বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার অনুমতি দিতে যাচ্ছে সরকার। এ সংক্রান্ত একটি খবর দীর্ঘদিন ধরেই বাজারে চালু রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকার অনুমতি দেয়নি। কিন্তু তার আগেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজের (এপিইউ) কর্মকাণ্ড নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এপিইউ শুধু এর বিরোধিতাই করছে না, বরং একাধিকবার তথাকথিত গোলটেবিল বৈঠকের ব্যবস্থা করে এর নেতিবাচক (?) দিকগুলো তুলে ধরছে। গত ২৬ ডিসেম্বর সমকালে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, যাকে শীর্ষ সংবাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে (বাড়বে সার্টিফিকেট বাণিজ্য), তাতে এমন একটি ধারণার জন্ম হতে পারে যে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা চালু করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সার্টিফিকেট বাণিজ্য। এটা কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া নয়? এপিইউ কি নিজেদের হাজারটা দোষ ও অন্যায়কে এক পাশে সরিয়ে রেখে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার বিরোধিতা করছে না?
গেল সপ্তাহেও মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের একটি মন্তব্য ছাপা হয়েছে, যেখানে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে। মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত অধ্যাপক আসাদুজ্জামান ছিলেন এই সার্টিফিকেট বাণিজ্যের প্রচণ্ড বিরোধী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড ও সার্টিফিকেট বাণিজ্য নিয়ে আমার ধারণা রয়েছে। মঞ্জুরি কমিশনে কাজ করার সুবাদে দেখেছি কীভাবে সার্টিফিকেট বাণিজ্য হয়! শুধু তাই নয়, আইনের অপব্যাখ্যা করে গ্রাম-গঞ্জে তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর সার্টিফিকেট বাণিজ্য করেছে। আমি নিজে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ববলে কিশোরগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সেদিন প্রশাসনের সহযোগিতা আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা আমরা বন্ধ করতে পারিনি হাইকোর্টে একটি রিট থাকার কারণে। এপিইউয়ের নেতারা যে বিষয়টি জানেন না, তা নয়। এ নিয়ে তাদের সভায় আমন্ত্রিত অতিথি হয়েও আমি সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো উদ্যোগ নেননি। এ ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট বাণিজ্য সংক্রান্ত সব অনিয়ম বন্ধ না করে যখন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার বিরোধিতা করেন, তখন তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তাদের এই বিরোধিতা যুক্তিহীন। কেননা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে তাদের তো ছাত্র হারানোর কোনো আশঙ্কা নেই। আমাকে দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ক\'টিতেই মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের \'ভাড়ায়\' এনে তাদের নাম ব্যবহার করে ছাত্র সংগ্রহ করা হয় বটে, কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে তেমন উদ্যোগ তারা নেন না। অর্থ উপার্জনই হলো আসল।
তদন্ত করে দেখেছি \'আউটার ক্যাম্পাস\' থেকে প্রাপ্ত অর্থ উপাচার্য মহোদয়দের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হয়। অনেকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার আনা না হলে তাদের \'সার্টিফিকেট বাণিজ্য\' বন্ধ হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনোটিতে যারা শিক্ষাদান করেন তাদের পাঠদানের আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর কলেজ শিক্ষকদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানোর আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কোনো কোনো বিভাগে এমন সব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে যাদের ওই সব বিষয়ে আদৌ কোনো ডিগ্রি নেই। পরিসংখ্যানের মতো বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে ব্যবসা প্রশাসনে পড়াচ্ছেন_ এমন একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যও আমার কাছে আছে। ধানমণ্ডিতে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের যিনি শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, তার আইনে কোনো অনার্স ডিগ্রি নেই। তার মূল ডিগ্রি অন্য বিষয়ে। সমাজের কিছু নামিদামি ব্যক্তিকে কোনো কোনো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি \'অধ্যাপক\' হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, যাদের একদিনও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতা নেই। এগুলো কি প্রতারণা নয়? প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়। যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি হয়তো ভালো প্রশাসক ছিলেন এক সময়; কিন্তু শিক্ষক হন কীভাবে? শিক্ষক হতে হলে গবেষণা করতে হয়, গ্রন্থ লিখতে হয়। ছাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু শুধু তার নামকে ব্যবহার করা হচ্ছে ছাত্র তথা অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার জন্য। এটিই তো প্রতারণা। আমি একজন ব্যাংকারকে চিনি, যিনি আর্থিক অনিয়মের কারণে বরখাস্ত হয়েছিলেন, তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের \'অধ্যাপক\'। পাঠক, আরও দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। ভদ্রলোক এক সময় একটি বিদেশি দূতাবাসে চাকরি করতেন। একদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক-কাম উপাচার্য হয়ে গেলেন। হঠাৎ করেই নামের আগে তিনি লিখতে শুরু করলেন \'অধ্যাপক\'। আরেক ভদ্রলোক মানবসম্পদ রফতানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হননি বটে; কিন্তু নামের আগে \'অধ্যাপক\' লিখতে শুরু করেছেন। এদের অনেকেরই পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইদানীং আরেক প্রবণতা শুরু হয়েছে_ নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে উপাচার্য বানানোর পাঁয়তারা। স্ত্রী ও সন্তানরা যথারীতি ডক্টরেট অথবা \'অধ্যাপক\' পদবি ব্যবহার করছেন। কে তাকে অধ্যাপক বানালো? প্রচলিত নিয়ম কি ওই বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করেছে? কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমনকি কলেজেও) অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেতে হলে ১৫ থেকে ১৭ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। সে সঙ্গে থাকতে হয় নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ। তা না হলে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া যায় না। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসবের নিয়ম নেই। অনেকেই \'অনলাইন\'-এ তথাকথিত ডক্টরেট ডিগ্রি ক্রয় করছেন। অথচ এর কোনো একাডেমিক মূল্য নেই; কিন্তু আমরা তা অবলীলায় ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছি। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা মঞ্জুরি কমিশনে থাকাকালে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের \'ডাটাবেজ\' করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা বন্ধ হলো কার নির্দেশে? কার স্বার্থে?
আমি অবশ্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাই। সেই সঙ্গে চাই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাও এ দেশে আসুক। তাতে ক্ষতি কী? মালয়েশিয়াতে দেখেছি অস্ট্রেলিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা সেখানে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকেই শিক্ষকরা এসে পড়ান। ভারতে বেশ কটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের গ্র্যাজুয়েটদের নাম বিশ্বব্যাপী। আমি চাই ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শাখা বাংলাদেশে স্থাপন করুক। এর ফলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কেননা, এখন যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের একাডেমিক মানের চাইতে রাজনৈতিক আনুগত্যটাই অনেক বেশি। ফলে গবেষণা ও শিক্ষকতার চাইতে \'দলবাজি\' করা তাদের প্রধান ও একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি আগ্রহ বাড়বেই। অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি \'রাজনীতি\' করেন বটে, কিন্তু একাডেমিক পিউরিটির ব্যাপারে কোনোদিন \'কমপ্রোমাইজ\' করেননি। অধ্যাপক মহব্বত খান এ দেশের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত ব্যক্তি। আমার শিক্ষক তিনি। আমি মঞ্জুরি কমিশনে যে চেয়ারটি ছেড়ে এসেছি, সেই চেয়ারেই বসছেন আমার শিক্ষক অধ্যাপক মহব্বত খান, যাকে নিয়ে আমি গর্ব করি। অধ্যাপক খান শিক্ষক জীবনে শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে কোনো \'কমপ্রোমাইজ\' করেননি। এই দুই পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার অনুমুতি দেবে কি দেবে না_ এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। ইউজিসি যে কাজগুলো করতে পারে তা অনেকটা এ রকম : ১. অধ্যাপক অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করা, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নির্ধারণ করে রেটিং করবে; ২. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের \'ডাটাবেজ\' তৈরি করা; ২. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের পিএইচডির সম্মান নির্ণয় করা (এ কাজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হয়ে ইউজিসি করে যে কোনো বিদেশি ডিগ্রির ক্ষেত্রে); ৩. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ প্রথা-পদোন্নতির জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করা; ৪. উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানকে অগ্রাধিকার দেয়া, ৫. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা; ৬. নিয়মিত মনিটর করা; ৭. ইউজিসির টিম দিয়ে আর্থিক আয়-ব্যয় খতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আইন কঠোরভাবে অনুসরণ করা ইত্যাদি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যুগের চাহিদা। কিন্তু তার অর্থ নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদেরকে \'সার্টিফিকেটসর্বস্ব\' জাতিতে পরিণত করবে। ঘরে ঘরে মাস্টার্স ডিগ্রি তৈরি করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাবে না। কলেজ শিক্ষক দিয়ে কলেজ চালানো যায়, বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যায় না। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন।
