এ বিশাল সমাবেশে তারা তাদের পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। প্রশ্নটা সেখানেই। যেখানে রোহিঙ্গারা জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের উত্থাপিত পাঁচ দফা মানা না হলে তারা রাখাইনে ফেরত যাবে না, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকারান্তরে জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা আর সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন তাদের উদ্বেগের কথা জানালেন, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘও। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলে জাতিসংঘ মনে করে। গত অর্থবছরে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের জন্য একটি অস্থায়ী আবাসন গড়তে নোয়াখালীর ভাসানচরে আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ব্যারাক ও ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, যা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হয়েছে। এখন রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তারা ভাসানচরেও যাবে না। তাহলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি কোন্ দিকে যাচ্ছে? কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কর্তব্যই বা কী?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আরাম’ তত্ত্ব ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার আর খরচ বহন করতে পারবে না, এবং বিদেশ থেকে সাহায্যও কমে আসবে। তাহলে এর সমাধান হবে কীভাবে? রোহিঙ্গাদের দাবি- তাদের পাঁচ দফা মানলেই তারা ফেরত যাবে। এই পাঁচ দফার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নির্যাতনের ক্ষতিপূরণ, মিয়ানমারে তাদের চলাফেরার অধিকার, গণহত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে মিয়ানমারে যারা জড়িত তাদের বিচার ও তাদের নিজ পৈতৃক বাসভূমে থাকার অধিকার। বাংলাদেশ মনে করে এ দাবিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা মিয়ানমারের নিজস্ব বিষয়। মিয়ানমারকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
কিন্তু সমাধানটা হবে কীভাবে? ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা কুতুপালং ক্যাম্পে যে শো-ডাউন করল, তা সংগঠিত করেছে কারা? পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ওই সমাবেশের ব্যাপারে তারা অবগত ছিলেন না। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি আবেদনপত্র ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায় সমাবেশের অনুমতিপত্র তারা গ্রহণ করেছিল। অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইএনজিওরা রোহিঙ্গাদের স্থায়ী হতে স্বপ্ন দেখাচ্ছে (উখিয়া নিউজ, ২৬ আগস্ট)।
বিবিসি বাংলা আমাদের জানাচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রাতের আঁধারে নিয়ন্ত্রণ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো (২৭ আগস্ট)। এখানে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। একটি বড় ধরনের উদ্বেগের খবর আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। আর তা হচ্ছে, একাধিক সন্ত্রাসী দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসী আল ইয়াকিন গ্রুপের নামও সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিরা ইতিমধ্যে সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে বাঙালিদের মৃত্যুর খবরও একাধিকবার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এই যে পরিস্থিতি, তা কোনো আশার কথা বলে না। বিশাল একটি বিদেশি জনগোষ্ঠী অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করলে তা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে ভূমিকা পালন করার কথা, তা তারা করছে না। তাই সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? মাত্র ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমার গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য এ সংখ্যা কিছুই নয়। কিন্তু তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি মিয়ানমার।
এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আশ্বাস না পেলে রোহিঙ্গারা যে যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাসদস্যদের, যারা নির্যাতন ও হত্যার জন্য দায়ী, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা ছাড়াও কোনো গত্যন্তর নেই। কিন্তু সে ব্যাপারেও তেমন অগ্রগতি নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেখানকার ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিষিদ্ধ করেছে।
কিন্তু মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, মিয়ানমার কিছু রোহিঙ্গাকে নিতে চায়; কিন্তু তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখতে চাইছে। উপরন্তু রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাদের নিয়ে রাখা হবে নির্ধারিত ক্যাম্পে। ক্যাম্পেই কাটাতে হবে তাদের বাকি জীবন। এ ধরনের বেশকিছু ক্যাম্প চীন ও ভারতের অর্থায়নে তৈরি হয়েছে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি ব্যাপক মাত্রায় বিশ্বে প্রচার পেলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি। এর বড় প্রমাণ- দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন আগামী ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- মিয়ানমারে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ বাড়ানো। গত মাসেই দক্ষিণ কোরিয়া সেখানে ৩ দশমিক ৯৬৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে (The Irrawaddy, ২৬ আগস্ট)। চীনের কথাও উল্লেখ করা যায়। চীন অনেকটা দু’মুখো নীতি গ্রহণ করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চীন দ্বিপাক্ষিক আলোচনার (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) ওপর গুরুত্ব দিলেও মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চেন হাই গত ২২ আগস্ট সেনাপ্রধান মিন আউয়ং হ্লাইয়ংয়ের সঙ্গে দেখা করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন (The Irrawaddy, ২২ আগস্ট)। চীন রাখাইন স্টেটের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে। এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই।
অথচ তার জ্বালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন) সরবরাহ করেছে।
২০১৮-এর পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাবাহুল্য, ইউনান প্রদেশের ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর শতকরা ৫৭ ভাগ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে; তেল, গ্যাস ও খনিজ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ ভাগ। চীন রাখাইন প্রদেশের kyaukpyu-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একইসঙ্গে Muse-Mandalay রেলওয়ে লাইনও তৈরি করছে। এতে করে kyaukpyu থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী Muse পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এ পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে।
সেখানে তাদের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চীন সফরে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা বাংলাদেশের অবস্থানকেও সমর্থন করেছেন। এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক, কিংবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক খারাপ হোক, এটা চীন চায় না।
তাহলে সমাধানটা কোন্ পথে? মিয়ানমার টালবাহানা করছে, এটা স্পষ্ট। মাত্র ৩ হাজার ৪৫০ জনকে নিতে চেয়েছিল মিয়ানমার! তাও সম্ভব হল না। একটি আন্তর্জাতিক চক্র চাচ্ছে রোহিঙ্গারা বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলেই থেকে যাক! এটা আমাদের জন্য চিন্তার কারণ। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে বিশাল এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি।
আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা এখানেই যে, আমাদের এ নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা সঠিকভাবে বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করতে পারিনি। সংকট শুরু হওয়ার দু’বছর পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ‘আরাম তত্ত্বের’ কথা বলছেন, তাতে করে কি এ সমস্যার সমাধান হবে? দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হল না। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় ফাঁদে পড়েছি।
‘জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না’- এই যুক্তি তুলে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য রোহিঙ্গাদের এখানে রেখে দিতে চায়। দেশবিরোধী এসব এনজিও ও আইএনজিওর ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এদের কর্মকাণ্ড সীমিত করতে হবে। সাহায্যের নামে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ‘আরাম তত্ত্ব’ কোনো ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা নয়। কূটনৈতিকভাবে আমাদের কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। না হলে আমাদের জন্য আগামীতে খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে।
Daily Jugantor
31.08.2019
0 comments:
Post a Comment