রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অনিশ্চয়তার চাদরে আঞ্চলিক সহযোগিতা

দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের অর্জন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করেন আঞ্চলিক সহযোগিতা নির্ভর করে দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক ও বিশ্বাসের ওপর। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সেই সম্পর্ক স্থিতিশীল নয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সার্কের তেমন কোন অর্জন নেই। সংগঠনটি পুরোপুরি সফল হয়নি। গত ৭ ও ৮ জানুয়ারি ঢাকায় যে সার্ক যুব সম্মেলন হয়ে গেল ওই সম্মেলনের প্রাক্কালে সার্ক চেম্বারের নেতারা এ ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, যা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ব্যবসায়ী নেতাদের এ ধরনের অভিমত একেবারে ফেলে দেয়ার নয়। কেননা ঢাকায় যুব সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হলেও তা শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমেই থেকে গেছে। আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এমনকি গত ১১ নভেম্বর (২০১১) মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের পরও সার্কের কর্মকাণ্ডে তেমন কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সার্কের বয়স একেবারে কম নয়। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় যে সংগঠনটির জš§, তার বয়স ২৬ বছর। এই ২৬ বছরে মোট ১৭টি সম্মেলন করেছে সার্ক। পরবর্তী ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হবে নেপালে। এই যে ১৭টি সম্মেলন, তাতে অর্জন কতটুকু? ২০ দফা ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে আদ্দু শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছিল। কিন্তু এই শীর্ষ সম্মেলন থেকে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের লাভ তেমন কিছুই হয়নি। মালদ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বলা হচ্ছে বিশ্বের উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে, তা যদি রোধ করা সম্ভব না হয়, তাহলে এ শতাব্দীর শেষের দিকে দেশটি সাগরের বুকে হারিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ সমুদ্রের নিচে কেবিনেট মিটিং পর্যন্ত করেছিলেন, যা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু আদ্দু সিটিতে যখন শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা হয়, তখন মালদ্বীপের এই ভূমিকার সঙ্গে দেশটির আগের ভূমিকাকে আমি মেলাতে পারি না। কেননা ৮টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে অংশ নেয়া এবং তাদের সঙ্গে আসা শত শত সরকারি কর্মচারী ও গণমাধ্যম কর্মীর বিমানে যাতায়াতের জন্য যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল, তা দেশটির জন্য ভালো নয়। এমনকি তা জলবায়ু পরিবর্তনে মালদ্বীপের অবস্থানের পরিপন্থী। পাঠক, আপনাদের ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত ঈঙচ১৫ সম্মেলনের কথা একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কিয়োটো প্রটোকল পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনগুলোকে জাতিসংঘ কর্তৃক ঈঙচ নামে অভিহিত করা হয়। উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলো আগামীতে কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাবে, সে লক্ষ্যেই ঈঙচ সম্মেলনগুলো হচ্ছে (গেল বছরের ডিসেম্বরে ঈঙচ১৭-এ কোন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি)। এটা এখন স্বীকৃত, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের ফলে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। কোপেনহেগেন সম্মেলনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৫ হাজার প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। খরচ হয়েছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার (সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের থাকা-খাওয়ার খরচ আলাদা)। মজার ব্যাপার, হাজার হাজার প্রতিনিধি গিয়েছিলেন কার্বনের নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে। কিন্তু যাতায়াতে গাড়ি ব্যবহার করে তারা নিজেরাই বায়ুমণ্ডলে ১২ দিনে ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বন ছড়িয়েছেন। এই তথ্যটি জাতিসংঘের এবং তা টাইম সাময়িকীতে ২০০৯-এর ৮ ডিসেম্বর ছাপা হয়েছিল। আদ্দু সিটিতে প্রতিনিধিরা কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছে বা মালদ্বীপ সম্মেলন আয়োজনের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তার পুরো হিসাব আমার জানা নেই। কোন সাংবাদিকের লেখনীতেও আমি তা পাইনি। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই নয়, সারা বিশ্বে যেখানে অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করছে, সেখানে এ ধরনের শীর্ষ সম্মেলন ও ‘ফটোসেশন’ করার মধ্যে কোন ধরনের যৌক্তিকতা আছে বলে আমার মনে হয় না।
