গত ৫ আগস্ট ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদটি বাতিল হয়েছে। সেই সঙ্গে বাতিল হয়েছে ৩৫-এ ধারাটিও। ভারতের কোনো কোনো গণমাধ্যম ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘মিশন কাশ্মীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে (ঘবংি ১৮, বাংলা)। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতি নতুন একটি মাত্রা পেল। সংবিধানের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদটি বাতিল হওয়ায় এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ভারত। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনুচ্ছেদটি বাতিল হওয়ায় তা এখন ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে? প্রথমত, অনুচ্ছেদটি বাতিল হওয়ায় কাশ্মীর এখন ভারতের মূলধারার সঙ্গে একত্র হলো। অর্থাৎ জন্মু ও কাশ্মীরের যে দ্বৈতসত্তা ছিল (আলাদা পতাকা, স্থায়ী নাগরিকত্বের বিষয়), তা আর থাকল না। একই আইন এখন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও কাজ করবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এক রাজ্য ভেঙে অন্য রাজ্য সৃষ্টি করা, এক অংশ অন্য রাজ্যে সংযুক্ত হওয়া এই প্রথম নয়। এর আগেও হয়েছে। কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ১৯৫৩ সালে মাদ্রাজ থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধ্র প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালে পণ্ডিচেরি, মাহে, ইয়ানমা, করাইকল ও চান্দেরনগর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যগুলোর পুনর্বিন্যাস হয়। ১৯৬০ সালে বোম্বে ভেঙে গঠন করা হয় মহারাষ্ট্র ও গুজরাট। ১৯৬১ সালে গোয়া, দমন-দিউ, দাদরা-হাভেলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ড রাজ্যের স্বীকৃতি পায়। ১৯৬৬ সালে পাঞ্জাবে পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা আলাদা রাজ্যে পরিণত হয়। এক অংশ হিমাচলে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৭২ সালে মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল আসাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০০ সালে উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জন্ম হয়। ২০১৪ সালে অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্যের জন্ম হয়। ১৯৫১ সাল থেকেই ভারতে এই প্রক্রিয়া চলছে। সুতরাং আজ জম্মু ও কাশ্মীর ভেঙে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (কাশ্মীর ও লাদাখ) গঠন করার সিদ্ধান্ত নতুন নয়। এ ধরনের পুনর্বিন্যাস আগেও হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের অনেক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিধানসভা রয়েছে, কোথাও বা আবার বিধানসভা নেই। যেমন—পাদুচেরি কিংবা দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। কিন্তু এখানে বিধানসভা আছে। একজন মুখ্যমন্ত্রী আছেন। আবার চণ্ডীগড়, দমন-দিউ, লক্ষাদ্বীপ, আন্দামান-নিকোবর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলেও এখানে কোনো বিধানসভা নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কাশ্মীরে বিধানসভা থাকবে। কিন্তু লাদাখে কোনো বিধানসভা থাকবে না। একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর দ্বারা এই অঞ্চল শাসিত হবে। তৃতীয়ত, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫-এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর ‘আলাদা মর্যাদা’ পেত। এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ (স্থানীয়দের চাকরি-শিক্ষা থেকে সুবিধা, স্থায়ী নাগরিকের মর্যাদা ইত্যাদি) শুধু জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য ছিল তেমনটি নয়, অন্য বেশ কিছু রাজ্য এখনো সাংবিধানিকভাবে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ ভোগ করে থাকে। ৩৭১-এ ও ৩৭১-জি ধারাবলে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠী অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো একই ধরনের সুবিধা পায়। পার্বত্য এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জমির ওপর, বন ও খনিজ সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার স্বীকৃত। তাদের কোনো কর দিতে হয় না। চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে অগ্রাধিকার। এ অঞ্চলে সংবিধানের অনেক ধারা কার্যকর নয়। সেখানে দেশীয় আইন, ঐতিহ্য অনুযায়ী অনেক কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সম্পত্তি ও জমির হস্তান্তরও নিজস্ব নিয়মে চলে। সংবিধানের ৩৬৮ ধারার ভিত্তিতে ৩৭১ নম্বর ধারায় ৯টি রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বাইরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও অন্ধ্র প্রদেশ রয়েছে সেই তালিকায়। ৩৭১-বি ধারায় কিংবা ২৪৪-এ ধারায় আসাম বেশ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। ৩৭১-ডি ও ই ধারায় অন্ধ্র প্রদেশে শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণসহ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতে। ৩৭১-এইচ ধারা মতে অরুণাচল রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারেন কেন্দ্র থেকে নিযুক্ত রাজ্যপাল। সুতরাং যেসব অঞ্চল বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেগুলোর মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।
এরই মধ্যে নাগাল্যান্ড, মিজোরামে বিক্ষোভ হয়েছে এবং স্থানীয় নেতারা কঠোর হুমকি দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, জন্মু ও কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় অনেক রাজ্যেই এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দার্জিলিংয়েও পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি প্রকাশ্যে এসেছে। দার্জিলিংয়ে পৃথক রাজ্য গড়ার নেতা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিমল গুরুং আত্মগোপনস্থল থেকে এক বার্তায় দার্জিলিংয়েও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এটা একটা অশনিসংকেত। অন্যান্য রাজ্য থেকেও এ ধরনের দাবি উঠতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কি শুধু ‘মিশন কাশ্মীর’ নিয়েই ক্ষান্ত থাকবে? নাকি অন্য অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে সংবিধানে যে সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা খর্ব করারও উদ্যোগ নেবে? কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে জনঅসন্তোষ গড়ে উঠছে, তা যদি কেন্দ্র বিচেনায় নেয়, তাহলে সংবিধানে অন্যান্য ও পশ্চাৎপদ রাজ্যগুলোর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সংবিধানের রক্ষাকবচগুলো বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। তবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে ওই সিদ্ধান্ত মুসলমানবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, বরং ধর্মীয়ভাবে তারা খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী।
চতুর্থত, সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-এ বাতিল করে মোদি সরকার একটি বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছে। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এখন জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেবে। অর্থাৎ অন্য অঞ্চলের মানুষ এখন কাশ্মীরে গিয়ে বসবাস করবে, স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে সেখানে সংসার পাতবে। এতে স্থানীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হবে, জন্ম হবে এক সংকর জাতির। মুসলমানদের একক কর্তৃত্ব ও ধর্মীয় প্রভাব এতে নষ্ট হবে। এ জন্যই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি সতর্ক করেছিলেন যে এই আইনের (৩৭০ ধারা) বিলোপ কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। পঞ্চমত, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হবে। লাদাখ এলাকাটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কৌশলগতভাবে এই এলাকার গুরুত্ব অনেক বেশি। চীন মনে করে, ভারত এই আইন একতরফাভাবে সংশোধন করায় আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে, যা চীনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কড়া মন্তব্য করেছে পাকিস্তান। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ভারতের বেআইনি সিদ্ধান্তে আঞ্চলিক শান্তি নষ্ট হবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘ভারতে ফের পুলওয়ামা হবে।’ অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার লেথপোরাতে পাকিস্তান সমর্থিত জইশ-ই-মোহাম্মদ জঙ্গিগোষ্ঠীর জনৈক সদস্যের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের রিজার্ভ ফোর্সের ৪০ সদস্য মারা গিয়েছিলেন। ইমরান খান এদিকেই দৃষ্টি দিলেন। ব্যাপক আত্মঘাতী ও জঙ্গি তৎপরতা বাড়বে বলে তাঁর আশঙ্কা। আর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কাশ্মীরের জনগণের ‘স্বাধীনতা’ আন্দোলনের শুধু সমর্থনই না, যা যা করার দরকার, তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী করবে। এটাও এক ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য ও পরোক্ষাভাবে জঙ্গিবাদকে সেখানে উৎসাহ জুগিয়ে থাকবে।
সরকারিভাবে পাকিস্তান ভারত কর্তৃক ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। ষষ্ঠত, ৩৭০ নম্বর ধারাটি বাতিল করায় আবদুল্লাহ পরিবার (ফারুক আবদুল্লাহ, ওমর আবদুল্লাহসহ) ও মুফতি পরিবারের (মুফতি মোহাম্মদ সাঈদ, মেহবুবা সাঈদ) কর্তৃত্ব তখন কমবে। এরা শুধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে। কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনীতিতে এই দুই-পরিবার সক্রিয় থাকলেও স্থানীয় রাজনীতিতে এদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। সপ্তম, কাশ্মীরি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে গত তিন দশকে ৯৫ হাজার ২৩৮ জন কাশ্মীরিকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। এই পরিসংখ্যান ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি থেকে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনেও ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতনের আর অত্যাচারের খবর রয়েছে। বহির্বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তির জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। ভারত বড় শক্তি। অর্থনীতির দিক দিয়ে ভারত এরই মধ্যে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গেছে। ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে চায়। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত-পরবর্তী সেখানকার পরিস্থিতি ভারতের বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দেবে।
সুতরাং ‘মিশন কাশ্মীর’ বিজেপি সরকারের জন্য ‘কাল’ হয়ে দেখা দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে কাশ্মীরে অবিলম্বে বিধানসভার নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর স্ট্র্যাটেজিতে আছে আবদুল্লাহ ও মুফতি পরিবারের বাইরে তৃতীয় একটি শক্তিকে সেখানে ক্ষমতায় আনা। এতে তিনি কতটুকু সফল হবেন বলা মুশকিল। সেখানে বিজেপি আছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিজেপি মেহবুবা মুফতির (পিডিপি) অ্যালায়েন্স পার্টনার ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ওই অ্যালায়েন্স আর কাজ করবে না। মোদি-অমিত শাহ জুটি ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দিতে চাচ্ছেন। ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো এত দিন একটি ‘মডেল’ ছিল। এখন ভারতীয়করণের’ নামে সংখ্যালঘু তথা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ মোদি সরকারের ভূমিকাকে বড় ধরনের প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল।
২০ আগস্ট, ২০১৯
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র
তারেক শামসুর রেহমান
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment