সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব ঘটনা হতে চলেছে, তাতে করে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। প্রায়ই আমাকে এক ধরনের বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। এতদিন ছাত্রদের রাজনীতির কারণে শিক্ষাঙ্গনে অশান্তি ছিল। এখন শিক্ষকরা এমন সব কর্মকা-ে নিজেদের জড়িত করছেন, যাতে করে শিক্ষক হিসেবে আমাকে পরিচয় দিতেও লজ্জা লাগে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছাত্র পড়ানো। কিন্তু সেই কাজটিও আমি ঠিকমতো করতে পারছি না পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকার কারণে। দুটো ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করছি। যা আমাকে ব্যথিত করেছে। এক. অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কক্ষে তালা ও আগুন দেয়া। সেইসাথে তাকে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি। দুই. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্বাচিত শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এ মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর কর্তৃক লাঞ্ছিত। ওই ঘটিনায় প্রক্টর অবশ্য পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তা তিনি করেছেন ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে। কিন্তু তিনি বা তার সমর্থকরা যে কা-টি করলেন, তা কি উপাচার্য মহোদয়কে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিলেন না? ওই ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভিসিকে তলব করেছিল। এতে করেই বোঝা যায় শিক্ষামন্ত্রী ওই ঘটনায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একজন ভিসিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন তলব করে তখন তো আমরাও লজ্জিত হই। কেননা তিনি তো আমাদের সহকর্মী। হয়ত আগামীকালই তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। তিনি শিক্ষক এটাই তার বড় পরিচয়। এর আগে হাইকোর্ট তাকে একবার তলব করেছিলেন। এটাও তার জন্য সুখের ছিল না। তখন একজন শিক্ষক তার একজন নারী সহকর্মীকে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন। তাতে সারাদেশ সোচ্চার হয়েছিল। শিক্ষক রাজনীতি এমনই যে ওই শিক্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেননি উপাচার্য। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে (সাঈদী) কথা বলেছেন। সস্নোগান '৭১ নামে একটি সংগঠন তার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, ক্যাম্পাসে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি যে পূর্ণ নিরাপত্তায় আছেন তা বলতে পারব না। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বুঝি দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, তখন তার বুঝে শুনে কথা বলা উচিত ছিল। যদিও তিনি অস্বীকার করেছেন তিনি ওই ধরনের কথা বলেননি। কিন্তু ততদিন কি অনেক দেরি হয়ে যায়নি? একজন আইনের শিক্ষক হিসেবে তিনি তো জানবেন, কোন কথাটা বলা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়। আমাদের মূল্যবোধ দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। সিনিয়র শিক্ষকদের আমরা সম্মান করি না। ব্যক্তি তথা দলীয় স্বার্থ যেখানে বেশি, সেখানে নূ্যনতম সম্মানবোধ এতটুকুও স্থান পায় না জাবির অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছনা করার ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তি জাতির কাছে কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছে, এটা লাঞ্ছনাকারীরা কতটুকু উপলব্ধি করেছেন, আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেকে অপমানিত বোধকরি। আমি অনেক 'ছোট' হয়ে গেছি অন্যদের কাছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে আলোচিত। একের পর এক ছাত্র হত্যা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। নারী শিক্ষক নির্যাতনকারীকে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারিনি। একজন সিনিয়র শিক্ষক একজন জুনিয়র শিক্ষককে 'চড়-থাপ্পর' পর্যন্ত মেরেছিলেন। 'ফেসবুকে' একজন সিনিয়র শিক্ষককে নিয়ে যখন লেখালেখি হলো, তখন প্রশাসন ছিল নির্লিপ্ত। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একজন শিক্ষক ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর 'মৃত্যু' পর্যন্ত কামনা করেন। কী জঘন্য অপরাধ। এখানে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এরচেয়ে তো আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। প্রতিটি অন্যায়ের যদি বিচার হতো, তাহলে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটছে, তা ঘটত না। স্বীকার করি প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনাকারী শিক্ষক রুহুল আমিন খন্দকার বর্তমান উপাচার্যের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হননি, কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের আমলে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ করেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার চাইতে ব্যক্তিগত আনুগত্য ও রাজনৈতিক আনুগত্যতা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এরা তাই সিনিয়রকে সম্মান করে না। করতে শেখেনি।
হত্যার বিচারের দাবিতে মশাল মিছিল |
নিহত জুবায়ের |
0 comments:
Post a Comment