অতীতের প্রতিটি সম্মেলনের মতো আদ্দু সম্মেলনেও ২০ দফার একটি ঘোষণা আছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন দিকনির্দেশনা ওই ঘোষণাপত্রে নেই। কোন সুস্পষ্ট কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়নি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে যখন এ ধরনের একটি সম্মেলন হয়, তখন আমাদের প্রত্যাশা থাকে মন্দা মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যৌথভাবে একটি কর্মসূচি নেবে। কিন্তু কোন কর্মসূচির কথা বলা নেই ২০ দফায়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মন্দায় আক্রান্ত। বাংলাদেশের রফতানি আয় কমছে ৩৯ ভাগ, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ ভাগ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সরকার গেল বছর অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে (১১.৫৮ ভাগ)। এই চিত্র নেপাল, শ্রীলংকা কিংবা মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মালদ্বীপের একমাত্র আয়ের উৎস। তাতে মন্দার কারণে ধস নেমেছে। এখন করণীয় কী, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। কিন্তু তা নেয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, একটি দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ার লক্ষ্যে ‘ভিশন স্টেটমেন্ট’ তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে ১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইসি থেকে ইইউ) এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে, সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ার। গ্রিস ও ইতালির অর্থনৈতিক সংকট প্রমাণ করেছে, ছোট ও বড় অর্থনীতি নিয়ে গড়া ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জার্মানি ও ফ্রান্স আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা বলছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে থাকবেই। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং গ্র“প সিটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে ভারত হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ওই সময় ভারতের জিডিপির (ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে) পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৮৫ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। চীন থাকবে দ্বিতীয় অবস্থানে। মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ৫৩ হাজার ডলার। এমনকি বর্তমান অবস্থা দিয়েও যদি বিচার করি, তাহলেও ভারতের অর্থনীতির সঙ্গে ভুটান বা নেপালের অর্থনীতিকে মেলান যাবে না। বিশাল একটি পার্থক্য রয়ে গেছে। বড় অর্থনীতি ছোট অর্থনীতিকে গ্রাস করে। ফলে রাজনৈতিক ঐক্য একধরনের অর্থনৈতিক আধিপত্যে পরিণত হয়, যেমনটি হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে হিমালয়ের হিমবাহগুলো যে গলে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কী কর্মসূচি নেয়া যায়, তার কোন উল্লেখ নেই। হিমালয়ের গাঙ্গোত্রি হিমবাহ গত ৩০ বছরে ১.৫ কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। হিমালয়ে উষ্ণতা বাড়ছে। অন্যদিকে সমুদ্রের পানি এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। ২০ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বড় শহরগুলোতে আশ্রয় নেবে। মালদ্বীপের কথা উল্লেখ নাই বা করলাম। এক্ষেত্রে করণীয় কী? আদ্দু ঘোষণায় কোন কর্মসূচি নেই এ ব্যাপারে। অথচ এ অঞ্চলের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ আদৌ দায়ী নয়। বাংলাদেশ বছরে কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ০.২ টন। কিন্তু ভারত করে অনেক বেশি। জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থান এক নয়। ভারত উন্নয়নশীল বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশের গ্র“পে (ব্রাজিল, চীনসহ) অন্তর্ভুক্ত। মূলত ভারতের কারণেই এ অঞ্চলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত গ্র“পে তার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে। এই দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৮৫ ভাগ কমাতে চায়। ভারতের অবস্থান এটা নয়। চতুর্থত, দারিদ্র্য এ অঞ্চলের বড় সমস্যা। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৫৬ ভাগ এখনও দরিদ্র। ভারতে ২০০৪ সালে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭ দশমিক ৫ ভাগ, ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৭ দশমিক ০২ ভাগ। প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় অপুষ্টি আর দরিদ্রতার কারণে। ভারতে কোন কোন রাজ্যে দরিদ্রতা অনেক বেশি। ১৯৯১ সালের কলম্বোর সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দরিদ্রতা দূরীকরণের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেনি। কমিশন সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানোর কথা বললেও ভারত ও পাকিস্তান ব্যয় বরাদ্দ কমায়নি। ওই রিপোর্ট কাগজ-কলমেই থেকে গেছে। পঞ্চমত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সম্পর্ক বাড়েনি। এ অঞ্চলের দেশগুলোর বাণিজ্যের একটা ক্ষুদ্র অংশ পরিচালিত হয় নিজেদের মধ্যে। দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। বাংলাদেশী পণ্য রফতানির তুলনায় আমদানি বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ। একমাত্র শ্রীলংকা ছাড়া প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। অথচ সার্কের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। ষষ্ঠত, ভারত বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ায় এ অঞ্চলে এক ধরনের অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতার পথে প্রধান অন্তরায়। সপ্তমত, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভিসামুক্ত যাতায়াতের প্রস্তাব করা হলেও এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। অথচ সেঞ্জেন চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপ যাতায়াত অবাধ করেছে (সব দেশ অবশ্য তাতে রাজি হয়নি। ২৭টির মধ্যে ১৫টি দেশ সেঞ্জেন চুক্তি স্বাক্ষর করে)। অষ্টমত, আদ্দু ঘোষণায় সাফটা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে (২০০৬ সাল থেকে কার্যকর)। কিন্তু ভারতের নানাবিধ শুল্ক বাধার কারণে সাফটা পূর্ণ কার্যকর হচ্ছে না। ভারত অনেক পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ঘোষণা দিলেও সেখানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। অনেক পণ্যই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উৎপাদন করে না। এমনকি নেগেটিভ লিস্টের কারণেও অনেক পণ্যের ভারতে প্রবেশাধিকার সীমিত। নবমত, দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় সমস্যা জ্বালানি সংকট। বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলংকার মতো দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। আদ্দু ঘোষণায় বিদ্যুতের বাজার খোঁজার জন্য একটি সমীক্ষা চালানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও বিতরণ ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করছে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের পথ। নেপাল ও ভুটানে প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এই দুটো দেশ থেকে বিদ্যুৎ আনতে হলে বাংলাদেশকে ভারতের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হবে। আর ভারত বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে দেখে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালের সপ্তকোসি হাই ড্যাম থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই বাঁধটি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে নেপালের অভ্যন্তরে নির্মিত হবে। সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু বিদ্যুৎ আনতে হবে ভারতের ওপর দিয়ে। সমস্যাটা সেখানেই। ভারত নিজে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যৌথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারতের বৈদেশিক নীতিতে বহুপাক্ষিকতা নেই, যা বাংলাদেশ বিশ্বাস করে। ফলে বিদ্যুতের বিতরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
দশমত, সার্ক ফুড ব্যাংক, বীজ ব্যাংক, দুর্যোগ মোকাবেলা ও সন্ত্রাস দমনে সমন্বিত প্রচেষ্টার যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তা ভালো। তবে আগামী দিনগুলোই বলবে এ ব্যাপারে সার্কের সফলতা কতটুকু। সীমিত পর্যায়ে হলেও সার্কের সফলতা কিছুটা রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সার্ককে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। চীনকে সার্কের কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত না হলেও সার্কের সদস্য। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ভারতের কারণে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে চীন খুব বেশি দূরে নয়। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকেও চীন খুব বেশি দূরে নয়। চীন নিকট প্রতিবেশী। এখন চীন সার্কের সদস্য হলে বিশ্ব আসরে সার্কের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তবে এক্ষেত্রে সার্কের নামের পরিবর্তন হতে পারে। অতীতে বিমসটেকও পরিবর্তিত হয়ে ইইওগঝঞঊঈ (ইধু ড়ভ ইবহমধষ ওহরঃরধঃরাব ভড়ৎ গঁষঃর ঝবপঃড়ৎধষ ঞবপযহরপধষ ধহফ ঊপড়হড়সরপ ঈড়ড়ঢ়বৎধঃরড়হ) হয়েছে।
সুতরাং আজ সার্ক চেম্বার নেতারা যখন সার্কের অর্জন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন, তখন এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু বারবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে আর ‘ফটোসেশন’ করে সার্ককে শক্তিশালী করা যাবে না। বড় দেশ হিসেবে ভারতের ভূমিকা তাই অনেক বেশি। সার্ককে শক্তিশালী করতে হলে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। শুধু একপক্ষীয়ভাবে সুবিধা আদায় করে নিলে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা শক্তিশালী হবে না।
দৈনিক যুগান্তর ২২ জানুয়ারি ২০১২
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment