রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অনিশ্চয়তার আবর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন



advertisement
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, স্বাধীনভাবে চলাচলের নিরাপত্তা, ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরত ও নিরাপত্তা নজরদারির শর্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এই শর্তগুলো পূরণ না করায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওই শর্তগুলোর ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা না দেওয়ায় রোহিঙ্গারা আর মিয়ানমারে ফেরত যাননি। এ ব্যাপারে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতার। গত ২৮ জুলাই কক্সবাজারে এসেছিলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ে। তখন অবশ্য তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে! কিন্তু ২২ আগস্ট পর্যন্ত নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া যারা দাদা, মা ও সন্তানÑ এ তিনের অবস্থানের প্রমাণ দিতে পারবে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। একইভাবে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) অনুযায়ী যারা কাগজপত্র দেখাতে পারবে, তাদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলেও মিন্ট থোয়ে জানিয়েছিলেন। (সাউথ এশিয়া মনিটর, ২৯ জুলাই)। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের নেতা মহিবুল্লাহ তখন সংবাদকর্মীদের জানিয়েছিলেন, মিয়ানমারের দলটি পুরনো প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দেওয়া হলে একজনও মিয়ানমারে ফিরবেন না। ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর নে সান লউইন জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা চান পূর্ণ নাগরিকত্ব, জাতিগত অধিকার ও আন্তর্জাতিক সুরক্ষা। এটা নিশ্চিত না হলে একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না। তখন অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন মন্তব্য করেছিলেন যে, রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব ইস্যুটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তার মতে, আমাদের লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তন। তাদের নাগরিকত্বে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর আগে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শারম্যানের একটি বক্তব্য (রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা) বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে হয়েছিল (৮ জুলাই)। চীন সফর শেষ করে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন। তিনি বলেছিলেন, রাখাইনকে বাংলাদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার যে প্রস্তাব একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান করেছেন, তা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায়। তিনি আরও বলেছিলেন, আমরা এই অঞ্চলে শান্তিতে বিশ্বাসী। কারও ভূখ- আমাদের লাগবে না। বলা ভালো, মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির এশিয়া সম্পর্কিত উপকমিটিতে কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শারম্যান একটি প্রস্তাব করেন গত ১৩ জুন। তাতে তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী না হয়, রাখাইন স্টেটের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে না চায় অথবা অপারগ হয়, তা হলে ওই স্টেটের (অর্থাৎ রাখাইন স্টেটের) রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত এবং ওই এলাকাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে (অর্থাৎ বাংলাদেশের অংশ করতে) যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া উচিত, যা ওই এলাকার মানুষও চাচ্ছে। বক্তব্যটি ছিল স্পষ্ট। যেহেতু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সুরক্ষা দিতে পারছে না। তাই ওই এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হোক! শারম্যান এভাবেই কথাটা বলতে চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কংগ্রেসম্যান শারম্যানের ওই ‘প্রস্তাব’ শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি; তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। সেখানে যখন এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার লোকজন আমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছে, মানবিক কারণে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আশ্রয় দেওয়ার অর্থ এটা নয়, আমরা তাদের রাষ্ট্রের একটা অংশ নিয়ে চলে আসব। এই মানসিকতা আমাদের নেই। এটা আমরা চাই না। প্রত্যেক দেশ তাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে থাকবে, এটাই আমি চাই।’ প্রধানমন্ত্রী সঠিকই মন্তব্য করেছেন। মিয়ানমার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান তাদেরই করতে হবে। বাংলাদেশ তাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
উপরন্তু জাতিসংঘের সনদে এ ধরনের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ সনদের ২নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে (২.৩) যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব রাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সব ধরনের বিরোধের মীমাংসা করবে। তারা এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না, যা বিশ্ব শান্তিকে বিঘিœত করে। জাতিসংঘ সনদের ২.৪ ধারায় বলা আছে, কোনো রাষ্ট্র অপর একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিঘিœত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে অংশ নেবে না। তাই জাতিসংঘ সনদের ২.৩ ও ২.৪ ধারা লঙ্ঘিত হয় এমন কোনো কর্মকা-ে (অর্থাৎ পরোক্ষভাবে যুদ্ধ কিংবা অন্যের এলাকা দখল করা) বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে না। কংগ্রেসম্যান শারম্যানের বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী ও অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়ে আসছে। এটাই বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাসি। রাখাইন প্রদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এখনো উত্তোলন করা হয়নি। মিয়ানমার ২০১২ সালে একটি আইন পাস করেছে (Virgin Lands Management Act_ VFP )। এই আইন অনুযায়ী পরিত্যক্ত কিংবা যে জমি ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ‘তার প্রয়োজনে ও উন্নয়নের স্বার্থে’ যে কোনো ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। মিয়ানমার সরকার তাই করেছেও। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনের প্রায় ৩৬২ গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেখানকার বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব গ্রামের বসতবাড়ির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। এসব এলাকায় কোথাও কোথাও সেনাছাউনি করা হয়েছে। কোথাও বা আবার ওই জমি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। খনি খনন করে তারা সেখান থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করছে। একই সঙ্গে অন্যান্য মিনারেলের অনুসন্ধান চলছে। তুলনামূলক বিচারে চীন ও ভারতের আগ্রহ এখানে বেশি। রাখাইন থেকে বঙ্গোপসাগরের গভীরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ পাওয়া গেছে। চীনের আগ্রহটা সে কারণেই। চীন রাখাইনের পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আহরণ করছে এবং সেই গ্যাস তারা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। ইউনান প্রদেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। অথচ তার জ্বালানি দরকার। তাই পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও তেল মিয়ানমারের একাধিক রাজ্যের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইউনান রাজ্যে। ২০১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় মিয়ানমার ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন (৯.৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার) ও থাইল্যান্ডে (৩ বিলিয়ন) সরবরাহ করেছে। ২০১৮-এর পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে সরবরাহের পরিমাণ অনেক বেশি। বলাই বাহুল্য ইউনান প্রদেশের ‘জ্বালাািন ক্ষুধা’ মেটাচ্ছে মিয়ানমারের গ্যাস। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-২০১৮ সময়সীমায় চীন ২০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। এর মানে ৫৭ ভাগ বিনিয়োগ হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে, তেল, গ্যাস ও খনি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১৮ ভাগ। চীন রাখাইন প্রদেশের কুধঁশঢ়যুঁ-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ৫২০ হেক্টর জমিতে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে সেখানে, যাতে স্থানীয় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। চীন একই সঙ্গে Muse- Mandalay   রেলওয়ে লাইনও  তৈরি করছে। এতে করে  Kyaukphyu থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী পর্যন্ত রেললাইন ও পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, চীন রাখাইন প্রদেশের গভীর সমুদ্রে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস ও তেল উত্তোলন করছে, তা এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। তাই সেখানে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। সেখানে তাদের জাতীয় স্বার্থ রয়েছে। সেই জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে চীন এমন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তার বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। বাংলাদেশ জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাক কিংবা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হোক, এটা চীন চায় না। চীন ভালো করে জানে এ সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তা হলে বিসিআইএম করিডর মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থাৎ কুনমিং (ইউনানের রাজধানী) থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত যে সড়ক তথা রেলপথ (মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে) তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদৌ বাস্তবায়িত হবে না। অথচ চীনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে বিসিআইএম করিডরের পরিকল্পনাটি। চীন তাই এক ধরনের সমঝোতা চায়, যাতে তার স্বার্থ রক্ষিত হয়। এদিকে গত মার্চ মাসেও মিয়ানমার সরকার রাখাইন স্টেটে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ৩০টি চুক্তি করেছে। এতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ দশমিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার (সিনহুয়া নিউজ, ১ মার্চ ২০১৯)। এর অর্থ পরিষ্কার, মিয়ানমার মুখে মুখে প্রত্যাবাসনের কথা বললেও কার্যত রোহিঙ্গারা যেখানে থাকতেন, সেই রাখাইন স্টেটে দ্রুত বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। সেখানে এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে নিয়ে তারা তাদের নিজ পৈতৃক বাসভবনে আর পুনর্বাসিত করবে না, বরং তাদের নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাম্পে। তাদের কাটাতে হবে ক্যাম্পজীবন। রোহিঙ্গাদের আপত্তিটা সেখানেই। রোহিঙ্গারা যে ৪টি দাবি উত্থাপন করেছেন, তার একটির ব্যাপারেও মিয়ামনার ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হলো, তার সমাধান কীভাবে হবে তা বলা মুশকিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এখন অবধি রোহিঙ্গাদের জন্য নাগরিকত্ব, নিজ বাসভূমে থাকার অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। স্পষ্টতই রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে সংকট, তার কোনো সমাধান হলো না।
Daily Amader Somoy
24.08.2019

0 comments:

Post a Comment