দৈনিক সমকাল ১লা জানুয়ারি ২০১২
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান
গেল সপ্তাহেও মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের একটি মন্তব্য ছাপা হয়েছে, যেখানে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে। মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত অধ্যাপক আসাদুজ্জামান ছিলেন এই সার্টিফিকেট বাণিজ্যের প্রচণ্ড বিরোধী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড ও সার্টিফিকেট বাণিজ্য নিয়ে আমার ধারণা রয়েছে। মঞ্জুরি কমিশনে কাজ করার সুবাদে দেখেছি কীভাবে সার্টিফিকেট বাণিজ্য হয়! শুধু তাই নয়, আইনের অপব্যাখ্যা করে গ্রাম-গঞ্জে তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর সার্টিফিকেট বাণিজ্য করেছে। আমি নিজে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ববলে কিশোরগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সেদিন প্রশাসনের সহযোগিতা আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা আমরা বন্ধ করতে পারিনি হাইকোর্টে একটি রিট থাকার কারণে। এপিইউয়ের নেতারা যে বিষয়টি জানেন না, তা নয়। এ নিয়ে তাদের সভায় আমন্ত্রিত অতিথি হয়েও আমি সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো উদ্যোগ নেননি। এ ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট বাণিজ্য সংক্রান্ত সব অনিয়ম বন্ধ না করে যখন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার বিরোধিতা করেন, তখন তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তাদের এই বিরোধিতা যুক্তিহীন। কেননা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে তাদের তো ছাত্র হারানোর কোনো আশঙ্কা নেই। আমাকে দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ক\'টিতেই মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের \'ভাড়ায়\' এনে তাদের নাম ব্যবহার করে ছাত্র সংগ্রহ করা হয় বটে, কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে তেমন উদ্যোগ তারা নেন না। অর্থ উপার্জনই হলো আসল।
তদন্ত করে দেখেছি \'আউটার ক্যাম্পাস\' থেকে প্রাপ্ত অর্থ উপাচার্য মহোদয়দের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হয়। অনেকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার আনা না হলে তাদের \'সার্টিফিকেট বাণিজ্য\' বন্ধ হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনোটিতে যারা শিক্ষাদান করেন তাদের পাঠদানের আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর কলেজ শিক্ষকদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানোর আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কোনো কোনো বিভাগে এমন সব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে যাদের ওই সব বিষয়ে আদৌ কোনো ডিগ্রি নেই। পরিসংখ্যানের মতো বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে ব্যবসা প্রশাসনে পড়াচ্ছেন_ এমন একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যও আমার কাছে আছে। ধানমণ্ডিতে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের যিনি শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, তার আইনে কোনো অনার্স ডিগ্রি নেই। তার মূল ডিগ্রি অন্য বিষয়ে। সমাজের কিছু নামিদামি ব্যক্তিকে কোনো কোনো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি \'অধ্যাপক\' হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, যাদের একদিনও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতা নেই। এগুলো কি প্রতারণা নয়? প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়। যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি হয়তো ভালো প্রশাসক ছিলেন এক সময়; কিন্তু শিক্ষক হন কীভাবে? শিক্ষক হতে হলে গবেষণা করতে হয়, গ্রন্থ লিখতে হয়। ছাত্র পড়ানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু শুধু তার নামকে ব্যবহার করা হচ্ছে ছাত্র তথা অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার জন্য। এটিই তো প্রতারণা। আমি একজন ব্যাংকারকে চিনি, যিনি আর্থিক অনিয়মের কারণে বরখাস্ত হয়েছিলেন, তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের \'অধ্যাপক\'। পাঠক, আরও দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। ভদ্রলোক এক সময় একটি বিদেশি দূতাবাসে চাকরি করতেন। একদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক-কাম উপাচার্য হয়ে গেলেন। হঠাৎ করেই নামের আগে তিনি লিখতে শুরু করলেন \'অধ্যাপক\'। আরেক ভদ্রলোক মানবসম্পদ রফতানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হননি বটে; কিন্তু নামের আগে \'অধ্যাপক\' লিখতে শুরু করেছেন। এদের অনেকেরই পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইদানীং আরেক প্রবণতা শুরু হয়েছে_ নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে উপাচার্য বানানোর পাঁয়তারা। স্ত্রী ও সন্তানরা যথারীতি ডক্টরেট অথবা \'অধ্যাপক\' পদবি ব্যবহার করছেন। কে তাকে অধ্যাপক বানালো? প্রচলিত নিয়ম কি ওই বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করেছে? কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমনকি কলেজেও) অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেতে হলে ১৫ থেকে ১৭ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। সে সঙ্গে থাকতে হয় নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ। তা না হলে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া যায় না। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসবের নিয়ম নেই। অনেকেই \'অনলাইন\'-এ তথাকথিত ডক্টরেট ডিগ্রি ক্রয় করছেন। অথচ এর কোনো একাডেমিক মূল্য নেই; কিন্তু আমরা তা অবলীলায় ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছি। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা মঞ্জুরি কমিশনে থাকাকালে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের \'ডাটাবেজ\' করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এটা বন্ধ হলো কার নির্দেশে? কার স্বার্থে?
আমি অবশ্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাই। সেই সঙ্গে চাই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখাও এ দেশে আসুক। তাতে ক্ষতি কী? মালয়েশিয়াতে দেখেছি অস্ট্রেলিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা সেখানে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকেই শিক্ষকরা এসে পড়ান। ভারতে বেশ কটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের গ্র্যাজুয়েটদের নাম বিশ্বব্যাপী। আমি চাই ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শাখা বাংলাদেশে স্থাপন করুক। এর ফলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কেননা, এখন যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের একাডেমিক মানের চাইতে রাজনৈতিক আনুগত্যটাই অনেক বেশি। ফলে গবেষণা ও শিক্ষকতার চাইতে \'দলবাজি\' করা তাদের প্রধান ও একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি আগ্রহ বাড়বেই। অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি \'রাজনীতি\' করেন বটে, কিন্তু একাডেমিক পিউরিটির ব্যাপারে কোনোদিন \'কমপ্রোমাইজ\' করেননি। অধ্যাপক মহব্বত খান এ দেশের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত ব্যক্তি। আমার শিক্ষক তিনি। আমি মঞ্জুরি কমিশনে যে চেয়ারটি ছেড়ে এসেছি, সেই চেয়ারেই বসছেন আমার শিক্ষক অধ্যাপক মহব্বত খান, যাকে নিয়ে আমি গর্ব করি। অধ্যাপক খান শিক্ষক জীবনে শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে কোনো \'কমপ্রোমাইজ\' করেননি। এই দুই পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার অনুমুতি দেবে কি দেবে না_ এটা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। ইউজিসি যে কাজগুলো করতে পারে তা অনেকটা এ রকম : ১. অধ্যাপক অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করা, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নির্ধারণ করে রেটিং করবে; ২. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের \'ডাটাবেজ\' তৈরি করা; ২. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের পিএইচডির সম্মান নির্ণয় করা (এ কাজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হয়ে ইউজিসি করে যে কোনো বিদেশি ডিগ্রির ক্ষেত্রে); ৩. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ প্রথা-পদোন্নতির জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করা; ৪. উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানকে অগ্রাধিকার দেয়া, ৫. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা; ৬. নিয়মিত মনিটর করা; ৭. ইউজিসির টিম দিয়ে আর্থিক আয়-ব্যয় খতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আইন কঠোরভাবে অনুসরণ করা ইত্যাদি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যুগের চাহিদা। কিন্তু তার অর্থ নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদেরকে \'সার্টিফিকেটসর্বস্ব\' জাতিতে পরিণত করবে। ঘরে ঘরে মাস্টার্স ডিগ্রি তৈরি করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাবে না। কলেজ শিক্ষক দিয়ে কলেজ চালানো যায়, বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যায় না। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন।
দৈনিক সমকাল ১লা জানুয়ারি ২০১২
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য
tsiahmanbd@yahoo.com
tsiahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment