পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কাশ্মীর এখন কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চল। কেন্দ্র কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একজন গভর্নর এ অঞ্চলটি শাসন করছেন। এতদিন এ অঞ্চলটি (লাদাখসহ) রাজ্যের মর্যাদা পেয়ে আসছিল। এখন তা আর বহাল নেই। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় জানিয়েছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা থাকবে এবং ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ হলে সেখানে নির্বাচন হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এ অঞ্চলটি শাসন করবেন! এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। এক. কাশ্মীরের প্রভাবশালী দুই পরিবার (আবদুল্লাহ ও মুফতি) ও তাদের নেতৃত্বাধীন দল (ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিপি) কি আদৌ সেই নির্বাচনে অংশ নেবে? আর যদি অংশ না নেয়, তাহলে কি সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে?
দুই. সেখানে বেশকিছু জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে হিজবুল মুজাহিদিন, ইসলামিক স্টেট জম্মু কাশ্মীর, ইসলামিক স্টেট খোরাসান, জইশ-ই-মোহাম্মদ ইত্যাদি। ১৯৮৯ সালের ১৩ জুলাই ভারতীয় বাহিনী সেখানে বড় ধরনের ‘অপারেশন’ পরিচালনা করে। এর প্রতিক্রিয়াতেই এসব জঙ্গিবাদী সংগঠনের জন্ম হয়, যারা জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারত থেকে আলাদা করতে চায়। এসব জঙ্গি সংগঠন পাকিস্তান থেকে আর্থিক ও অস্ত্র সাহায্য পেয়ে থাকে। ভারতের অভিযোগ, এসব জঙ্গি সংগঠন ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, জঙ্গি সংগঠনগুলো আদৌ নির্বাচন আয়োজন করতে দেবে কিনা? কিংবা নির্বাচনে তারা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেবে কিনা? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হয়।
চার. আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো বাহিনীর হামলা ও দেশটি দখল করে নেয়ায় সেখানে ধর্মভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল। জন্ম হয়েছিল তালেবানের পাশাপাশি হাক্কানি নেটওয়ার্ক, আল কায়দা, ইসলামিক স্টেট কিংবা নর্দান অ্যালায়েন্সের মতো জঙ্গিবাদী সংগঠনের। জম্মু ও কাশ্মীরে এ ধরনের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- হরকাতুল জিহাদ, লস্কর-ই-তাইয়েবা, জইশ-ই-মোহাম্মদ, হিজবুল মুজাহিদিন, আল বদর জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট, আইএসআইএল-কেপি ইত্যাদি। কাশ্মীরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে জঙ্গিবাদী এ তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। তরুণরা ব্যাপক হারে এখন এ জঙ্গি সংগঠনগুলোতে যোগ দিতে পারে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের পর। তেমন একটি পরিস্থিতি এখন কাশ্মীরে সৃষ্টি হতে পারে।
পাঁচ. আফগান আগ্রাসনে বিদেশি শক্তি জড়িয়ে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কাশ্মীর প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও চীনের জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে এ অঞ্চলে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (যা গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করছে) চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। এ অর্থনৈতিক করিডোরটি পাকিস্তান অধিকৃত ‘আজাদ কাশ্মীরের’ উপর দিয়ে গেছে। এই ‘আজাদ কাশ্মীরের’ মালিকানা ভারত দাবি করছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি আবারও আজাদ কাশ্মীরের দাবি উপস্থাপন করেছেন। পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চীন। এবং কাশ্মীর সংকটে চীনের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এ মুহূর্তে ‘নিরপেক্ষ’। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মোদি ও ইমরান খানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। কিন্তু কাশ্মীরে জঙ্গিবাদী তৎপরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘জাতীয় স্বার্থের’ কারণে ভারতের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দুটি- চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমানো এবং মার্কিন সেনা প্রত্যাহার-পরবর্তী আফগানিস্তানে ভারতের একটি বড় ভূমিকা পালন। কাশ্মীর সংকটে ইসরাইলের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবাট ফিস্ক লিখেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা সৃষ্টিতে ইসরাইলের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে (The Independent, 28 February)। এমনকি পুলাওয়ামায় জঙ্গি হামলার পর (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯), ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যে বিমান হামলা চালিয়েছিল, তার পেছনে ইন্ধন ছিল ইসরাইলের। ইসরাইলি সংবাদপত্র HAARETZ জানাচ্ছে, ইসরাইল এ সময় তাদের বৈমানিকদেরও পাঠিয়েছিল ভারতকে সাহায্য করতে (১৪ মার্চ, ২০১৯)। আর ভারত-ইসরাইল সামরিক সম্পর্কের কথা তো সবাই জানে। কাশ্মীর সংকট ও ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। ফলে একটি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অ্যালায়েন্সের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখানে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অভিন্ন- ইসলামী জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করা ও চীনের প্রভাব কমানো।
কাজেই কাশ্মীর সংকট ঘিরে অনেক প্রশ্ন আছে ও থাকবে। পাকিস্তান এ সংকটকে পুঁজি করে বহির্বিশ্বে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়। পাকিস্তান পঞ্চমবারের মতো ভারতের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে জড়াবে না, এটা যেমন দিব্যি দিয়ে বলা যায়, ঠিক তেমনি এটাও বলা যায় যে, ‘কাশ্মীর সংকট’কে ‘হজম’ করতে ভারতকে বেশ বেগ পেতে হবে। স্পষ্টতই বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার সাধারণ কাশ্মীরিদের মন জয় করতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদির ব্যর্থতা এখানেই।
Daily Jugantor
24.8.2019
0 comments:
Post a Comment