জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে এই যে সংবাদ, তা ভারতীয় গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে না। ৭২ বছরের যে ভারত, সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন, অসাম্প্রদায়িক নীতি, বহু মত, ধর্ম ও পথের সহাবস্থান বিশে^ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, সেই ভারত এখন এক ভিন্ন ‘চিত্র’ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ২০১৪ সালে এবং ২০১৯ সালে জনগণের ভোটে মোদি সরকার নির্বাচিত হয়েছে। তিনি ও তার সরকার যেসব কাজ করছেন, তার প্রতিটির পেছনে জনগণের সমর্থন আছে বলে তিনি দাবি করছেন। কিন্তু তার এসব কর্মকা-ে গণতন্ত্রের যে মূল স্পিরিট, তা কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে, সেটি এখন ভারতের সর্বত্র মূল আলোচনার বিষয়। কাশ্মীর প্রশ্নে মোদি সরকারের এই নীতি যে বিশে^ ভারতের ভাবমূর্তি কতটা নষ্ট করেছে, কিংবা ভারতীয় গণতন্ত্রকে কতটা ধ্বংস করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিত্ব তথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অমর্ত্য সেন ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্ক কাশ্মীরে গণহত্যা। তিনি এও বলেছেন, ভারতীয় হিসেবে তিনি এখন আর গর্ববোধ করেন না। বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, কাশ্মীরে দুর্বৃত্তের মতো আচরণ করছে মোদি সরকার। তিনি ভারতীয় গণতন্ত্রের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক ও গবেষক রামচন্দ্র গুহ ওয়াশিংটন পোস্টে (১৪ আগস্ট) একটি প্রবন্ধ লিখেছেন) ‘India was a miracle Democracy; But it is time to downgrade its credential "। তার বক্তব্য পরিষ্কার ভারত রাষ্ট্রটি অনেকগুলো জাতি ও উপজাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। সেখানে উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। আচার-আচরণ, ধর্ম, সংস্কৃতির মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তার মতে, ভারত হচ্ছে A Nation of many Nations । গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও প্র্যাকটিস ভারতকে এক কাঠামোয় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এখন সেই গণতন্ত্রকে আর প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র বলা যাবে না। মিথ্যা বলেননি রামচন্দ্র গুহ।
বিশাল এক দেশ ভারত। ধর্মীয়ভাবে অনেক ধর্মের অনুসারীদের বাস ওই ভারতে। জনসংখ্যার ৭৯ দশমিক ৮০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এরপরই মুসলমানদের স্থান, জনসংখ্যার হার ১৪ দশমিক ২৩ ভাগ। খ্রিস্ট ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৩০ ও ১ দশমিক ৭২ ভাগ। ২০ কোটির ওপর মুসলমানদের এই সংখ্যা যেকোনো মুসলমান প্রধান দেশের চেয়ে বেশি। বর্ণ, ধর্ম ও জাতিভিত্তিকভাবে বিভক্ত ভারতকে এক কাঠামোয় রাখতে ভারতীয় সংবিধানপ্রণেতারা একদিকে যেমনি দলিত শ্রেণির (নিম্ন শ্রেণির, অশিক্ষিত মানুষ)Ñ সংবিধানে এক ধরনের রক্ষাকবচ রেখেছেন, অন্যদিকে বিশেষ বিশেষ রাজ্যের জন্য (যেমন : উত্তর পূর্বাঞ্চল, কিংবা কাশ্মীর, অন্ধ্রপ্রদেশ) বিশেষ মর্যাদা তখন সীমিত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। উদ্দশ্য ছিল স্পষ্ট একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোয় কিছু রাজ্যকে কিছু সুবিধা দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আওতায় ভারতীয় ঐক্যকে টিকিয়ে রাখা। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ ৭২ বছর এই ঐক্য টিকে থাকলেও, এখন ওই ঐক্য ফাটল দেখা দিয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদ, কিংবা হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এখন ভারতীয় ঐক্যের জন্য রীতিমতো হুমকি। উত্তর পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলে আসছিল, তা একটা পর্যায়ে স্তিমিত হয়ে এলেও, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ায় নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যে নতুন করে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এই অসন্তোষ অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ এবং একই সঙ্গে ৩৫-এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর ‘আলাদা মর্যাদা’ পেত। এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ (স্থানীয়দের চাকরি-শিক্ষা থেকে সুবিধা, স্থায়ী নাগরিকদের মর্যাদা ইত্যাদি) শুধু জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য ছিল, তেমনটি নয়, অন্যান্য বেশ কিছু রাজ্য এখনো সাংবিধানিকভাবে এ ধরনের ‘বিশেষ সুবিধা’ ভোগ করে থাকে। ৩৭১ এ ও ৩৭১ জি ধারা বলে উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠী অনেকটা কাশ্মীরিদের মতো একই ধরনের সুবিধা পায়। পার্বত্য এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জমির ওপর, বন ও খনিজ সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার স্বীকৃত। তাদের কোনো কর দিতে হয় না। চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে অগ্রাধিকার। এই অঞ্চলে সংবিধানের অনেক ধারা কার্যকর হয়। সেখানে দেশীয় আইন, ঐতিহ্য অনুযায়ী অনেক কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সম্পত্তি ও জমির হস্তান্তরও নিজস্ব নিয়মে চলে। সংবিধানের ৩৬৮ ধারার ভিত্তিতে ৩৭১ নম্বর ধারায় ৯টি রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বাইরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও অন্ধ্রপ্রদেশ রয়েছে সেই তালিকায়। ৩৭১ বি ধারায় কিংবা ২৪৪ এ ধারায় আসাম বেশ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। ৩৭১ ডি ও ই ধারায় অন্ধ্রপ্রদেশে শিক্ষা, চাকরিতে সংরক্ষণসহ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির হাতে। ৩৭১ এইচ ধারা মতে, অরুনাচল রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারেন কেন্দ্র থেকে নিযুক্ত রাজ্যপাল। সুতরাং যেসব অঞ্চল বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে, তাদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে নাগাল্যান্ড, মিজোরামে বিক্ষোভ হয়েছে, স্থানীয় নেতারা কঠোর হুমকি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জম্মু ও কাশ্মীর দ্বিখ-িত হওয়ায় অনেক রাজ্যেই এর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। দার্জিলিংয়েও পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি এক বাক্যে এসেছে। দার্জিলিংয়ের পৃথক রাজ্য গড়ার নেতা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চ্চার বিমল ওরং আত্মগোপনস্থল থেকে এক বার্তায় দার্জিলিংয়েও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এটা একটা অশনিসংকেত। অন্যান্য রাজ্য থেকেও এ ধরনের দাবি উঠতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কী শুধু ‘মিশন কাশ্মীর’ নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন? বাকি অন্য অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে সংবিধানে যে সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা খর্ব করারও উদ্যোগ নেবেন? কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে জন অসন্তোষ গড়ে উঠছে, তা যদি কেন্দ্র বিবেচনায় নেয়, তাহলে সংবিধানে অন্যান্য ও পশ্চাৎপদ রাজ্যগুলোর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে সংবিধানের রক্ষকবচগুলো বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। তবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে এই সিদ্ধান্ত মুসলমানবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব সম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশি।
ভারতের সংবিধানপ্রণেতারা এ ধরনের রক্ষাকবচ দিয়েই ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোকে ‘এক’ রাখতে চেয়েছেন। দীর্ঘদিন কোনো সরকারই এই রক্ষাকবচের ওপর হাত দেয়নি। কেননা, তারা জানতেন সংবিধান লিপিবদ্ধ এসব রক্ষাকবচে যদি ‘হাত’ দেওয়া হয়, তাহলে ভারতের সংহতি বিনষ্ট হবে। ভারত ভেঙে যেতে পারে! বিদেশি সরকারের কাশ্মীর প্রশ্নে নেওয়া সিদ্ধান্ত এখন একদিকে সংবিধানকে যেমনি আঘাত করেছে, তেমনি ভারতের সংহতি ও ঐক্যকেও আঘাত করেছে। একই সঙ্গে ভারতের গণতান্ত্রিক সংহতিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনিতেই ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, ভারতের গণতন্ত্র হচ্ছে ‘ Election only Democracy ’। অর্থাৎ শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিকই হচ্ছে এই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট অনেক ক্ষেত্রেই এখানে অনুপস্থিত। পারিবারিক শাসন তখন পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি (স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে কিছু পরিবার), দলিতদের ব্যবহার করে স্থানীয় তথা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা (মায়াবতী), (লালু প্রসাদ), ক্রিমিনালদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব (শতকরা ৪৩ ভাগ সংসদ সদস্যের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে, দি হিন্দু, ২৬ ২০১৯) ভারতীয় গণতন্ত্রকে সনাতন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে পৃথক করেছে। মোদি জামানায় এখন একটি নতুন মাত্রা বেড়েছেÑ তা হচ্ছে জনগণের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি অব্যাহত রাখা। রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন সাম্প্রদায়িক নীতি প্রোমোট করা হচ্ছে, যা সনাতন গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নামে এক ধরনের ‘করপোরেট সংস্কৃতি’ (ধনী গোষ্ঠীর সুবিধা দেওয়া) সনাতন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকেও এখন চ্যালেঞ্জ করছে।
ফ্রিডম হাউজ বিশ^ব্যাপী গণতান্ত্রিক র্যাংকিং নিয়ে কাজ করে। ২০১৯ সালে তাদের যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মোট স্কোর-১০০-এর মধ্যে ভারতের স্কোর-৭৫। রাজনৈতিক অধিকার কিংবা মানবাধিকার-সংক্রান্ত রিপোর্টে ভারতের অবস্থাও আশাপ্রদ নয়। আলাদাভাবে জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থানও দেখানো হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক নয়। তাই মিলি মিত্র যখন ওয়াশিংটন পোস্টে তার ‘This is the Modi government’s darkest Movement’ এ মোদি সরকারের কাশ্মীর প্রশ্নে গৃহীত সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন, কিংবা বিজেপি নেতারা যখন প্রকাশ্যেই বলেন, ‘India is a Hindu Nation,’, তখন ভারতীয় গণতন্ত্রের কালো দিকটাই প্রকাশ পায়। ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে তখন আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু থাকে না।
Daily Desh Rupantor
24.8.2019
0 comments:
Post a Comment