছে। এসব আলামত ভালো নয়। সরকারকে বিপদে ফেলার এটি যে জঘন্য কাজ, তা একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হলো উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে দিনদুপুরে ডাকাতির চেষ্টা, গাড়ি চুরির চেষ্টা।
দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর থেকে আস্থা হারানো- সবই একটি পরিকল্পনার অংশ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা তাই বড় ও ব্যাপক। দ্রুততার সঙ্গে পুলিশ তাসলিমার হত্যাকারীদের গ্রেফতার করেছে। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে যারা গুজব ছড়িয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে যারা গাড়ি চুরির সঙ্গে জড়িত, তাদের ছবি আছে ও তাদের যদি গ্রেফতার করা সম্ভব হয়, তাহলে ওই এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসবে। না হলে ওই এলাকায় মানুষ আর বসবাস করতে আসবে না। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প এটি। প্রায় নয় হাজার ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে এ প্রকল্পের জন্য।
রূপপুরের 'বালিশ কাহিনী' সারাদেশে আলোড়ন তুলেছিল। মন্ত্রীবাহাদুর আমাদের জানিয়ে দিলেন, 'বালিশ কাহিনী'র সঙ্গে ৩৪ ব্যক্তি জড়িত। কিন্তু উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে (১৮ নম্বর সেক্টর) যে কত 'বালিশ কাহিনী' রয়েছে, তার হিসাব কে করবে? বহুতল ভবনে একাধিক লিফট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সিডিউল অনুযায়ী লিফটগুলো স্থাপন করা হয়নি। অনেক ভবনের লিফটই এর মধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। নিম্নমানের ম্যাটারিয়াল দিয়ে ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজউকের কোনো 'সুপারভিশন' ছিল না। এখানে যে শত শত 'বালিশ কাহিনী' রয়েছে, তার কাহিনী কোন সংবাদপত্র প্রকাশ করবে? যে শহরে নয় হাজার ৩১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে 'নয়ছয়' হয়, এই শহর আমার না। এই শহর, শহর প্রশাসনের মানুষগুলো আমার নূ্যনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, এই শহর আমার না।
এই শহর একজন প্রিয়া সাহাকে 'জন্ম' দিয়েছে। তিনি বাংলাদেশের একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সুযোগে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে! তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাহায্যও কামনা করেছেন। যে কোনো দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি মার্কিন আইনে অত্যন্ত কঠোরভাবে দেখা হয়। একসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া প্রিয়া সাহা বিষয়টি জানেন। জেনেশুনে তিনি কীভাবে নিজ দেশের বিরুদ্ধে অন্য একটি দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে নালিশ করেন? তাকে নিয়ে এখন নানা সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই শহর যখন একজন প্রিয়া সাহাকে জন্ম দেয়, এই শহর আমার না। এটা কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কি-না জানি না। কিন্তু সরকারকে অস্থিতিশীল করার নানা ষড়যন্ত্র চলছে। রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে বিদেশি শক্তি যখন এই সংকট থেকে নানা ফায়দা ওঠাতে চাইছে, তখন প্রিয়া সাহার বক্তব্য আমাদের অনেক 'ক্ষতি' করে গেল। প্রিয়া সাহা তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে হয়তো বিতর্কের অবসান ঘটত। কিন্তু তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি। এটা সত্যিই দুঃখজনক।
এই শহরকে আমি আর চিনতে পারি না। একপশলা বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাস্তায় নৌকা চলে। হাঁটুপানি হয়ে যায় কোথাও কোথাও। অবাক হয়ে ভাবি, কোথায় সুশাসন? কোথায় সিটি করপোরেশন? কোথায় স্থানীয় সরকার? প্রতিবছরই এ সময় আমরা এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু কেউ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না? সবাই যেন তাকিয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য! বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, দু'জন মেয়র, একাধিক মন্ত্রণালয়ের একাধিক আমলা- তাহলে তাদের কী প্রয়োজন?
এই শহর আরেকটি সংবাদেরও জন্ম দিয়েছে। মানুষের দৃষ্টি যখন 'গণপিটুনি' আর 'কল্লা কাহিনী'র দিকে নিবদ্ধ, তখন শেয়ারবাজার থেকে হাওয়া হয়ে গেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা! এটা সংবাদপত্রের ভাষ্য। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে কোনো পক্ষকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। শুধু দেখেছি বিক্ষোভকারীদের ছবি আর তাদের অসহায়ত্ব।
এই শহরের ভালো ভালো সংবাদ হারিয়ে যাচ্ছে। মন্দ সংবাদগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। আমরা মন্দ সংবাদগুলোর কাছে 'জিম্মি' হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। যে শহর এখন আর ভালো কোনো সংবাদ দেয় না, এই শহর এখন আর আমার না।
সমকাল
১ আগস্ট বৃহস্পতিবার
ড. তারেক শামসুর রেহমান
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment