রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আস্থার জায়গাটা কি তৈরী হয়েছে ??

পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজন ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হবেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) প্রথম শ্রেণী ও উপ-পরিদর্শকদের (এসআই) দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে উন্নীত করা হচ্ছে। ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ-২০১২ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীকে সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ বাহিনী চলে সেই জনগণের কাছে পুলিশের আস্থা এতে কতটুকু বাড়বে? নানা কারণে পুলিশ আজ বিতর্কিত। সংসদ সদস্য ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনার মধ্য দিয়ে পুলিশের ‘সাফল্য’ কতটুকু নিহিত ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এতে করে পুলিশের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে উজ্জ্বল হয়নি, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘তদবির’ করে আসছিলেন তাদের জন্য ১০টি ‘সচিব’ পদ সৃষ্টি করার জন্য। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার কাছে এর যুক্তি তুলে ধরেন। এর প্রয়োজনীয়তা আছে কী নেই, এই বিতর্কে আমি যাব না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ‘পাঁচ সচিব’ পদ সৃষ্টির ঘোষণার একদিন আগে যুগান্তরে যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল (সারাদেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামাল), তাতে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘যুগান্তর’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায় সারাদেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে নয় হাজার ১০৪, অপহরণ এক হাজার ২৮০, ক্রসফায়ার ৪০৪, গুপ্তহত্যা ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৬০০টি এবং চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামির দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসক দলের সাত হাজার ১০০ নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই যে পরিসংখ্যান, এটা কি আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাহিনীর জন্য কোন আশার সংবাদ? শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা কি এ সংবাদে খুশি? আমরা আমজনতা এ ঘটনায় খুশি নই। পুলিশ বাহিনী এখন পাঁচজন সচিব পাবে। তাতে করে আমাদের আমজনতার লাভ কী হল? সচিব পর্যায়ের পদ সৃষ্টি করে সম্মান বাড়ানো যায় না।
বলে রাখি, পুলিশ বাহিনীর ব্যাপারে আমার ‘কিছুটা’ দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, আমার প্রয়াত বাবা একসময় পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত থাকলেও সেই পাকিস্তান আমলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি চাকরি হারিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ‘আইনি যুদ্ধ’ করে বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের একটি রায়ে তিনি চাকরি ও সম্মান ফিরে পেয়েছিলেন। তার সেই ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’ আমাকে উৎসাহিত করে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ বাহিনীর অনেক তরুণ অফিসার আমার ছাত্র। তারা যখন বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ নিয়ে বিদেশে যায়, তখন আমার গর্ব হয়। অনেক তরুণ অফিসার যখন আমার বই ও লেখা পড়ে উৎসাহিত হয়ে আমাকে মেইল করে, আমি উৎসাহিত হই। ভাবি, এই তরুণ অফিসাররা আমাদের জন্য একটা আশার জায়গা। তৃতীয়ত, অনেক জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তা যখন আমার পরিচয় পেয়ে ‘কাজটি’ করে দেয়, তখন শিক্ষক হিসেবে আমার প্রাপ্তিটা আমার কাছে বড় হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু কেন যেন আস্থার সেই জায়গাটা ফিঁকে হয়ে আসছে। পুলিশ সপ্তাহের ঠিক একই দিন যখন ছাপা হয় ‘খুলনা বিভাগে তিন বছরে রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ নিহত ১১ শতাধিক’, কিংবা ‘সিলেট শহরে এক বছরে ৩৮ খুন’ (যুগান্তর, ৩ জানুয়ারি), তখন এক হতাশায় পেয়ে বসে আমাকে। আমি জানি অন্যান্য বিভাগের অবস্থাও খুব ভালো নয়। পরিসংখ্যান নাইবা দিলাম। এই পরিসংখ্যান আমার আস্থার ভিতটা নষ্ট করে দেয়।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফণীভূষণ চৌধুরীর বক্তব্য নিয়েও কথা উঠেছে। তিনি কি মিথ্যা বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের যেমন অনেক সফলতা রয়েছে, তেমনি অনেক ব্যর্থতাও রয়েছে। থানায় প্রকৃত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক সময় পুলিশ ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মামলা কিংবা জিডি নিতে চায় না। পুলিশ বিভাগে দিন দিন দুর্নীতি বাড়ছে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহারও হচ্ছে। ফণীবাবুর এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি দ্বিমত প্রকাশ করব না। প্রকৃত অর্থেই থানায় বা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সেবা পাওয়া যায় না। আমি নিজেও সেই ‘সেবা’ একবার পাইনি। আমি যখন ফেসবুক সন্ত্রাসের শিকার হলাম, সাহায্য চেয়েছিলাম র‌্যাবের কাছে। আজকের মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার ছিলেন সেদিন র‌্যাবের মহাপরিচালক। তার সাহায্য আমি পাইনি। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মোখলেছুর রহমান। তার সঙ্গে কথা বলেও কোন প্রতিকার পাইনি। আজ যখন দেখি পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় মোখলেছ সাহেবেরও নাম আছে, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায় বৈকি! আমার মতো একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকও যদি ন্যূনতম সম্মান না পান, যদি প্রতিকার না পান, তাহলে সাধারণ মানুষ কী আশা করতে পারে পুলিশ বা র‌্যাবের কাছ থেকে? নিদেনপক্ষে মোখলেছ সাহেবরা আমাকে জানাতে পারতেন তিনি অপারগ। আমি তো তার সাহায্য চেয়েছিলাম। একজন সিনিয়র শিক্ষককে পাল্টা ফোন করে তাদের অপারগতার কথা জানালেও আমি আশ্বস্ত হতাম। জানি না ট্রেনিংয়ের সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের সৌজন্যবোধ কী তা শেখানো হয় কিনা। কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক যখন অবজ্ঞার পাত্র হন, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায় বৈকি! আজ তাই মোখলেছ সাহেবদের মতো পুলিশ অফিসাররা যখন ‘পদক’ নেন, তখন হতাশা আমাকে পেয়ে বসে। ফণীবাবুর কথায় আমি ‘কিছুটা আশার ঝলকানি’ দেখলেও আস্থা রাখতে পারছি না। তিনি সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। তার আইজিপি হওয়ার কথা ছিল। হতে পারেননি। সান্ত্বনা হিসেবে এখন পুলিশ সমন্বয়ক। জানি না আইজিপি হলে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারতেন কিনা। তবুও তাকে সাধুবাদ জানাই সত্য বলার জন্য। যে অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তব্য রাখছিলেন, সেখানেও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে (সকালের খবর, ৪ জানুয়ারি)। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়। এতে করে পুলিশের মতো একটি শৃংখলাবাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে যায়। এতে করে অন্যরা আরও উৎসাহিত হতে পারেন। ফণীবাবুর বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া উচিত। আজ একজন ফণীবাবু বলছেন, কাল আরেকজন বলবেন। পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি কি ‘ওপেন সিক্রেট’ নয়? জুনিয়র কর্মকর্তারা ঢাকায় পোস্টিং পেতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেনÑ এই অভিযোগ কি অসত্য? ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তাদের নামে-বেনামে যে সম্পত্তি রয়েছে, তা কি বৈধ? সাবেক একজন আইজিপির সংবাদ ছাপা হয়েছিল, যিনি ৩০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সরকার তাকে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু এই অভিযোগটি কি অসত্য? দুদক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবে, শুনেছিলাম। এর পরের খবর আমরা ধার জানি না। তবুও আমি চাই উত্থাপিত অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হোক। কেননা সবাই আইজিপি হতে পারেন না। তিনি যদি অভিযুক্ত হন, তাহলে জাতির আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়।
পুলিশ বিভাগে পাঁচজন সচিব পদ সৃষ্টি করে পুলিশের সেবার মান বাড়ানো যাবে না। এমনিতেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য সরকারের ব্যয় বরাদ্দ এখন অনেক বেশি। এবার পাঁচটি সচিব পদ সৃষ্টির ফলে রাষ্ট্রের ব্যয় বরাদ্দ আরও বাড়বে। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব রাষ্ট্রে সচিবের সংখ্যা অনেক। তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এখন বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্র সাধন চলছে। অনেক ধনী রাষ্ট্র ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে গ্রিস, ইতালি কিংবা পর্তুগাল ও স্পেনের খবর আমরা জানি। সেখানে বিশ্বমন্দার কারণে অর্থনীতি মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থাও খুব ভালো নয়। মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। ডলারের সঙ্গে টাকার মান সর্বনিু পর্যায়ে চলে এসেছে। রেমিটেন্সের প্রবাহ কম। রিজার্ভও বাড়ছে না। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছে। অর্থনীতি নিয়ে যখন আমরা শংকায়, তখন এই মুহূর্তে পুলিশ বিভাগে পাঁচ সচিবের পদ সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল না। এতে করে খরচ আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তা মানতেই হবে। এ সিদ্ধান্তটি যদি পরে কার্যকর হয়, তাতে ক্ষতির কিছু নেই। এ মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন, তা হচ্ছে পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধার করা। র‌্যাবের ভূমিকা আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘মনিটর’ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাবের ভূমিকায় আজ সোচ্চার। ঝালকাঠির লিমনের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। র‌্যাবের অনেক ভালো কাজ এই একটি ঘটনায় ম্লান হয়ে গেছে। ঢাবির মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদেরকে নির্যাতন করা ও তার বিরুদ্ধে ছিনতাই মামলা দেয়াÑ এই একটি ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি কোথায় নেমে গিয়েছিল, সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা তা যদি উপলব্ধি করে না থাকেন, তাহলে তারা ভুল করবেন। উচ্চ আদালত কাদেরের ঘটনায় কী মন্তব্য করেছিলেন, আমরা নিশ্চয়ই তা ভুলে যাইনি।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রচুর। পুলিশ বাহিনীতে ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে, যা কাম্য নয়। পোস্টিং ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটি ‘বিশেষ জেলাকে’ প্রাধান্য দেয়া হচ্ছেÑ এমন অভিযোগ প্রায়ই আমি শুনতে পাই। বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের একসময়ের কর্মীদের যারা পরে বিসিএস দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন, তাদের বিশেষ ‘গুরুত্ব’ দেয়া হচ্ছেÑ এমন অভিযোগও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ পুলিশের ছোট ছোট সাফল্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। বছরের শুরুতেই পুলিশ সপ্তাহ হয়। ঘটা করে অনুষ্ঠান করা হয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে ‘সুখী’ করার জন্য পদক দেয়া হয়। কিন্তু এসব পদকের ‘মূল্য’ তখনই থাকবে, যখন পুলিশ সত্যিকার অর্থেই ‘জনগণের পুলিশ’ হয়ে উঠবে। পাঁচটি সচিব পদ সৃষ্টি করে ‘জনগণের পুলিশ’ হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে না। ফণীবাবুর বক্তব্য অনুধাবন করুন। এর ভেতরেই ‘সত্য’ লুকিয়ে আছে।
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment