আসল কথাটি বলে ফেলেছে দিল্লির হাইকোর্ট। গত ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম যন্ত্রটি টেম্পার প্রুফ নয়। অর্থাৎ ইভিএম দিয়ে কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে। এই সংবাদটি পিটিআই ও টাইমস অব ইন্ডিয়া কর্তৃক পরিবেশিত এবং তা বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। বিচারপতি একে সিক্রি ও বিচারপতি রাজিব সাহাই অ্যান্ডলাউর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায়টি দেন। ভোট গণনার বিষয়ে যাতে সব সন্দেহ দূর হয়, বিচারপতিরা সে নির্দেশও দেন। ইভিএম বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকেই উপায় বের করতে হবে বলে রায় দেন হাইকোর্ট।
বাংলাদেশে ইভিএম নিয়ে যখন বিতর্ক বাড়ছে, তখন দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় আমাদের অনেক চিন্তার খোরাক জোগাবে। যেহেতু ইভিএম শতকরা একশত ভাগ কারসাজি রোধ করার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না, সে কারণেই দিল্লি হাইকোর্ট এই রায়টি দিয়েছেন। বাংলাদেশে সীমিত আকারে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে ভুল-ত্রুটি যে হয়নি, তা বলা যাবে না। হয়েছে এবং তা সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃতও হয়নি। এমনি এক পরিস্থিতিতে একটি বা দু’টি স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে তা জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা জাপানেও ইভিএম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার পর তাতে যদি সাফল্য আসে, তখনই আমরা জাতীয় পর্যায়ে এই মেশিন ব্যবহার করতে পারি। অথচ এরই মাঝে বিদায়ী সিইসি ইভিএম ব্যবহার করার ঘোষণা দিয়ে যথেষ্ট বিতর্কিত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে একটি সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। আগামী মাসে ইসিসহ অপর দুই নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সংশোধিত সংবিধানে ৫ জন নির্বাচন কমিশনারের (সিইসিসহ) কথা বলা হয়েছে। এটা সত্য। কিন্তু এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনে অতিরিক্ত আরো দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। এতে সংবিধানের ধারাবাহিকতাও লঙ্ঘিত হবে না। সংবিধানে পাঁচজনের কথা বলা আছে সত্য, কিন্তু সরকার যদি মনে করে এই মুহূর্তে (যখন দেশে কোনো নির্বাচন নেই) নির্বাচন কমিশনে পাঁচজন কমিশনারের প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন কমিশনে এই মুহূর্তে আরো দু’জনের বসার জায়গাও নেই। গাড়ি নেই। জনবল নেই। কমিশনারদের কাজও তেমন নেই। কমিশনাররা ব্যস্ত থাকেন ‘বিদেশ সফর’ নিয়ে। যেখানে সারা বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে সরকারের খরচ না বাড়ানোই শ্রেয়।
‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আস্থার সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো সমাধান দেবে না। বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছেন। কিন্তু সংবিধানে এখন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেয় না। কিন্তু সরকার যদি চায়, তাহলে সমাধান একটা আছে। সরকার উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, সেই রায়ের দ্বিতীয় অংশে, যেখানে আরো দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন, এই অংশটুকু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এ ক্ষেত্রে মহাজোটের শরিকদের (যারা এখনও চাচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন) কাউকে দিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করাতে পারে এবং সরকার পরোক্ষভাবে তা সমর্থন করতে পারে। উক্ত প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে ‘নিরপেক্ষ সরকার’ বলা যেতে পারে, যাদের কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। ওই ‘নিরপেক্ষ সরকার’-এর সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিন সদস্যের একটি যৌথ কাউন্সিল থাকবে। এককভাবে কারো কোনো ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে এরা সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তিন সদস্যের ওই কাউন্সিলে কারা কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের সাথে কথা বলা যেতে পারে।
নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। এ ব্যাপারে সিইসির অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকাতে খবর বেরিয়েছে নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেবে। এটা হাস্যকর বিষয়। শহরের মানুষজন হয়তো ওই মেশিনের ব্যবহার জানবে। কিন্তু গ্রামে? যেখানে এখনও মানুষ অশিক্ষিত, সেখানে সিইসি এই মেশিন ব্যবহার করাবেন কীভাবে? দেখা গেল ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত কর্মকর্তাদের (যারা নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন), সহযোগিতা চাইছেন ভোটাররা। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ওই কর্মকর্তার কথায় প্রভাবিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বিঘিœত হবে। ঢাকায় বসে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের মেশিন ‘বিক্রি’ করার লোকের অভাব নেই। কনসালটেন্সি করার লোকেরও অভাব নেই। তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি। বুয়েটের জনৈক বিশেষজ্ঞ এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছেন। তাঁর এই ‘বিশ্লেষণ’ জ্ঞান এর জন্য ইসি থেকে তিনি কত টাকা নিয়েছেন, তা আমরা জানি না। কিন্তু ইভিএম মেশিনের যে খারাপ দিকও আছে, তা সেমিনার করে আমাদের জানিয়ে দিলেন আরেক ‘বিশ্লেষক’। এখন জানান দিলেন দিল্লির হাইকোর্ট।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা নিয়ে কোনো ধরনের পরীক্ষায় যেতে চাই না। ইভিএম মেশিন খোদ আমেরিকাতেও সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে Democracy and the American Political Process: Single Country Project for Bangladesh প্রজেক্টের আওতায় আমাদের ক’জন শিক্ষককে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইলেকশন কমিশনে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন মিস ডোনা রয়সন। যিনি ছিলেন কমিশনের সহকারী নির্বাহী পরিচালক। সেখানেই ভোট মেশিনের সাথে তাদের পরিচয়। ডোনা তাদের জানিয়েছিলেন ওই মেশিন নিয়ে সমস্যা আছে। সর্বত্র তা ব্যবহৃতও হয় না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে ভোট মেশিন যখন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেখানে বাংলাদেশে সিইসির অতি উৎসাহ প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। তত্ত্বগতভাবে ভোট মেশিন ভালো। কিন্তু আমাদের শিক্ষা, আমাদের পরিবেশ, আমাদের সমাজ সেই পর্যায়ে এখনও উন্নীত হয়নি যে আমরা এখনই ভোটার মেশিন ব্যবহার করবো। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী হলে, সহনশীলতা আরো বাড়লে এবং পরস্পরের প্রতি আস্থার একটা ভিত্তি যদি দাঁড় করাতে পারি, তাহলেই আমরা ভোটার মেশিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এর আগে নয় এবং এটা চালু করা উচিতও হবে না।
বিদায়ী সিইসিসহ দু’জন নির্বাচন কমিশনারই সাবেক আমলা, দু’জন বেসামরিক একজন সামরিক। জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনও নেই। জনগণের পাল্স তারা বুঝতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী কিংবা ইভিএম মেশিন ব্যবহারের আগে যা দরকার, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিরোধী দলকে ‘আঘাত’ করে নয়, বরং আস্থায় নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে বিএনপি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় (বিএনপি ২৭৮টি আসন অন্যরা ২২টি) বিএনপিকে নয়া নির্বাচন দিতে হয়। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ওই নির্বাচন কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে, তা দেশকে শুধুমাত্র একটি সঙ্কটের মাঝেই ঠেলে দেবে না বরং বহিঃবিশ্বে আওয়ামী লীগ একটি ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়বে। তাই যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা, ও তার জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। নির্বাচনের এখনও অনেক বাকি। কিন্তু চারদলীয় জোট এর রোডমার্চ ও সর্বশেষ চট্টগ্রামে জনসমাবেশ ও কর্মসূচি আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে যে চারদলীয় জোট সরকার পতনের আন্দোলনে যাচ্ছে। আমরা আতঙ্কিত এ কারণে যে দেশের অর্থনীতি আদৌ ভালো নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব খুব শিগগিরই আমরা অনুভব করবো। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছে। যার ফলে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, যার পরিমাণ এখন প্রায় ১২ ভাগ। এর প্রতিক্রিয়া কী হবে এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তথা আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য ক্রয়সীমার বাইরে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিতে অস্থিরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে বাধ্য। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সংলাপ হোক। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করুক। পাল্টা কর্মসূচি দিলেই সঙ্কটের গভীরতা বাড়বে, যা কারো জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
বিএনপি যদি তার গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে না পারে, তাহলে দলটিকে বাধ্য করা হবে কঠোর কর্মসূচি দিতে। তাই বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের সাথে সংলাপ জরুরি। সেই সাথে দিল্লি হাইকোর্টের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হবে না- এ ধরনের ঘোষণা দেয়াও প্রয়োজন। জোর করে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার বড় ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে। এ দেশের সুধী সমাজ বারবার ইভিএমের বিপক্ষে বলে আসছে। হাইকোর্টের (দিল্লি) রায় তাদের বক্তব্যকেই সমর্থন করলো। আমরা আশা করবো সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হবে না এই মর্মে নিশ্চয়তা দেবে। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের পরেও যদি সরকার ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সরকারের উদ্দেশ্য সৎ নয়।
0 comments:
Post a Comment