রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সার্চ কমিটি

শেষ পর্যন্ত যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা-ই হয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। রাষ্ট্রপতি ২৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করে এই সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এর আগে বিএনপি বলে আসছিল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন। বিএনপি তার এই দাবির সপক্ষে চারটি লংমার্চ পর্যন্ত করেছে। সর্বশেষ চট্টগ্রামে লংমার্চ শেষে অনুষ্ঠিত জনসভায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বিএনপি নেতারা যে উৎসাহী হবেন, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু একটি সমঝোতা কিভাবে সম্ভব, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। সরকার একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে। যদিও সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে রাষ্ট্রপতির অধিকার সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রপতির এ ধরনের 'বিশেষ অধিকারের' কোনো কথা বলা নেই। সংবিধানের ৪৮(৩)-এ বলা আছে, রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন, যেখানে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এর বাইরে তিনি যে সিদ্ধান্তই নেবেন (এ ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত), তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। আইনি ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রপতি এখন সার্চ কমিটি গঠনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি রয়েছে। আমি এতে আপত্তির কিছু দেখি না। রাষ্ট্রপতি আমাদের, এ জাতির অভিভাবক। আইনি ব্যাখ্যায় যা-ই থাকুক, রাষ্ট্রপতি একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। বিএনপি ওই উদ্যোগের প্রতি সম্মান জানিয়ে সংলাপে অংশ নিয়েছে_এটাও একটা ভালো দিক। কিন্তু এখন বিএনপি সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করায় এ কমিটি এখন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। সরকার হয়তো একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে এবং এর একটি আইনি কাঠামোও দেবে, কিন্তু তাতে করে আস্থার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা মিটবে না। বিএনপি ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে একটি জনমত সৃষ্টি করে ফেলেছে। রাষ্ট্রপতির সংলাপে একাধিক দল, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের মিত্র, তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে। ফলে এর পেছনে একটি মত সমাজে আছে। এখন সরকার যদি এই মতের প্রতি সম্মান না দেখায়, তাহলে রাজনীতিতে সংকট আরো বাড়বে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে একটি সম্ভাব্য বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্ভাব্য এই বিদ্রোহের সঙ্গে বিএনপির জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছেন। প্রতি-উত্তরে বিএনপি বলছে, সশস্ত্র বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করার কথা। বাংলাদেশে যখন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে এবং এর ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছে, তখন সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ প্ররোচিত করা একটি আত্মঘাতী কাজ। কেউ এটা সমর্থন করবে না। যে মুহূর্তে একটি তদন্ত কমিটি সেনা বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করছে, সেই মুহূর্তে পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তব্য না দেওয়াই শ্রেয়। দোষারোপের রাজনীতি, পরস্পরকে অভিযুক্ত করার প্রবণতা পরিত্যাগ করে দেশের সমস্যার দিকে নজর দেওয়া উচিত। এমনিতেই দেশের পরিস্থিতি যে ভালো, তা বলা যাবে না। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব আশার কথা বলে না। ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) আয় হয়েছিল ২৩৩৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ১৭ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার সমান। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আয় কমেছিল প্রায় ছয় হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ কম। এমন এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একাধিক রোডমার্চ সম্পন্ন করেছিল। খালেদা জিয়া জানিয়ে দিয়েছেন যে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আর ঘরে ফিরে যাবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার_বিএনপি এখন সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে যাচ্ছে। যদিও পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০১৩ সালের শেষের দিকে।
বিএনপি মূলত একটি এজেন্ডাকে সামনে রেখে রোডমার্চের আয়োজন করেছিল। আর তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন করা। পাঁচ দফা সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচন পরিচালনা করার কোনো সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের একটি রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন করতে হলে সরকারকে নতুন করে সংসদে একটি বিল আনতে হবে। এটা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে নামকরণ করতে হবে, তার কোনো মানে নেই। কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। হতে পারে এটি একটি নির্দলীয় সরকার। এই নির্দলীয় সরকারে কারা থাকবেন, তা সংসদ ঠিক করে দিতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই ওই নির্দলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। বর্তমান প্রধান বিচারপতি তাঁর দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। বিকল্প হিসেবে ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে এই দায়িত্বটি দেওয়া যেতে পারে। তিনজন গুণী ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি এলডার্স কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে, যাদের দায়িত্ব হবে শুধু একটি নির্বাচন পরিচালনা করা। তবে মূল কথা হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধী দলের সম্মতি না পেলে কোনো প্রস্তাবই জট খুলবে না। এ জন্য একটি সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। সরকারের মন্ত্রীরা বারবার বিএনপিকে সংসদে আসার ও সেখানে গিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে অতীতে বিরোধী দলকে সংসদে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। সংসদে গালাগাল ও অতীত বারবার টেনে আনা হয়েছে। বিচারাধীন মামলা নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সরকার এখন যে কাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে নিজেদের উদ্যোগে একটি নির্দলীয় সরকারের কাঠামো সংসদে উপস্থাপন করা ও তা সংসদে পাস করানো। মহাজোটের শরিকরাও পারে এ ধরনের একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে। বিএনপি ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে পারে, অথবা তাতে সংশোধনী আনতে পারে। এর মাধ্যমে সরকার তার আন্তরিকতা প্রমাণ করতে পারে। সরকার যদি এ ধরনের কোনো প্রস্তাব না আনে, তাহলে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে। ১৯৯৬ সালেও বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। কিন্তু ওই সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস হয়েছিল। এখন দেয়ালের লিখন থেকে সরকার কি কিছু শিখবে? সরকার যদি নমনীয় হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গল। পত্রপত্রিকায় যেসব জনমত প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় একটি নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত সবচেয়ে বেশি। সরকার যদি একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, আমার বিশ্বাস তাতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে বৈ কমবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শিখি না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে এখনো বেশ কিছুটা সময় বাকি আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। এ জন্য বিএনপির সঙ্গে সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। যদিও সংলাপের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। অতীতেও সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। তবুও সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিদেনপক্ষে সংসদের স্পিকার একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিরপেক্ষ থেকে দুই প্রধান দলকে এক টেবিলে ডাকতে পারেন। কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই আলোচনা হতে পারে। ওই আলোচনায় একটা সমাধানে পেঁৗছান সম্ভব বলেই আমি মনে করি। মনে রাখতে হবে ইতিমধ্যে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতু। ওই সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি ১৬ জানুয়ারি ঢাকা সফররত ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী অ্যান্ড্রো মিশেল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর দেশের দেওয়া সাহায্যের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন এনে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের একটি জবাব দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ব্রিটিশ মন্ত্রী মিশেল যে জবাবদিহিতার কথা বলেছেন, সেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো, যদি আমরা সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারতাম। বিরোধী দল এ ক্ষেত্রে 'ওয়াচ ডগ' হিসেবে কাজ করতে পারত। কিন্তু সেটি আমরা পারিনি। এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হানা জাতীয় প্রেসক্লাব আয়োজিত (১৬ জানুয়ারি) মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য রেখেছেন, তাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে সংলাপ অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল কথা। যেকোনো জাতীয় ইস্যুতে সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এই সংলাপ গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে শক্তিশালী করবে মাত্র। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই। কিন্তু তাতে যেন আস্থার সংকট সৃষ্টি না হয়। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখাটা জরুরি। বিএনপি সংসদে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রবর্তনের প্রস্তাব করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলকে অবশ্যই সহনশীল হতে হবে। সরকারি দল যদি সংসদে বিএনপিকে ওই প্রস্তাব উত্থাপনে বাধা দেয়, তাহলে তা এক বাজে নজির হয়ে থাকবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি দলের আচরণে যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে রাজনীতি আরো সংকটের মধ্যে পড়বে। আমরা বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির চর্চা দেখতে চাই। বিরোধী দলের সঙ্গে আস্থার যে ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সার্চ কমিটি গঠিত হোক, ক্ষতি নেই। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হোক। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রবর্তন নিয়ে যে দাবি শক্তিশালী হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৫ জানুয়ারি ২০১২।
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

1 comments:

  1. ভ্রাম্যমান ভোটকেন্দ্র?http://bcsadministration-blog.com/%E0%A6%AD%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%AD%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0/

    ReplyDelete