রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ডেঙ্গু নিয়ে আগাম সতর্কতা ও বাস্তবতা




                  Image result for dengue
ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশে আতঙ্কের নাম। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা থেকে ডেঙ্গু এখন ছড়িয়ে পড়ছে জেলাগুলোতে। মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা সংবাদ ও নানা ছবি এই ডেঙ্গু নিয়ে। কী দুর্ভাগ্য এই জাতির। বাবা মৃত পুত্রসন্তানকে দাফন করে হাসপাতালে এসেছেন কন্যাসন্তানের পাশে, যে এখন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত। এক অজানা আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছে। ছোট শিশু রাইয়ান, পড়ত মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ডেঙ্গু তাকে পৃথক করেছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য। তার স্কুল শিক্ষক জহিরুল ইসলাম আমাকে জানিয়েছেন তার স্কুলে রাইয়ানের মতো ডেঙ্গু আক্রান্তদের সংখ্যা অনেক। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ডেঙ্গুর কারণে মোট মৃত্যুর সংখ্যা কত। তিনি মিডিয়াকে বললেন, তিনি জেনে জানাবেন। তিনি আর জানাননি। ডেঙ্গুতে দেশ যখন আক্রান্ত, তখন তিনি ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। তারপর মিডিয়ায় লেখালেখি হলে তিনি দ্রুত দেশে আসেন। ভাবতে অবাক লাগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তথা সচিবের দায়বদ্ধতা কোথায় আজ।
আরেক মন্ত্রীকে বলতে শুনলাম ‘বংশবিস্তার রোধে পুরুষ এডিস মশাকে বন্ধ্যা করা হবে’। আরেকজন মন্ত্রী গেলেন কলকাতায় মেয়রের কাছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য। আরও খবর এলো এডিস পুরুষ মশা আমদানি হবে, প্লেনে করে ওষুধ আমদানি হবে, দুটি কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়েছিল মশা মারার ওষুধ আমদানির বিষয়টি।
অকার্যকর ওষুধ আমদানি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ ডেঙ্গুর মতো রোগের যে প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে নাকি আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। কথাটা কতটুকু সত্য আমরা জানি না। আমরা স্বাস্থ্য তথা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এটা জানার কথা যে, এ অঞ্চল, অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়া ‘মারাত্মক’ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে আছে। তাহলে তারা সতর্ক হলেন না কেন?
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের রোগব্যাধি বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার, রিফট ভ্যালি ফিভার, গোদ রোগ বৃদ্ধি পাবে বলে গবেষকরা অনেক আগেই ধারণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণা সত্য বলেই প্রমাণিত হলো। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি এখন আর ধারণা নয়, বরং এটা বাস্তব সত্য। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে শত শত গবেষণা হয়েছে। প্রতিটি গবেষণায় বলা হচ্ছে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া।
আমি গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আসা যাওয়া করি। এখনো আমি যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু এবারে এই নিউইয়র্ক শহরে যত গরম পড়েছে, অতীতে কখনো এরকম গরম পড়েনি। গত শীতে নিউইয়র্কে যত ঠাণ্ডা পড়েছে, অতীতে কখনো এত ঠাণ্ডা পড়েনি। কেউ কেউ এখানে এমন আশঙ্কাও করেছেন যে এক সময় নিউ ইয়র্ক বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে যেতে পারে। এগুলো সবই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফল। কোথাও কোথাও উষ্ণতা বাড়ছে। কোথাও বাড়ছে শীত। আর উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে মশাবাহিত নানা রোগ। এই নিউ ইয়র্ক শহরেও এখন মশার প্রকোপ। বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। আর গবেষণা সত্য বলেই প্রমাণিত হচ্ছে।
গবেষণায় বলা হয়েছিল রোগ-বালাই বাড়বে। বাড়ছেও তাই। বাংলাদেশের ডেঙ্গুর প্রকোপ এর প্রমাণ। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন? ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনেও ডেঙ্গুর প্রবণতা বেড়েছে। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কিংবা থাইল্যান্ডে ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও, বাংলাদেশে এবার এর ব্যাপকতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অতীতেও এরকমটি হয়নি কখনো। এটা নিয়ে এখন নানা কথাবার্তা হচ্ছে। সরকার কিংবা দুটি সিটি করপোরেশনের দুর্বলতা ছিল, সন্দেহ নেই তাতে। দুর্নীতিও আছে। এখন কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এটা নিয়ে সবাই চিন্তাভাবনা করছে। টনক নড়েছে সবার। কিন্তু মূল কথা একটাইÑ আর তা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা যদি রোধ করা না যায়, তাহলে এর ফলে যে ক্ষতি হবে, তার মাঝে একটি হচ্ছে রোগবালাই বিস্তার। বিভিন্ন ধরনের মশাবাহিত রোগ বিস্তার লাভ করবে এবং তা এক সময় মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যারা মিডিয়ার ওপর নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন শেষ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে এবং এই উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটতে পারে, এমন আভাস দেওয়া হয়েছিল। জুন মাসের ১০ তারিখ (২০১৯) নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল How Dengue, a Deadly, Mosquito-Borne Disease, Could Spread in a Warming World| GKwU g¨vMvwRb Nature Microbiology উদ্ধৃতি দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বলেছিল ডেঙ্গুর পাশাপাশি জিকা ও চিকনগুনিয়া রোগের (যা মশাবাহিত) প্রাদুর্ভাব ঘটবে এবং তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যাবে।
২০৮০ সাল নগাদ ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন, অর্থাৎ বিশ্বের ২২০ কোটি মানুষ মশাবাহিত এসব রোগে আক্রান্ত হবে। যদিও নিউ ইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। এটা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য তথা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল। তারা কিছুই করেননি। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করার জন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রী আছেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে। একজন পূর্ণমন্ত্রী, অপরজন উপমন্ত্রী। এ বিষয়ে কোনো কার্যক্রম দেখি না।
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে যারা বিশ্বমানের ওষুধ আমদানি করেছে, কেন তাদের আমরা আইনের হাতে তুলে দিলাম না? কোন কোন প্রভাবশালী চক্র এর সঙ্গে জড়িত। ঢাকার দুই মেয়র যখন ‘উত্তরের মশা দক্ষিণে যায়, আর দক্ষিণের মশা উত্তরে যায়’  এ ধরনের বক্তব্য দেন, তখন তাদের বক্তব্যকে অর্থহীন বলা ছাড়া আমি আর কিছ্ইু বলতে পারি না। আমার ভাবতে অবাক লাগে দক্ষিণের মেয়র একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিয়ে, তার ন্যূনতম ‘কমিটমেন্ট’ থাকা উচিত ছিল তার এলাকার ভোটারদের প্রতি। অত্যন্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তিনি সবাইকে উপদেশ দিলেন মশারি টানিয়ে ঘুমাতে। বললেন প্লেনে করে তিনি ওষুধ আনবেন। আধুনিক ঢাকা শহরের মেয়র যদি এভাবে কথা বলেন, তখন আমার দুঃখবোধটাই বাড়িয়ে দেয় মাত্র। দুদকের অনুসন্ধান করা উচিত মশা মারার জন্য দুই সিটি করপোরেশনের যে প্রায় ৫০ কোটি টাকা বাৎসরিক বাজেট, তা কোন খাতে, কখন, কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে। এটা জনগণের টাকা। জনগণের টাকায় ‘নয়-ছয়’ হওয়া ঠিক নয়।
বন্যা পরবর্তী দেশগুলোতে ডেঙ্গুর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাবের কথা বলেছেন গবেষকরা। এটা গবেষণায় প্রমাণিতও। সুতরাং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। আমরা যেন হালকাভাবে বিষয়টিকে না দেখি। একটি টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি, যারা মনিটরিং করবেন এবং এখন থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
আমরা বারবার বলছি সুশাসন দরকার। দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। দুর্নীতি আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে। ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম বলেছেন ‘দুর্নীতির মহাপ্লাবন’ চলছে। তিনি বলেছেন, ‘আইন দিয়ে কখনোই দুর্নীতি রদ করা যায় না। জেল দিয়েও দুর্নীতি রদ করা যায় না। দুর্নীতি হচ্ছে  মানুষের ও সমাজের মূল্যবোধের বিষয়’। ৩ আগস্ট ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। মিথ্যা বলেননি ব্যারিস্টার আমীর।
যে দেশে একজন ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বনিকের কাছে অবৈধ উপায়ে অর্জিত ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়, কিংবা জেলার সোহেল রানার ব্যাংকে ১৫ কোটি টাকা পাওয়া যায়, সেখানে ‘দুর্নীতির মহাপ্লাবন’ এর বক্তব্যটি সত্য বলেই মনে হয়। দুই ডিআইজির কাহিনী তো সবার মুখে মুখে। তাই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৫০ কোটি টাকার ওষুধ কেনা নিয়ে ‘নয়-ছয়’ হবে এটাই স্বাভাবিক।
শিশু রাইয়ানের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দুর্নীতি, অদক্ষতা আর দায়বদ্ধতার অভাবের কাছে আমরা কীভাবে জিম্মি হয়ে গেছি। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আমাদের বিবেককে যদি এতটুকু নাড়া দিয়ে যায়, আমাদের সেটাই প্রাপ্তি। শুধুমাত্র ক্যামেরা ওপেন করে নায়িকাদের নিয়ে ‘ঝাড়ু দেওয়ার’ দৃশ্য  ধারণ করে, তা প্রচার করে ডেঙ্গুর মহামারী আমরা রোধ করতে পারব না।

দেশ রূপান্তর
সোমবার, ১৯ আগস্ট ২০১৯
তারেক শামসুর রেহমান
লেখক
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahman09@gmail.com

0 comments:

Post a Comment