বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি যখন এ মুহূর্তে বহুল আলোচিত, ঠিক তখনই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যারা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে কাজ করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বলার চেষ্টা করছেন যে, বিশ্বের উষ্ণতা বাড়লে রোগব্যাধি বৃদ্ধি পাবে।
ডেঙ্গুর প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে এমনটাও আশঙ্কা করেছিলেন গবেষকরা। শুধু ডেঙ্গুর কথা কেন বলি, ২০০১ সালে পি রাইটার নামে একজন গবেষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন Environmental Health Perspectives-এ। তার নিবন্ধের শিরোনাম Climate Change and Mosquito-Borne Disease। ওই নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার, রিফট ভ্যালি ফিভার ও এলিফ্যান্টিয়াসিস (গোদ) নামক রোগ বৃদ্ধি পাবে। এসব রোগ মশাবাহিত।
অর্থাৎ মশার মাধ্যমে এই রোগ বৃদ্ধি পায়। যেসব এলাকা দুর্ভিক্ষপীড়িত কিংবা বন্যাদুর্গত, সেসব এলাকায় এ ধরনের রোগের প্রবণতা বাড়বে বলে পি রাইটার তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন। বন্যার কারণে পানি বৃদ্ধি পায়। ফলে মশার প্রজনন ক্ষমতাও বেড়ে যায়। আরও একটা ভয়ের কারণ হচ্ছে, উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়িয়ে পড়বে। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো (Paul Epstein, Dan Ferber, The Mosquito's Bite, in Changing Planet, Changing Health : How the Climate Crisis Threatens our Health and what we can do about it, 2011)। গবেষকরা এটাও উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে কলেরা মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিবেশ সংক্রান্ত সম্মেলনে যোগ দেন। ওইসব সম্মেলনে উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থ্য খাত, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বাস্থ্য খাত যে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা আসলে বিদেশে ‘বাজার’ করতে যান। সম্মেলনে স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে যেসব সুপারিশ রাখা হয়, তা তারা হয় বোঝেন না, নতুবা তারা এড়িয়ে যান। সম্মেলন শেষে তারা দেশে ফিরে এসে আদৌ কখনও কোনো রিপোর্ট দিয়েছিলেন কিনা, তা আমাদের জানা নেই। এখানেই এসে যায় সুশাসনের অভাবের প্রশ্নটি।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জানা উচিত ছিল এ সময়টা বন্যার মৌসুম। ভারত থেকে ভাটিতে পানি নামবে এবং বন্যায় সয়লাব হয়ে যাবে উত্তরাঞ্চল, যার প্রভাব গিয়ে পড়বে ঢাকাতেও। বন্যার পানির সঙ্গে সঙ্গে মশাবাহিত রোগবালাই বৃদ্ধি পাবে- এটা তাদের জানা উচিত ছিল। সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তারা সতর্ক হননি। অর্থাৎ তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই!
ভাবতে অবাক লাগে, দেশে ৬২ জেলা যখন ডেঙ্গু আক্রান্ত, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মালয়েশিয়ায় ছুটি কাটাচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে মিডিয়ায় লেখালেখি হওয়ার কারণে দেশে ফিরে এসেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, পরিবেশমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী থাকার পরও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডন থেকে নির্দেশনা দিতে হয়। কেন? সব কাজ যদি প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হয়, তাহলে এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের কাজ কী?
বিশাল এক আমলাতন্ত্র রয়েছে আমাদের। একজন মধ্যম সারির আমলার পেছনে রাষ্ট্রের খরচ প্রতি মাসে এক লাখ টাকার উপরে! তাহলে তাদের কাজটি কী? শুধু বিদেশে যাওয়া আর ‘বাজার’ করা! এখানেই এসে যায় ‘মেরিটোক্রেসি’ বা যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের নিয়োগের প্রশ্নটি। অর্থাৎ একুশে শতকে এসে মন্ত্রণালয়গুলোতে যদি যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া না যায়, তাহলে আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে যত বড়াই করি না কেন, অচিরেই আমাদের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে।
বিসিএস পরীক্ষার নামে যে আমলাতন্ত্র আমরা তৈরি করছি, তা ঔপনিবেশিক মানসিকতাসম্পন্ন। মন্ত্রণালয়গুলো পরিচালনার জন্য সিনিয়র লেভেলে দক্ষ জনশক্তি সরাসরি নিয়োগ দিতে হবে। প্রাইভেট সেক্টর এই দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম এখন। মন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাকে সহযোগিতা করার দায়িত্ব আমলাদের। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা দক্ষ আমলা তৈরি করতে পারিনি। আমলারা ব্যস্ত নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে।
ফেরির জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর বালক তিতাসের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমলারা নিজের স্বার্থকে কত বেশি গুরুত্ব দেন। প্রসঙ্গক্রমেই এসে গেল একটি ছোট্ট ঘটনা। ঘটনাটি আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায়। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ইথিওপিয়ায় একদিনে রোপণ করা হয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন বা ৩৫ কোটি গাছ। ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ স্বয়ং এ প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমনকি বৃক্ষরোপণ কাজে অংশ নেয়ার জন্য একদিন সরকারি অফিস বন্ধ রাখাও হয়েছিল। দেশটি আরও ৪ বিলিয়ন (৪০০ কোটি) গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছে।
ভারতের কথা কি আমরা জানি? দেশটি ২০১৬ সালে একদিনে ৫ কোটি গাছ রোপণ করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে তিনটি করে গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা কি পারতাম না এ ধরনের একটি পরিকল্পনা নিতে? বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য গাছ কেটে ফেলা অনেকাংশে দায়ী। উষ্ণতা রোধকল্পে গাছের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা সবাই জানি। খাল-বিল ভরাট করে আমরা হাউজিং প্রকল্প করছি।
কিন্তু কেন আমরা নতুন প্রকল্প এলাকায় বাধ্যতামূলকভাবে বনায়ন করছি না? কেন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করছি না বাধ্যতামূলকভাবে গাছের চারা রোপণ করতে? জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পরিসরে এটা এখন স্বীকৃত। আমাদের উদ্যোগটা তাহলে কোথায়? ইথিওপিয়ার মতো দেশ যদি একদিনে ৩৫ কোটি গাছ লাগায়, তাহলে ১৭ কোটি দেশের মানুষ আমরা, গাছ লাগানোর সময় (বর্ষাকালে) একদিনে ৪০ কোটি গাছ লাগানো কোনো ব্যাপার নয়।
আমাদের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী আছেন দু’জন, একজন কেবিনেট মন্ত্রী, অন্যজন ডেপুটি মন্ত্রী। আমি দুঃখিত, তাদের কোনো কর্মকাণ্ড আমার চোখে ধরা পড়েনি। অথচ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি।
প্লাস্টিকের ভয়াবহতার খবর কি আমরা জানি? বিশ্ব আজ বড় ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্যরে মুখোমুখি। সাগর-মহাসাগর প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরে গেছে। সাত ধরনের প্লাস্টিক উপাদান, যাতে পানীয় তথা খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা হয় (পানির বোতল, দুধের বোতল), তা ব্যবহারে ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে (ইকোওয়াচ, ২৩ মার্চ ২০১৬)। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন? প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভয়াবহতা নিয়ে আদৌ কোনো সচেতনতা আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ব্রিটেন ও ফিলিপাইনে ‘সুপারশপ’গুলো প্লাস্টিক ব্যবহার কমিয়ে আনছে। ফিলিপাইনে কোনো কোনো সুপারশপে প্লাস্টিকের বদলে কলাপাতা ব্যবহার করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বড় শহর সারাবায়াতে বাসযাত্রীরা টিকিট কিনছেন পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে। এগুলো কি আমাদের জন্য কোনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না? কোনো এনজিও কি এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেবে? বাংলাদেশে ইতিমধ্যে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটের প্লাস্টিক ব্যাগ (ডিসপোজেবেল, যা মাটির সঙ্গে মিশে যায়) আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু এর ব্যাপক ব্যবহারের কোনো উদ্যোগ আমরা লক্ষ করছি না।
প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন আইনগত নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও উৎপাদন ও ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। নালা-নর্দমা, সুয়্যারেজ সব ভর্তি হয়ে গেছে প্লাস্টিকের ব্যবহৃত ব্যাগে। এই ব্যাগগুলো পচে-গলে যায় না, বছরের পর বছর থেকে যায়। একটু বৃষ্টি হলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি কী হয়, তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের দুঃখ, আমরা আইন করেও এটি বন্ধ করতে পারলাম না। আমাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই, সেটাও সত্য। এখানেই এসে যায় সুশাসনের প্রশ্নটি।
আজ ডেঙ্গু যে হারে সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে, এখানেও রয়েছে সুশাসনের অভাব। কেন মাত্র দুটি কোম্পানির কাছে মশা মারার ওষুধ আমদানির কাজটি সীমাবদ্ধ থাকবে? যারা নিুমানের ওষুধ আমদানি করেছে, কেন তাদের আমরা আইনের হাতে তুলে দিলাম না? কোনো প্রভাবশালী চক্র কি এর সঙ্গে জড়িত! ঢাকার মেয়র যখন ‘উত্তরের মশা দক্ষিণে যায় আর দক্ষিণের মশা উত্তরে যায়’- এ ধরনের বক্তব্য দেন, তখন তাদের ‘অজ্ঞ’ বলা ছাড়া আমি আর কিছুই বলতে পারি না।
আমার ভাবতে অবাক লাগে, একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া দক্ষিণের মেয়রের ন্যূনতম ‘কমিটমেন্ট’ থাকা উচিত ছিল তার এলাকার ভোটারদের প্রতি। অত্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তিনি সবাইকে উপদেশ দিলেন মশারি টানিয়ে ঘুমাতে, বললেন প্লেনে করে তিনি ওষুধ আনবেন! আধুনিক ঢাকা শহরের মেয়র যখন এভাবে কথা বলেন, তখন তা আমার দুঃখবোধটাই বাড়িয়ে দেয় মাত্র। দুদকের অনুসন্ধান করা উচিত মশা মারার জন্য দুই সিটি কর্পোরেশনের যে ৩২ কোটি টাকা বার্ষিক বাজেট, তা কোন খাতে, কখন, কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে। এটা জনগণের টাকা, জনগণের টাকার ‘নয়ছয়’ হওয়া ঠিক নয়।
বন্যা-পরবর্তী দেশগুলোতে ডেঙ্গুর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাবের কথা বলেছেন গবেষকরা। এটা গবেষণায় প্রমাণিতও। সুতরাং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আমরা যেন হালকাভাবে বিষয়টিকে না দেখি। একটি টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি, যারা মনিটর করবেন এবং এখন থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
শনিবার, ০৩ আগস্ট ২০১৯
তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment