সীমান্তে বাংলাদেশিদের নগ্ন করে নির্যাতন করার যে কাহিনী গত ১৯ জানুয়ারি দৈনিক ডেসটিনিসহ অন্যান্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, তা পাঠ করে যে বিষয়টি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে? ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার নিকটবর্তী মোহনগঞ্জ সীমান্তে এক বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীকে উলঙ্গ করে দল বেঁধে বিএসএফের নির্মম নির্যাতনের ঘটনা যখন ভারতীয় টেলিভিশন প্রচার করে, তখন এ দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এ ঘটনায় ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে কী বিএসএফের মনোভাবের আদৌ পরিবর্তন হয়েছে? না, পরিবর্তন হয়নি। ফেলানীর হত্যাকা-ের খবর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, ভারতের মনোভাবের এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। ফেলানীর ঘটনার অনেক পর বিএসএফ দুঃখ প্রকাশ করেছিল। ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে আমাদের ওয়াদা করা হয়েছিল এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু তারপরও সীমান্তে মানুষ মরছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিরীহ বাংলাদেশিরা মারা যাচ্ছে। এসব ঘটনায় ভারতীয়দের মনোভাব আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। ভারতীয়রা আমাদের সম্মানের চোখে দেখছে না। এভাবে গুলি করে মানুষ মারার ঘটনা কিংবা উলঙ্গ করে নির্যাতনের ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সীমান্তেই অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তাই বলে অনুপ্রবেশকারীদের গুলি করে হত্যা করা? এটা চরম মানবাধিকার লংঘনের শামিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেক্সিকোর দ্বন্দ্ব রয়েছে সীমান্ত নিয়ে। মেক্সিকান নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশের ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এটা প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন নানা পন্থা অবলম্বন করলেও, এটা বন্ধ হচ্ছে না। সুড়ঙ্গ তৈরি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে মেক্সিকান নাগরিকদের হত্যা করেছে, এ ধরনের ঘটনা কখনই ঘটেনি। এমনকি ইউরোপেও ধনী রাষ্ট্রগুলোতে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে অহরহ। মানুষ পাচারকারীরা বিভিন্ন রুট দিয়ে ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাজ্যে মানুষ পাচার করে। সীমান্তে এরা ধরাও পড়ে। কিন্তু গুলি করে হত্যা করার ঘটনা কখনই ঘটেনি। সাধারণত পাচারের সময় ধরা পড়ে এবং তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যা ঘটছে এবং ঘটে চলেছে, তা কোনো মতেই সমর্থনযোগ্য নয়। ভারতের উদ্দেশ্য যে সৎ নয়, এটা তারা বারবার প্রমাণ করছে। এসব হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে এমন এক সময় যখন বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা ও ভারতীয় স্বার্থের ব্যাপারে বাংলাদেশের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১০) ও ফিরতি সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় আসা (২০১১) ছিল দুদেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শুধু তাই নয়, সোনিয়া গান্ধী এবং একাধিক ভারতীয় মন্ত্রীর ঢাকা সফর গেল বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি উচ্চ মাত্রায় পেঁৗছে দিয়েছে। অন্যদিকে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পাকিস্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এই তিনটি দেশের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়নি, এমন অভিযোগও উঠেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতা দিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা যখন মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তখন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিগত বছরে এ প্রশ্নটি বারবার উঠেছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এর ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি গত তনি বছরে সবচেয়ে বেশি দিন বিদেশে কাটিয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি খুব একটা সফল না হলেও, বিদেশ সফরে তিনি সফল হয়েছেন। সংখ্যার দিক থেকে যা একশ দিন অতিক্রম করেছে (২০১১) অনেক আগেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার শিশুসুলভ বালখিল্যতায় প্রটোকল উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে ছবি তুলে ও অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা সমৃদ্ধি করতে পারলেও (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ নভেম্বর) গত তিন বছরে বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সাফল্য বয়ে আনতে পারেননি। গেল বছরের প্রায় শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক গত সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবিত জনগণের ক্ষমতায়ন মডেল সংক্রান্ত 'জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন' শীর্ষক রেজ্যুলেশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বকে আরো স্পষ্ট করেছিলেন। কিন্তু 'ভারতমুখী' পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের সব অর্জনকে মস্নান করে দিয়েছে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে 'ভাষা' ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তিটা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও (৪৮:৫২ ভাগ), চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং সেখানে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে জানানো হবে, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ভারত দিলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ কার্যকর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়ার ও এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ঘাটতি বাড়ছে। ভারত অতি সম্প্রতি ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বললেও, তা দিয়ে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে না। স্পর্শকাতর তালিকা বাদ কিংবা সাফটা চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরপরই বেরুবাড়ি আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিন বিঘা আমরা পাইনি। সমুদ্র সীমানা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদ (ভারত-বাংলাদেশের সীমানার ৮নং বস্নকে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করেছে। ৪নং বস্নকেরও দাবি ভারতের) দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান হয়নি। এখন আমরা আছি আরবিট্রেশনে। ফলশ্রুতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, দেখা গেছে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্জন কম; কিন্তু ভারতের প্রাপ্তি অনেক বেশি। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি এক ধরনের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও আমরা লক্ষ করি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে চীন সফর করে এই দুই নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ব্যালেন্স বা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীন এ ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়ক নির্মিত হলে, তা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এর ফলে আগামীতে আমরা সড়কপথেই যে শুধু চীনে যেতে পারব তা নয়, বরং চীন তার ইউনান প্রদেশের পণ্য রফতানিতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরও ব্যবহার করতে পারবে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। আমাদের জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এখন দেখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ পরিবর্তিত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইতিমধ্যে চীনকে সার্কের সদস্যপদ দেয়ার আহ্বান জানান হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবটি স্থাপন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সার্কের নাম পরিবর্তন করতে হবে। চীন বর্তমানে সার্কের পর্যবেক্ষক। সম্প্রতি মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ভুটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে 'গঙ্গা নদী অববাহিকা সংস্থা' ও 'ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এ ধরনের সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখানেও মূল সমস্যা ভারতের আচরণ নিয়ে। কেননা এ অঞ্চলে বিপুল জ্বালানি সম্পদের (জলবিদ্যুৎ) সম্ভাবনা থাকলেও, ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এর সমাধান করছে। আর বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। ফলে বাংলাদেশ যে বহুপাক্ষিকতার প্রস্তাব করেছে, তা কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে। ২৬ বছরে পা দিয়েও সার্কের কর্মকা- তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এক সময় চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বয়ে ২০০১ সালে 'কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলেছিল। কিন্তু ভারত তাতে সায় দেয়নি। ভারত চাচ্ছে 'মেকং গঙ্গা সহযোগিতা', যা 'কুনমিং উদ্যাগ' এর বিকল্প।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন অহরহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে সত্য; কিন্তু তাতে করে আস্থার জায়গাটা আর রাখা যায় না। এমনকি গত শুক্রবার কুমিল্লা সীমান্তে একজন চোরাকারবারির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন বিজিবির সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা (বিএসএফ) ২০ ঘণ্টা পরে তাকে ফেরত দেয়া কোনোমতেই কাম্য নয়। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে সম্পর্ক উন্নত হবে না। বাংলাদেশের মানুষ বারবার লাঞ্ছিত হবে, অপমানিত হবে, এই প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে বাংলাদেশ-ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। দেশ হিসেবে আমরা 'ছোট' হতে পারি। কিন্তু দেশ হিসেবে আমাদের অর্জন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও বেশি। এ কথা স্বয়ং স্বীকার করেছেন অমর্ত্য সেন। তাই ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতা পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।
মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা ও ভারতীয় স্বার্থের ব্যাপারে বাংলাদেশের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১০) ও ফিরতি সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় আসা (২০১১) ছিল দুদেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শুধু তাই নয়, সোনিয়া গান্ধী এবং একাধিক ভারতীয় মন্ত্রীর ঢাকা সফর গেল বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি উচ্চ মাত্রায় পেঁৗছে দিয়েছে। অন্যদিকে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পাকিস্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এই তিনটি দেশের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়নি, এমন অভিযোগও উঠেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতা দিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা যখন মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তখন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিগত বছরে এ প্রশ্নটি বারবার উঠেছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এর ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি গত তনি বছরে সবচেয়ে বেশি দিন বিদেশে কাটিয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি খুব একটা সফল না হলেও, বিদেশ সফরে তিনি সফল হয়েছেন। সংখ্যার দিক থেকে যা একশ দিন অতিক্রম করেছে (২০১১) অনেক আগেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার শিশুসুলভ বালখিল্যতায় প্রটোকল উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে ছবি তুলে ও অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা সমৃদ্ধি করতে পারলেও (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ নভেম্বর) গত তিন বছরে বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সাফল্য বয়ে আনতে পারেননি। গেল বছরের প্রায় শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক গত সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবিত জনগণের ক্ষমতায়ন মডেল সংক্রান্ত 'জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন' শীর্ষক রেজ্যুলেশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বকে আরো স্পষ্ট করেছিলেন। কিন্তু 'ভারতমুখী' পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের সব অর্জনকে মস্নান করে দিয়েছে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে 'ভাষা' ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তিটা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও (৪৮:৫২ ভাগ), চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং সেখানে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে জানানো হবে, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ভারত দিলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ কার্যকর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়ার ও এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ঘাটতি বাড়ছে। ভারত অতি সম্প্রতি ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বললেও, তা দিয়ে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে না। স্পর্শকাতর তালিকা বাদ কিংবা সাফটা চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরপরই বেরুবাড়ি আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিন বিঘা আমরা পাইনি। সমুদ্র সীমানা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদ (ভারত-বাংলাদেশের সীমানার ৮নং বস্নকে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করেছে। ৪নং বস্নকেরও দাবি ভারতের) দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান হয়নি। এখন আমরা আছি আরবিট্রেশনে। ফলশ্রুতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, দেখা গেছে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্জন কম; কিন্তু ভারতের প্রাপ্তি অনেক বেশি। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি এক ধরনের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও আমরা লক্ষ করি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে চীন সফর করে এই দুই নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ব্যালেন্স বা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীন এ ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়ক নির্মিত হলে, তা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এর ফলে আগামীতে আমরা সড়কপথেই যে শুধু চীনে যেতে পারব তা নয়, বরং চীন তার ইউনান প্রদেশের পণ্য রফতানিতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরও ব্যবহার করতে পারবে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। আমাদের জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এখন দেখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ পরিবর্তিত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইতিমধ্যে চীনকে সার্কের সদস্যপদ দেয়ার আহ্বান জানান হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবটি স্থাপন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সার্কের নাম পরিবর্তন করতে হবে। চীন বর্তমানে সার্কের পর্যবেক্ষক। সম্প্রতি মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ভুটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে 'গঙ্গা নদী অববাহিকা সংস্থা' ও 'ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এ ধরনের সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখানেও মূল সমস্যা ভারতের আচরণ নিয়ে। কেননা এ অঞ্চলে বিপুল জ্বালানি সম্পদের (জলবিদ্যুৎ) সম্ভাবনা থাকলেও, ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এর সমাধান করছে। আর বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। ফলে বাংলাদেশ যে বহুপাক্ষিকতার প্রস্তাব করেছে, তা কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে। ২৬ বছরে পা দিয়েও সার্কের কর্মকা- তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এক সময় চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বয়ে ২০০১ সালে 'কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলেছিল। কিন্তু ভারত তাতে সায় দেয়নি। ভারত চাচ্ছে 'মেকং গঙ্গা সহযোগিতা', যা 'কুনমিং উদ্যাগ' এর বিকল্প।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন অহরহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে সত্য; কিন্তু তাতে করে আস্থার জায়গাটা আর রাখা যায় না। এমনকি গত শুক্রবার কুমিল্লা সীমান্তে একজন চোরাকারবারির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন বিজিবির সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা (বিএসএফ) ২০ ঘণ্টা পরে তাকে ফেরত দেয়া কোনোমতেই কাম্য নয়। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে সম্পর্ক উন্নত হবে না। বাংলাদেশের মানুষ বারবার লাঞ্ছিত হবে, অপমানিত হবে, এই প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে বাংলাদেশ-ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। দেশ হিসেবে আমরা 'ছোট' হতে পারি। কিন্তু দেশ হিসেবে আমাদের অর্জন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও বেশি। এ কথা স্বয়ং স্বীকার করেছেন অমর্ত্য সেন। তাই ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতা পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।
0 comments:
Post a Comment