সমুদ্রে বাংলাদেশের অধিকার স্বীকৃত হলেও, যেতে হবে এখন অনেক দূর। বাংলাদেশ তার দাবি থেকে আরো বেশি পেয়েছে বলে দাবি করা হলেও, বিদেশে কোনো কোনো গবেষণা জার্নালে এও মন্তব্য করা হয়েছে, এই রায়ে বাংলাদেশ যেমন 'বিজয়ী' হয়েছে, ঠিক তেমনি বিজয়ী হয়েছে মিয়ানমারও। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট নয়, আমরা কতটুকু লাভবান হলাম। গভীর সমুদ্রে যে ২৮টি বস্নক ভাগ করা হয়েছিল গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানের জন্য, এই রায়ের ফলে তার কটিতে আমাদের অধিকার রক্ষিত হল, বলা মুশকিল। একমাত্র আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের (ইটলস) পূর্ণাঙ্গ রায়, নটিক্যাল চার্ট ও আনক্লজ-৩ এর বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করার পরই বোঝা যাবে বাংলাদেশের অধিকার ওই ২৮টি বস্নকে কতটুকু রক্ষিত হয়েছে। তবুও ওই রায়ে আমাদের যে অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, তা কম পাওয়ার নয়। আমাদের এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, ওই রায়কে সামনে রেখে জরিপ চালানো। কেননা গভীর সমুদ্রে জলরাশিতে যেমনি রয়েছে প্রচুর মৎস্যসম্পদ ঠিক তেমনি সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে প্রচুর খনিজ সম্পদ। বলা হয় কপার, ম্যাগনেসিয়াম, নিকেল ও কোবাল্টের মতো খনিজ সম্পদ রয়েছে সমুদ্র তলদেশে। এই সম্পদ আহরণের জন্য দক্ষ জনশক্তি আমাদের গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য সমুদ্রের কাছাকাছি বরিশালে একটি মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত অনেক আগেই হয়ে আছে। এখন দরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া। বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিদ্যা বিষয়টি চালু করা যেতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়টি রয়েছে। এই বিভাগকে (ইনস্টিটিউট) আরো আধুনিক করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সাগরঘেঁষা পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বিভাগটি চালু করা যেতে পারে। যতদূর জানা যায়, তাতে দেখা গেছে, অত্যাধুনিক কোনো জরিপ জাহাজ বাংলাদেশের হাতে নেই। এটা সংগ্রহ করা জরুরি হয়ে পড়েছে এখন। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হয়। বিদেশি জাহাজ আমাদের সমুদ্রসীমায় দূষিত পদার্থ ফেলে চলে যায়। ফলে মৎস্যসম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়ত, বিদেশি মাছ ধরা জাহাজ আমাদের এলাকায় মাছ ধরে চলে যায়। এ জন্য নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। এর চেয়েও যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া। সম্পর্কটি যে খুব ভালো তা বলা যাবে না। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে খুব বেশি গুরুত্ব দেইনি। অথচ আমাদের জাতীয় স্বার্থে মিয়ানমার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রাম-মিয়ামারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিনির্ভর মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় দ্রুত বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রফতানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারের মাইআউংমিয়া দ্বীপে প্রায় ৪০ মিলিয়নের বেশি মেট্রিক টন চুনাপাথর রয়েছে। এই দ্বীপটি আকিায়ব বা সিটওয়ে থেকে আরো দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। আর সিটওয়ে-ইয়াঙ্গুন হাইওয়ের পথ ধরে সামনে এগুলেই ইয়েউমা পাহাড় শ্রেণী, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁশঝাড়। আয়তনে সাড়ে সাত হাজার বর্গমাইল। বাংলাদেশ এই বাঁশ আমদানি করতে পারে অথবা বাঁশের মন্ডও আমদানি করা সম্ভব। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। অতীতে জমি লিজ দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এটা কার্যকর করা গেলে ইরাবতির দুকূলজুড়ে উর্বর শস্যক্ষেত বাংলাদেশি কৃষকরা সেনার ফসলে ভরে দিতে পারবে। আর সহজেই এ ফসল বাংলাদেশে বহন করা যাবে ঘুমধুমমুসে হাইওয়ে ধরে। মান্দালয়-ম্যাগাওয়ের তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ ভারতের ওপর থেকে তুলার নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারে। সাম্প্রতিক সময় ভারত থেকে তুলা আমদানি নিয়ে কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। মিয়ানমারের এ অঞ্চল ভুট্টা চাষের জন্যও উপযুক্ত। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। মিয়ানমারে রয়েছে প্রচুর রফতানিযোগ্য গবাদিপশু। বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে, যাতে করে আমরা ভারতনির্ভরতা হ্রাস করতে পারি। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের বিকাশমান ফার্নিচার শিল্পের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমার থেকে সহজে মূল্যবান কাঠ আমাদনি করতে পারি, যা কি-না আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রফতানি করতে পারব। চাল, ডাল, ছোলা, আদা, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা জাতের মসলা মিয়ানমার থেকে আরো সহজে আমাদনি করা যাবে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে। ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর হয়ে হাজার হাজার পর্যটক মান্দালয়, কাম্পেইন ও ইয়াঙ্গুন ভ্রমণ শেষে মায়োহং আসেন। বর্তমানে এই পর্যটকরা মায়োহং থেকে পুনরায় ইয়াঙ্গুনে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মায়োহং থেকে তাদেরকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যায়। কেননা অনেক পর্যটকই আর একই পথে ইয়াঙ্গুনে ফিরে যেতে চান না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতে ভারত-মিয়ানমার গ্যাস পাইপলাইন প্রজেক্টের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, যা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতে গ্যাস রফতানির পরিকল্পনা নির্দেশ করে। এই পাইপলাইন প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে মিয়ানমারের গ্যাস রফতানিও সম্ভব (মোহনা হোল্ডিংস এ ধরনের একটি প্রস্তাব করেছিল ১৯৯৬ সালে)। মিয়ানমারের কালাদান মাল্টিমুডাল রিভার প্রজেক্ট থেকেও বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।
হামবুর্গে 'ইটলস'-এ বাংলাদেশের বিজয় বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বাংলাদেশকেই এখন উদ্যোগী হতে হবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়কটি দ্রুত শেষ করাও জরুরি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে বটে। কিন্তু বৃহত্তম স্বার্থের খাতিরে এই সমস্যাটিকে বড় করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভারতকেন্দ্রিক আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বৃত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে এসে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ যদি নেই, তা আমাদের জাতীয় স্বার্থকেই শুধু রক্ষা করবে না, বরং পূর্বের দিগন্ত আমাদের জন্য উন্মোচিত হবে। 'ইটলস'-এর এই রায়ের একটি সদূরপ্রসারী প্রভাব রয়ে যাবেই। বাংলাদেশ এই রায়কে নিজেদের স্বার্থে কতটুকু এবং কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটাই দেখার বিষয় এখন। শুধু আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। যেভাবে প্রতিদিন প্রতিটি সংবাদপত্রে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশংসাসূচক বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে, তাতে করে মূল বিষয়টি চাপা পড়ে যেতে পারে। রায় পেয়েছি; কিন্তু এখন যেতে হবে অনেকদূর। শুধু আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, এই রায় আমাদের জন্য বিশাল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। সমুদ্রের যে বিশাল সম্পদ, সেই সম্পদকে আমরা আমাদের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারি। এই মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে সমুদ্রের বস্নকগুলো বণ্টন করার প্রয়োজন নেই। কেননা এটা করা হলে বিতর্ক আরো বাড়তে পারে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিদেশিদের কাছে গ্যাস ক্ষেত্রগুলো 'ইজারা' না দেয়ার একটি জনমত রয়েছে। একটি জাতীয় কমিটি বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে আমাদের নিজস্ব বাপেক্সকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তা চিন্তা করা প্রয়োজন। বাপেক্সের জন্য জনবল, অর্থ ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও প্রয়োজন। বাপেক্সকে অবজ্ঞা করে যদি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে গ্যাস বস্নকগুলো ইজারা দেয়ার ব্যাপারে আমরা উৎসাহিত হই, তাহলে তাতে বিতর্কের মাত্রা আরো বাড়বে। তাই যে কথাটা বলা প্রয়োজন তা হচ্ছে, সমুদ্রে আমাদের জয় নিশ্চিত হয়েছে। এটা আমাদের বড় পাওয়া। কিন্তু যেতে হবে অনেকদূর। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের দিকে যদি আমরা হাত বাড়িয়ে না দেই, তাহলে ক্ষতি হবে আমাদেরই। একটি 'আস্থা ও বিশ্বাসের' সম্পর্ক রেখেই মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নত হতে পারে, যা কি-না সাগরের বিশাল সম্পদ আহরণে আমাদের সাহায্য করবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ঃধৎবয়ঁব.ৎধযসধহ@ধড়ষ.পড়স
0 comments:
Post a Comment