রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একুশ শতকে বিপ্লব

সনাতন বিপ্লবের ধারা বদলে যাচ্ছে। একুশ শতকে বিপ্লব পরিচালিত হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে, নতুন প্রেক্ষাপটে। নিউইয়র্কের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন গত ৩ জানুয়ারি (২০১২) এই আন্দোলন তার ১০৭ দিন অতিক্রম করেছে। এটা বিপ্লবের একটা নতুন দিক। অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে মানুষ বিপ্লব করেছে। এটা সনাতন। এতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৮১৫) সংগঠিত করেছিল কৃষকরা। রুটির দাবিতে প্যারিসে রুটির দোকান আক্রমণ করেছিল। ফরাসি সমাজে বৈষম্য ছিল। রাজার স্বৈরাচারী মনোভাব ছিল। সাধারণ মানুষ ছিল অবহেলিত, নিষ্পেষিত, শোষিত। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই জনতা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে রাশিয়ার বিপ্লবের (১৯১৭) মিল নেই। ফ্রান্সে বিপ্লবের পর যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মিল আছে এক জায়গায়-অসমতা, দারিদ্র্য আর বৈষম্য যে বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল ফ্রান্সে, সেই মানসিকতাই রাশিয়ায় কৃষক ও শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে। আজ এত বছর পরও নিউইয়র্ক থেকে শুনতে পাচ্ছি বৈষম্যের কাহিনী। এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করেছে পুঁজিবাদী বিশ্বে। এই ‘মুভমেন্ট’ ছড়িয়ে যাচ্ছে এক শহর থেকে অন্য শহরে। আজ ‘আরব বসন্ত’ আরব বিশ্বে যে পরিবর্তন ডেকে এনেছে, তার সঙ্গেও মিল আছে আমেরিকার ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর। নিউইয়র্কের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আর ওয়াশিংটনের October ২০১১ Movement একই সূত্রে গাঁথা।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল যে পুঁজিবাদই সমাজের মঙ্গল আনতে পারে (?)। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্ত্বিক (ফুকিয়ামা) এই ধারণার সপক্ষে তাদের লেখনী অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদী সমাজেই একটি বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ বহন করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক।
আর জোসেফ স্টুগলিেজর মতে, শীর্ষে থাকা এই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যায় লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এখন এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে casino capitalism. অথচ পরিসংখ্যান বলে সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন, অর্থাত্ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ জানিয়েছে তারা গ্রাজুয়েশন করার পর চাকরি পাচ্ছে না। অথচ ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই যে বৈষম্য, একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ করা যায় পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই। এক ধরনের class warfare বা শ্রেণীযুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’গুলো তার বড় প্রমাণ। এই শ্রেণীযুদ্ধের কথা বলেছিলেন মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণে এই শ্রেণী-দ্বন্দ্ব কোনো সমাজের বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বিখ্যাত The communist Manifesto গ্রন্থে এই শ্রেণী-দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন ... a fight that each time ended, either in a revolutionary reconstitution of society at large, or in a common ruin of the contending classes। অর্থাত্ দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটবে। মার্কস চূড়ান্ত বিচারে শোষিত শ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণী দ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও শ্রেণী দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজও বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রেণী-দ্বন্দ্বকে কীভাবে বিশ্লেষণ করতেন, বলতে পারব না। তবে নোয়াম চমস্কির লেখনীতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার চমত্কার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেন Plutonomy হিসেবে, অর্থাত্ সম্পদশালী ধনিক শ্রেণী নির্ভর একটি সমাজ। নোয়াম চমস্কি লিখেছেন, Increasingly, wealth concentrated in the financial sector. Politicians faced with the rising cost of compaigns, were driven ever deeper into the packets of wealthy backers। এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু ধনিক শ্রেণীর হাতে। রাজনীতি, অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা হয় Billionaire friendly। ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস। ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর কংগ্রেস সদস্যরা ধনীদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার এই ‘অকুপাই মুভমেন্টে’ এতটুকুও অবাক হননি। তিনি লিখেছেন, The most exciting aspect of the occupy movement is the construction of the linkage that are taking place all over. If they can be sustained and expanded, occupy can lead to dedicated efforts to set society on a moral humane course। মার্কস যেখানে বিস্ময়ের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন Moral human course-এর কথা। সারা বিশ্বে যে ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা দরকার-এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইউরোপীয় ঐক্যে একটি বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই  বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এই বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণী বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটিতে দরিদ্রতার হার ৬ ভাগ, আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ ভাগ। সুইজারল্যান্ড ইইউর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮, আর ৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এই হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ ভাগ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ ভাগ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের খবর আমরা জানি। কেননা ওসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ওইসব দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছেন। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে অকুপাই মুভমেন্টকে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিত শ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লবকে সংঘটিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তত্কালীন জার্মানি ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জেডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকে এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অসমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপীই একটি পরিবর্তন আনছেন। এই পরিবর্তকে ‘বিপ্লব’ বলা যাবে কী না জানি না, কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যে একটি পরিবর্তন লক্ষ করবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এই পরিবর্তন সমাজকে কতটুকু বদলে দেবে বলা মুশকিল। রাশিয়াতে বিপ্লবের পর সমাজ বদলে গিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৭০ বছরে দেখা গেল সেখানে একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যারা সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষমতা ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানেও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। আশির দশকের শেষের দিকে আমি পূর্ব ইউরোপে এই বৈষম্য দেখেছি। রাশিয়াতেও এই বৈষম্য আমার চোখে পড়েছিল। মাও জেডং একবার বলেছিলেন পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দাও। তেং শিয়াও পিং পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দেননি। কিন্তু অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। পরিবর্তন সেখানে এসেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কী পরিবর্তন আসছে? যেভাবে আমেরিকার সমাজ বিকশিত হচ্ছে, সেভাবে আর বিকশিত হবে না। পরিবর্তন সেখানে আসবেই। এক সময় মার্কসবাদীরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। এখন তারা সশস্ত্র পথ পরিত্যাগ করে (নেপালি মাওবাদীরা) সমাজে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। এটা একটা নতুন দিক। বিপ্লবের সংজ্ঞা বদলে গেছে। একুশ শতকে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে এক নতুন ধরনের বিপ্লব।
লেখক : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment